প্রচ্ছদ

চা বাগিচায় চাপাপড়া এক অবরুদ্ধ দরোজার করুণ কাহিনী

  |  ০৩:০৪, আগস্ট ২৬, ২০২২
www.adarshabarta.com

:: সাইফুর রহমান কায়েস ::

চা শ্রমিক ভাইদের বঞ্চনার ইতিহাস সার্ধশতবর্ষ জুড়ে। ভারতের বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, বাকুড়া থেকে আদিবাসীদের নানা প্রলোভন দিয়ে এদেশে নিয়ে এসে চা শিল্পের গোড়াপত্তনের কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিলো। শুরু থেকেই এরা শ্রমশোষণের শিকার, অবহেলিত, মৌলিক মানবাধিকার বঞ্চিত। রাজা যায়, রাজা আসে কিন্তু এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নিবেদিত নৃগোষ্ঠীর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আসেনি। বৃটিশ শাসনামলে যা ছিলো এখনো তাই আছে। বরঞ্চ এখন তাদের অবস্থা দারিদ্র‍্য সীমার একেবারেই তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। এরা এদেশের নাগরিক হলেও এদেরকে সেই মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে রাষ্ট্রের চরম অবহেলার নজীর এখনো রয়ে গেছে।
চা জনগোষ্ঠীর উপর নানা সময়ে শোষণ ও বঞ্চনার খড়্গ নেমে এলেও তারা সেভাবে কোনো প্রতিবাদ করেন নি। নিজেদের মজুরী বৃদ্ধির ব্যাপারে সুসংগঠিত যুগোপযোগী আন্দোলনে ইতিপূর্বে নামেন নি। তাদেরকে নানাভাবে দাবিয়ে রাখা হয়েছিলো।
১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদনের মাধ্যমে এদেশে প্রথম এই শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় আদিবাসী চা জনগোষ্ঠীর হাত ধরে ইউরোপীয় ব্যবস্থাপনায়। তিলোত্তমা নগরী সিলেটের একেবারে চিকেননেক বলা যায় এই বাগানটিকে। শহরের ঝলমলে, ঝাঁ চকচকে দালানের আড়ে গুমরে কাদে মালনীছড়ার শ্রমিকদের জনপদ। শহরের আলিশান হোটেল, মল, এপার্টমেন্টে এদের প্রবেশাধিকার নেই। থাকলেও তাদের করতাইয়ে কুলায় না। আর্থিকভাবে এদের মেরুদণ্ড খুবই নাজুক। এদের হাড়জিরজিরে চেহারা যেনো রোগক্লিষ্ট বাংলাদেশ । ভোটের বাজারে এরা জয়পরাজয়ের কিংমেকার হলেও এদের ভাগ্যবদলের জন্য কোনোকালেই নজর দেয়া হয় নি। এরা উন্নয়নের মহাসড়কের মহাযানের নীচে চাপা পড়ে মারা পড়ছেন প্রতিনিয়ত।
যে চা শিল্পের মূল চালিকাশক্তি এই নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী তারাই অবহেলিত। এই শিল্পের মায়ায় পড়ে তারা ভুলে গেছেন নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি , ব্রত, কৃত্যাচার। ফলে এই চা বাগানগুলি হয়ে উঠেছে তাদের জন্য দ্য ডোর অফ নো রিটার্ন ।
আর এই অবরুদ্ধতার ফাদে পড়েছেন চা বাগানে চা শ্রমিক হিসেবে মুণ্ডা, সাঁওতাল, ওঁড়াও, মাহালি, সবর, পাসি, রবিদাস, হাজরা, নায়েক, বাউরি, তেলেগু, তাঁতি, কৈরী, দেশওয়ারা, বর্মা, কানু, পান, পাইনকা, কুর্মী, চাষা, অলমিক, মোদি, তেলি, পাত্র, মাঝি, রাজবংশী, মোদক, বাড়াইক, ভৌমিক, ব্যানার্জি, ভূমিজসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কয়েক হাজার মানুষ। এদেরকে শুরু থেকেই ক্রীতদাস বলে গণ্য করা হতো। প্রথম প্রজন্মের শ্রমিকেদের কপালে সনাক্তকরণ চিহ্ন একে দেয়া হয়েছিলো। আমি নিজে চান্দপুর চা বাগানের অনেক প্রবীণ শ্রমিকের কপালে এই চিহ্ন দেখেছি।
শ্রমিক সংগ্রহের নামে আদতে দাসপ্রথার প্রবর্তন করা হয়েছিলো তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে। নানা ভয়ভীতি, প্রলোভন, জবরদস্তির মাধ্যমে শ্রমিক সংগ্রহের সাথে নিযুক্ত ব্যক্তিদের আরিকাত্তি বলা হতো। এই আরিকাত্তি প্রথা ক্রমে আইনে পরিণত হলে শ্রমদাস প্রথার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আমাদের সামনে অবভাসিত হয়। এই প্রথা প্রবর্তনের ফলে চা শিল্পে শ্রমিকের যোগান বাড়লেও এদের কপালের দুর্ভোগ আরো চরমে উঠতে লাগলো। আসামেরই শোকগীতি বলছে, মনে করি আসাম যাবো, আসাম গেলে তোমায় পাবো, আসাম গিয়া লকরী লিবো, সাহেব বলে ধরি আন, বাবু বলে তুলবো পিঠের চাম, ওহে বাবুরাম…. নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যাওয়ায় ১৯২১ সালের ২১ শে মে ১২০০০ হাজার চা শ্রমিকের একটি সুসংগঠিত দল নিজেদের দেশে ফেরার অভিপ্রায়ে মুল্লুকে চলো আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং চাদপুর-গোয়ালন্দ অভিমুখে যাত্রা করেন। চাদপুর থেকে স্টীমারে উঠতে গিয়ে প্রচণ্ড ভিড়ের চাপে পিষ্ট হয়ে সেদিন ৩০০ আদিবাসী চা জনগোষ্ঠী মারা যান। সেদিন তাদের মুল্লুকে ফেরা বিঘ্নিত হলে অবশিষ্টাংশ চাদপুরেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তখন কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটার সাথে সাথে তাদের উপর পুলিশি নির্যাতন এবং গুলি চালিয়ে হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা ঘটায় তাদের ধনুকভাঙ্গা পণ চীর্ণ হলে তাদের আর মুল্লুকে ফেরা হয় নি। অনেকটাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এদেশের চা বাগিচায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই ঘটনার শতবর্ষ উদযাপন করেছেন তারা গতবার ২০২১ সালের ২০শে মে। তাদের উপর হাতে মারার বিষয়টি এখন আর দেখা না গেলেও ভাতে মারার পথ ও পন্থাগুলি এখনো বহাল তবিয়তে বিদ্যমান । আর এই বঞ্চনার সুদীর্ঘ ইতিহাসের নীচে চাপা পড়া বোবাকান্নার রোলই আজ আন্দোলনে রূপ নিয়েছে।

চা বাগিচা অধ্যুষিত জনপদে এক মিলিয়নেরও বেশী জনগোষ্ঠীর বাস হলেও তাদের জমির মালিকানা নাই। তারা এই পুজিবাদের ক্রীতদাস এবং বশংবদ শ্রমদাস হিসেবেই জীবনযাপন করলেও রাষ্ট্রের সাংবিধানিক অধিকার ভোট প্রদান ছাড়া আর বাকী সবকিছু থেকেই আজো বঞ্চিত। চা বাগিচাঞ্চলে স্থানীয়, জাতীয় নির্বাচনে এদের প্রতিনিধিত্ব এখনো প্রতিষ্ঠিত হয় নি। কিছু ইউপিতে তারা চেয়ারম্যান এবং মেম্বারের পদ অলংকৃত করলেও মহান জাতীয় সংসদ এবং উপজেলা পরিষদে এদের কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। আর এই না থাকাটাই তাদের জন্য কাল হয়ে দাড়িয়েছে। এখন এই আন্দোলন শুধু ন্যায্য মজুরীর দাবীতে সীমিত রাখলে চলবে না, গণতন্ত্র বিকাশের আন্দোলনের রূপও দিতে হবে। আর সেজন্য আওয়াজ তোলাটা এখন সময়ের দাবী।
সরকারকে এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মহান জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে বিশেষ আইন পাশের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
ভোটের বাজারে চা বাগান অধ্যূষিত অঞ্চলে পরাজিত প্রার্থীদের দ্বারা নির্যাতিত হবার খবর আজ আর কোনো গোপণ বিষয় নয়। হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট মাধবপুর অঞ্চলের সাবেক সাংসদ বিএনপি নেতা সৈয়দ ফয়সল এনটিসি বা ন্যাশনাল টি কোম্পানির চেয়ারম্যান থাকাকালে তাকে ভোট না দেয়ার অভিযোগে চণ্ডীছড়া চা বাগানের শ্রমিকদের কড়া রোদের মাঝে দাড় করিয়ে রেখেছিলেন। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে তার পালিত গুণ্ডাপাণ্ডা তেলিয়াপাড়া, নোয়াপাড়া চা বাগানের শ্রমিকদের উপর শারীরিক নির্যাতন চালানোসহ স্থানীয় বাজারে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলো। যেটি আজো লোকমুখে শোনা যায়। তাছাড়া আমি এসমস্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীও বটে।
চা শ্রমিকদের জন্য পৃথক সংরক্ষিত সংসদীয় আসনের ব্যবস্থা করা গেলে নির্যাতন চিরতরে বন্ধ হবে।
দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন দিয়েছেন, সম্ভ্রম হারিয়েছেন তাদের স্বজনেরা। তাই এদেশের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতাকে সম্মান জানানো উচিৎ ।
মজুরী নিয়ে যখন আন্দোলন চলছে তখন আমি চুপ করে কিভাবে থাকি। এদের মজুরী ধানী জমির শ্রমিকের সমান হওয়া উচিৎ । একজন ধানী শ্রমিক সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা মজুরীতে কাজ করেন। সাথে গেরস্থের বাড়িতে সকালবেলা নাশতা, দুপুরে ভরপেট ভাত খেতে পান। সন্ধ্যার সময় চা পানের ব্যবস্থা থাকে। এই ব্যবস্থা তাদের বেলায়ও প্রযোজ্য হলে মন্দ হতো না। বছরে ১০% হারে মূল্যস্ফীতি ভাতা দৈনিক মজুরীর সাথে যুক্ত করা গেলে চা শিল্প প্রাণ ফিরে পাবে।
তাদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যবীমা চালু করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা জালের আওতায় আনতে হবে। তাদের সন্তানদের জন্য শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। দেশের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
নানা অজুহাতে শ্রমিকদের ছাটাই, মজুরী কর্তন বন্ধ করতে হবে। আমরা চা বাগানগুলোকে আরেকটি দ্য ডোর অব নো রিটার্ণের মতো দেখতে চাই না। কালের করাল গ্রাসের নিচে চাপাপড়া ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হিসেবে দেখতে চাই না। সাওতাল পাড়াগুলি আবার হাড়িয়া গন্ধে ম’ম’ করুক, ঝুমুর নাচে মেতে উঠুক। ও ঝুমুর গায়েন, তোমার রাত কাটে না…