প্রচ্ছদ

গাজী বোরহান উদ্দিন সড়ক: আমাকে রক্তক্ষরণ থেকে বাঁচান!

  |  ১৭:৫৪, মে ২৬, ২০২৩
www.adarshabarta.com

Manual1 Ad Code

সাদেকুল আমীন :

সম্প্রতি সিলেট-কানাইঘাট সরাসরি রাস্তা গাজী বোরহান উদ্দিন সড়কের করুণ অবস্থা নিয়ে অনেকেই ফেসবুকে লেখালেখি এবং ছবি আপলোড করছেন। বিশেষ করে লন্ডনে কমিউনিটির পরিচিত মুখ, কানাইঘাট এসোসিয়েশন ইউকে-এর এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী ফারুক আহমদ চৌধুরীর স্ট্যাটাসটি আমার নজর কাড়ে। রাস্তার জরাজীর্ণ এ অবস্থা দেখে আমি হতবাক হই। তাই আমি এখানে বুরহান উদ্দিন সড়ক এবং এর বর্তমান বেহাল দশা তুলে ধরার এক ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করেছি মাত্র।

কানাইঘাট, সিলট জেলার একটি উপজেলা। জেলা শহর থেকে পূর্ব দিকে প্রায় ৫১.২ কিলোমিটার বা ৩২ মাইল দূরে অবস্থিত। আয়তন ৪১২.২৫ বর্গ কিলোমিটার আর ভৌগোলিকভাবে এর পশ্চিমে জৈন্তাপুর ও গোলাপগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে বিয়ানীবাজার ও জকিগঞ্জ উপজেলা এবং উত্তরে জৈন্তাপুর উপজেলা ও ভারতের মেঘালয় রাজ্য।

এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত সিলেট জেলা শহর থেকে কানাইঘাট উপজেলা থানা কমপ্লেক্স পর্যন্ত সরাসরি কোনো সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না।

সিলেট শহর থেকে কানাইঘাট উপজেলার সাথে যে ক’টি সড়ক যোগাযোগ বিদ্যমান সেগুলি বেশ দীর্ঘ এবং দুর্বল। এ সড়কগুলো হলো; সিলেট তামাবিল রোড থেকে চতুল-দরবস্ত হয়ে কানাইঘাট থানা পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি পাকা রাস্তা। অপরদিকে, জেলা পরিষদের আনুমানিক ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দ্বিতীয় আরেকটা পাকা রাস্তা যা কানাইঘাট বাজার থেকে হারিছ চৌধুরী ব্রিজ দিয়ে সুরমা নদীর দক্ষিণ পার থেকে শাহবাগের নিকট সিলেট জকিগঞ্জ রোডে মিলিত হয়েছে। তৃতীয় পাকা রাস্তাটি সিলেট তামাবিল রোড থেকে হরিপুর হয়ে গাছবাড়ীর নিকট বোরহান উদ্দিন সড়কের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। এ সড়কটি তুলনামূলকভাবে নতুন আর এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ কিলোমিটার।

Manual1 Ad Code

জনগুরুত্বপূর্ণ এ রাস্তাগুলো অত্যন্ত ছোট, সরু এবং ঝুঁকিপূর্ণ। বর্তমানে এ সকল সড়কের খুবই বেহাল অবস্থা। প্রতিদিন এসব সড়ক দিয়ে যাতায়াতে এলাকার মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তাঁদের ভোগান্তির শেষ নেই!

তবে, কানাইঘাট-গাছবাড়ী-সিলেট সরাসরি রাস্তাটি কানাইঘাট প্রশাসনিক ভবন থেকে ছোটদেশ-বড়দেশ-গাছবাড়ী-ঝিঙ্গাবাড়ী-তালবাড়ী-রাজাগঞ্জ হয়ে গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাঘা ইউনিয়ন দিয়ে সরাসরি সিলেট শহর পর্যন্ত পৌঁছেছে যা “গাজী বোরহান উদ্দিন সড়ক” নামে পরিচিত। এ সড়কটি দীর্ঘদিন থেকে নির্মাণাধীন ছিল আর এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৫.৩০ কিলোমিটার। সড়কটির তিনটি অংশ আছে; কানাইঘাট-গাছবাড়ী অংশ যার দৈর্ঘ্য ১৮.৪৫ কিলোমিটার, গাছবাড়ী-সীমারখাল অংশ যার দৈর্ঘ্য ১৮.১৫ কিলোমিটার এবং সীমারখাল-সিলেট সদর অংশ যার দৈর্ঘ্য ১৮.৭০ কিলোমিটার।

এখানে উল্লেখ্য যে, বোরহান উদ্দিন সড়কের কানাইঘাট অংশের (সীমাখাল থেকে কানাইঘাট পর্যন্ত) দৈর্ঘ্য মাত্র ৩৬.৬০ কিলোমিটার।

১৯৮২ সালে তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের সময়ে এই সড়ক নির্মাণের বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ শুরু হয়। যদিও এ সড়কের অনুমোদন হয় এর বেশ আগে। সম্ভবত পঞ্চাশের দশকে।

১৯৮২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ বৎসরে কানাইঘাট-গাছবাড়ী অংশের ১৮.৪৫ কিলোমিটার রাস্তার উল্লেখযোগ্য কোন কাজ হয় নাই। তবে, উপজেলার প্রথম চেয়ারম্যান জনাব রকিব উদ্দিনের (১৯৮৫-১৯৯০) সময় কিছু কাজ হয়েছে। কিন্ত, গাছবাড়ী-সীমারখাল অংশের ১৮.১৫ কিলোমিটার রাস্তার নির্মাণ কাজের দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি হয় নাই।

দীর্ঘদিন থেকে উপজেলার জনগণের ন্যায্য দাবি ছিল সড়কটির যে অংশে নির্মাণ কাজ অসম্পূর্ণ রয়েছে তা দ্রুত শেষ করে এটি চালু করা। কিন্ত, কিছু স্থানীয় জনগণের অসহযোগিতা, এলাকার জনপ্রতিনিধিদের বিরোধ, অপ্রত্যাশিত প্রশাসনিক জটিলতা এবং রাজনৈতিক টাল-বাহানা সড়ক নির্মাণ কাজের অগ্রগতিতে বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

Manual5 Ad Code

তবে, ২০০১ সালে শিকদার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার কুতুবউদ্দিন আহমদ শিকদার এমবিই তাঁর নিজ খরচে বোরহান উদ্দিন সড়কের উপর ১টি ব্রিজ, ৮টি কালভার্ট এবং বেশ কিছু মাটি ভরাটের কাজ সম্পন্ন করেন। ফলে, গাছবাড়ী-সীমারখাল অংশের স্থবির হয়ে পড়া সড়ক নির্মাণ কাজের কিছুটা হলেও গতি সঞ্চারিত হয় এবং এ এলাকার জনগনের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত সরাসরি যাতায়াতের পথ সুগম হয়।

অবশেষে, তৎকালীন কানাইঘাট-জকিগঞ্জের নির্বাচিত এমপি (২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত) মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী কানাইঘাট থেকে সীমারখাল পর্যন্ত অত্র এলাকার জনগণের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত সড়কটির অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করে এর শুভ সূচনা করেন।

বর্তমানে এ সড়ক দিয়ে যাতায়াতের যে দুর্ভোগ অবস্থা তা পর্যালোচনা করার আগে আমরা সংক্ষিপ্ত ভাবে জেনে নেব উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার অপরিহার্যতা।

আমরা যারা উন্নত বিশ্বে বসবাস করি তারা ভালো করে জানি যে উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার অপরিহার্যতা। রাস্তা নির্মাণ উন্নয়ন অবকাঠামোর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটি সু-উন্নত সড়ক নেটওয়ার্ক যে কোনো সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তাছাড়া, একটি ভালো সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টিতেও বিরাট ভূমিকা পালন করে। রাস্তাগুলি  অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে উদ্দীপিত করে। উৎপাদককে বাজারের সাথে, শ্রমিকদের চাকরির সাথে, ছাত্রদেরকে স্কুলের সাথে এবং অসুস্থদের হাসপাতালের সাথে সংযুক্ত করার মাধ্যমে, রাস্তা যেকোন উন্নয়ন এজেন্ডার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য, সাশ্রয়ী মূল্যের এবং আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রদান করা যেকোনো দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এই কারণে, রাস্তার অবকাঠামো সব সরকারি সম্পদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

বোরহান উদ্দিন সড়কের বর্তমান অবস্থা: কানাইঘাট অংশে থাকা বোরহান উদ্দিন সড়কের ৩৬.৬০ কিলোমিটার এবং উপজেলার অধিকাংশ রাস্তার বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। এ রাস্তা দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর থেকে সংস্কারবিহীন। রাস্তার যে কিছু কাজ হয়েছে তা অত্যন্ত নিম্নমানের। সামান্য একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তায় অসংখ্য গর্তের সৃষ্টি হয়। পিচ উঠে যায় আর রাস্তাজুড়ে পানি ও কাদা জমে যায়। এ কারণে এলাকার জনসাধারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। প্রতিদিন এ সড়ক দিয়ে শত শত যানবাহন ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছে। যান চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে আর প্রায়ই এখানে অনাকাঙ্খিত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে।

প্রতিদিন, বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ, রোগী, শিশু এবং গর্ভবতী মায়েরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জরাজীর্ণ এ রাস্তা দিয়ে চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করছে। ফলে, তারা যে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক রক্তক্ষরণের সম্মুখীন হচ্ছে তা মোটেও কাম্য নয়! রাস্তাটি চিৎকার করে কাঁদছে! কাঁদছে! আর কাঁদছে! – আমি “বোরহান উদ্দিন সড়ক” আমাকে রক্তক্ষরণ থেকে বাঁচান! কিন্তু, কেউ কি এ কান্না শোনছে?

এখানে উল্লেখ্য যে, বিখ্যাত চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস (৫৫১-৪৭৯ খ্রিস্টপূর্ব) রাস্তা নিয়ে যথার্থই বলেছিলেন, “রাস্তা তৈরি হয়েছে ভ্রমণের জন্য, গন্তব্য নয়”।

আমারা উপজেলার সাধারণ জনগণ, সমাজের সচেতন নাগরিক, স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলার নির্বাচিত প্রতিনিধি, অত্র নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য এবং সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্তা ব্যাক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি – আপনারা যেনো আপনাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যতাযতভাবে পালন করেন। বিশেষ করে সংশ্লিষ্টরা যেন জরুরী ভিত্তিতে জনদুর্ভোগ লাঘবে জনগুরুত্বপূর্ণ গাজী বোরহান উদ্দিন সড়ক সহ অন্যান্য রাস্তাগুলোর সংস্কার, টেকসই ও উন্নতমানের মেরামতের কাজ যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করেন। তবে, আপনাদের দায়িত্বহীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে সড়কটি যে মানুষের যাতায়াতের রাস্তার পরিবর্তে গন্তব্যে পরিণত হচ্ছে তা আমরা বিশ্বাস করতে চাই না!

আমরা অশা করি বর্তমান প্রজন্ম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্মার্ট এবং দূরদর্শী যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে যা এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে মর্ডান করবে। আর এই আধুনিকীকরণ এলাকার ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়নের দ্বার উন্মোচন করবে। পাশাপাশি তাঁরা এলাকার বিদ্যমান সকল সড়কের সম্প্রসারণ, প্রশস্তকরণ এবং এর বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে। একই সাথে নতুন নতুন সংযোগ সড়কের সন্ধান করে এগুলির নির্মাণ প্রক্রিয়ার জন্য কাজ করবে। যেমন, বোরহান উদ্দিন সড়কের সাথে থাকা শহর উল্লাহ বাজার থেকে বাঁশবাড়ী হয়ে গাছবাড়ী-হরিপুর রোডের সাথে মিলিত করা।

Manual6 Ad Code

এছাড়াও এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে নিম্নোল্লেখিত প্রস্তাবগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে;

বিদ্যমান বোরহান উদ্দিন সড়কের সাথে মানিকগঞ্জ বাজার, গাছবাড়ী বাজার, মুকিগঞ্জ বাজার, তালবাড়ী বাজার এবং রাজাগঞ্জ বাজারের সংগে সংযোগ সড়ক করা।

একই সাথে মানিকগঞ্জ বাজার, গাছবাড়ী বাজার, ঝিঙ্গাবাড়ী মাদ্রাসা ও মুকিগঞ্জ বাজার, তালবাড়ী বাজার এবং রাজাগঞ্জ বাজারের আশপাশে সুরমা নদীর উপর দিয়ে অন্তত পাঁচটি নতুন সেতু নির্মাণের প্রস্তাব উপস্থাপন করা।

এ ছাড়া সুরমা নদীর দক্ষিণ পাশে নতুন সংযোগ সড়ক নির্মাণ করে সেতুগুলোকে জকিগঞ্জ-সিলেট সড়কের সাথে যুক্ত করা।

আমরা আরও আশা করি যে, আগামী ৩০ বছরের জন্য সরকারের দীর্ঘমেয়াদী মাস্টার প্ল্যানে আধুনিক ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার এই প্রস্তাবগুলো অন্তর্ভুক্ত করে তাদের বাস্তবায়নের জন্য কাজ করা। এই আমাদের প্রত্যাশা।

তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আমি “বোরহান উদ্দিন সড়ক” বলছি – লেখক শ্রদ্ধেয় বড় ভাই প্রয়াত মোহাম্মদ আলাউদ্দিন – স্বরনিকা-অভিষেক ২০০০, কানাইঘাট সমিতি, সিলেট এবং ইন্টারনেট – অনলাইন ভিত্তিক সংবাদপত্র। যারা মৌখিকভাবে তথ্য দিয়েছেন। যাদের ফেইসবুক পেইজ থেকে ছবি সংগ্রহ করেছি। তাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

******************

Manual4 Ad Code

লন্ডন, ২৪ মে ২০২৩

 

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code