প্রচ্ছদ

সাইফুর রহমান কায়েস এর শোকাঞ্জলি

  |  ০৪:৫৮, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২৩
www.adarshabarta.com

 

শোকাঞ্জলি
ডলি- আমার বোন
#সাইফুর রহমান কায়েস #

আরশিতে ছায়া পড়ে, নৌকো ভাসে, হাওয়া লাগে পালে
তুমিও লুকিয়ে থাকো, স্বাভাবিক, কোথাও আড়ালে…
দিবাচক্ষু মাছগুলো লেজের ঝনাত ঝাপটাতে
কাচের গোলক ভাঙে, চুরমার করে সব ঢেউ
তুমি কি লুকোবে বলে জলমহলের জানালাতে?
আমার আরশির ছায়া জানবে না জেনো তার কেউ

কত গাছ জলচর, সিক্ত এ ডুবুরিজীবন
উজানভাটির দেশে সাক্ষী শুধু মায়াদর্পণ

ডুমুরফুলের মতো মখমলি অদৃশ্যতায়
আগুন জলের যুদ্ধ দেখে আমি এমন অবাক
তুমিও স্বভাবকবি, আঁশ গন্ধ মিলিয়ে হাওয়ায়
উঁকি দাও এ মুলুকে! এই দেখো আরশির ফাক…

আগুনেই এসো তবে, স্বস্তি নেই হিমেল পাতালে
আরশিতে উঠে এসো, নৌকো ভাসে, হাওয়া লাগে পালে
“আরশিতে ছায়া পড়ে”
– কবি পৌলমী সেনগুপ্ত

বোনের মৃত্যুর আজ তৃতীয় দিন। বোনকে ছেড়ে থাকি নি শেষ কটা দিন। কি মায়ায় জড়িয়ে রেখেছিলো বোন আমার আজন্ম। তার মৃত্যুতে শোক কাটিয়ে উঠা কোনোদিনই সম্ভব নয়। অসম্ভব সর্বংসহা হয়ে বেচেছিলো। এই পৃথিবীর কাছে কোনো চাওয়া পাওয়া „ অভিযোগ-অনুযোগ ছিলো না। ভীষণ চাপা স্বভাবের মানুষ ছিলো। উল্টো আমরাই তার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। অকাতরে আমাদেরকে দিতে কার্পণ্য করেনি।
যখনই সুযোগ পেয়েছি তখনই বোনের কাছে ছুটে গেছি। এক জনমের ঋণে জড়িয়ে রয়েছি বোনের সাথে। আদর করে খেতে দিয়েছে। প্রাণ জুড়ানোর মুগ্ধতা বিলিয়েছে।
নাজিম হিকমত বলছেন„ একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ূ বড়জোর তিনদিন। কিন্তু আমার শোকযাপন অনন্তকাল ব্যাপিয়া। এমনকি তারপরেও আমার চম্পাবতী পারুল বোনের জন্য চলতে থাকবে। তার জন্য অশ্রুপাত আমার কোনোদিনই থামবে না।
তার শরীরে যে এতোবড় মারণব্যাধি বাসা বেধেছে আমরা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারি নি। সবকিছুই সয়ে যাবার প্রবণতা তাকে আমাদের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। অকাল প্রয়াত কবি আবুল হাসানের পৃথক পালংক হয়ে বেচে থাকাকেই শ্রেয়তর মনে করে বোন আমার ঝিনুকের জীবন বেছে নিয়েছিলো। নিরবে মুক্তা ফলানোর চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করে রেখেছিলো। মাতৃরূপ নিয়ে সে আমাদের মাঝে বেচেছিলো। অনন্তঘুমে চলে যাবার আগেও নিজের কথা ভুলে গিয়ে আমি কেমন আছি তা জানতে ভুলে যায় নি। খেয়েছি কিনা জানতে চেয়েছে। আমাদের জন্য ধূয়াউঠা গরম ভাতে মায়া ছড়িয়ে দিতে ভুলে নি বোন আমার। শান্ত„ স্নিগ্ধ এক জলাশয়ের অরূপ রূপের বিভা সে ছড়িয়ে দিয়েছিলো। মৃত্যুর পর তার সে দ্যুতিময়তা তারার আলোর মতো স্বর্গীয় আভা ছড়িয়েছিলো।
তার মৃত্যুর খবর শুনে আগত মানুষের স্রোতটি জনসমুদ্রের রূপ নিয়েছিলো। নারীপুরুষের অশ্রুসিক্ত নয়ন আমাদেরকে বিমোহিত করেছে। মানুষের মন জয় করে নিয়েছিলো। তার বিনয়„ ধৈর্য্য „ পরোপকারী „ মিশুক এবং মানিয়ে ও মেনে চলার মতো মহৎগুণে গুণান্বিত হওয়ায় সংক্ষিপ্ত বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে যে সুনাম ও সম্মানের উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছে তা যদি আমরা আরো চল্লিশ বছর বাচি তাও আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
তার নিথর দেহ যেনো প্রাণচাঞ্চল্যে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিলো। যেনো বোন আমার ভাতঘুমে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমার মায়ের মুখের আদলটাই তার চেহারায় আরেকবার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। কয়েকদিন আগে আমার বোনের জন্য @লিখেছিলাম একটি কবিতা। কবিতাটাই তাহলে পড়ি –

চম্পাবতী আমার বোন

চম্পাবতী বোন আমার মায়ারজালে রাখতো যে আগলে
মাতৃপাণির অমল ছায়া দেখি তার মুখমণ্ডলে
নিজের কথা ভুলে গিয়ে তুলে দিতো মুখের আহার
সর্বংসহা ঝিনুক যে সে- জগৎ জুড়ে জুড়ি মেলা ভার
তাকে দেখেই শিখি নিত্য “ভেতরে বিষের বালি„ মুখ বুঝে মুক্তা ফলাও
স্বার্থের বাজারে স্বার্থই পরমব্রত- স্বার্থ এসে তার কাছেই উধাও
অপরের জন্য ব্যতিব্যস্ত নিতুই পরার্থে ভীষণ কাতর
তার কাছেই শান্তি খুজি যেনো সে পরশ পাথর
ভাইয়ের দুখে নিতুই কাদে হাসপাতালে রোগশয্যায় শুয়ে
আকাশ আজ মেঘলা ছিলো না„ বৃষ্টি দিয়েছে ধুয়ে
কুতুবমিনার চম্পাবতী নামে ফিদা আমরা„ সে যে আমাদেরই একমাত্র বোন
তার খবর নিতে উদগ্রীব হয়ে ষ্টেটস থেকে মা ভাইয়ের আসে ফোন
আকাশভরা লক্ষ তারার মাঝে সে-ইযে একটি তারা জ্বাজ্জল্যমান
মিষ্টিমুখের হাসিতে যে ভুলিয়ে রাখে শত অভিমান
তাকেই নিয়ে লিখে রাখছি তাই ভাতৃপ্রেমের অমর উপাখ্যান
তার কাছেই এসে ঘুচে গেছে পৃথিবীর সব ব্যবধান
জীবনের খোলা শোক বইয়ে অভিবাদন পড়ুক জমা
অন্তর্দশন ও দহনগুলি হোক আজ এক অমিমাংসিত উপমা

বোন আমাদের আগুনের নদী হয়ে ক্ষিধের অন্ন জুগিয়ে গেছে। নিজেকে পুড়িয়ে আলোকিত করে গেছে জীবন। তার দেহ মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু আত্মা অবিনশ্বর । চিরপ্রশান্তি লাভ করুক বোন আমার। সে স্বর্গবাসী হোক।
উত্তরাধিকার হিসেবে মায়ের কাফনের কাপড়টাই শুধু পেলো বোন আমার। মায়ের কাফনের কাপড়ে খোয়াই নদীর অববাহিকার কাচুয়ার মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত। অফুরন্ত প্রাণৈশ্বর্য্যে ভরা জীবনের শেষে মসৃণ ঘাসই পেতে দিয়েছে সবুজ শয্যা…
শক্তি চট্টোপাধ্যায় বোধহয় আমার শোককাতরতার কথা ভেবেই লিখেছিলেন

যে-পথে যাবার
– শক্তি চট্টোপাধ্যায়

যদি সারাদিন তাঁকে কাছে পাওয়া যেতো
শুনেছি ছিলেন তিনি গাছের বাকলে গা এলিয়ে
যতটুকু ছায়া তাঁর প্রয়োজন, ছিলো ততটুকু
দক্ষিণ হাওয়ায় উড়ে শুকনো পাতা আসে তাঁর কাছে
যেন নিবেদন, যেন মন্ত্র ভাষা ছিন্নভিন্ন মালা
তাঁর জন্য ঐ দূর মাঠের রোদ্দুরেও ছিলো জ্বালা
কিছুটা রোদ্দুরে হেঁটে, খালি পায়ে পড়েছেন শুয়ে –
নিদ্রা নয়, ধ্যান নয়, বেদনার ব্যথার ভিতরে
মনোকষ্ট বুকে নিয়ে শুয়ে রয়েছেন একা একা ।

যদি সারাদিন তাঁকে কাছে পাওয়া যেতো
কাছে পেতে গেলে কাছে যেতে হয়, এভাবে চলে না
হাতের সমস্ত সেরে, ধুয়ে-মুছে সংসার, সমাধি –
গুছিয়ে-গাছিয়ে রেখে, সাধে ঢেকে – তবে যদি যাও
দেখবে, দাঁড়িয়ে আছে গাছ একা দৃষ্টি ক’রে নিচু
যেতেও হয়নি তাঁকে, এসেছিলেন তিনি সময়ে
গেছেন সময়ে চলে, সেই পথে, যে-পথে যাবার ।

পুনশ্চ – আমাদের বোনের মৃত্যুতে যারা সশরীরে„ ফোনকলে„ ফেসবুক বা অবয়বপত্রে শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন তাদেরকে আমার কোটি সালাম। আজীবন কৃতজ্ঞতায় জড়িয়ে থাকলাম। আমার বোনকে সকলের প্রার্থনায় রাখার সনির্বন্ধ অনুরোধ রইলো। জাজাকাল্লাহ খাইরান ফা- ইন্নাল্লাহা শাকিরুন।

কাচুয়া„ খোয়াই নদীর বাকে বসে ।