প্রচ্ছদ

জীবন বড় বৈচিত্রময়, পর্ব-১৪

  |  ১১:২৭, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২০
www.adarshabarta.com

Manual3 Ad Code

:: মিজানুর রহমান মিজান ::

পাঠক আপনাদের স্মরণ আছে আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু মদন মোহন কলেজের প্রিন্সিপাল আমাকে বলেছিলেন,‘আমি কলেজের সমুদয় বকেয়া প্রদান করে নির্বাচনী পরিক্ষা দিতে।আমি কিন্তু বকেয়া টাকা পরিশোধ না করেই পরিক্ষায় অংশ গ্রহণ করি। সে সময় পাঁচটি বিষয়ের উপর নির্বাচনী পরিক্ষা হতো। আমি ঠিকই পরিক্ষায় অংশ নিলাম। তবে একটি বিষয়ে পরিক্ষা দিতে পারিনি উত্তর বিশ্বনাথ স্কুলের ক্লাস নেয়াসহ অন্যান্য কাজ করতে গিয়ে’।সময় মতো রেজাল্ট প্রকাশ করা হলো। আমার ফলাফল রাখা হল স্থগিত। আমার এক সহপাঠি নবীগঞ্জ যার বাড়ি ছিল। সে তখন থাকতো সিলেট সুরমা মার্কেটের বদরুল হোটেলে ম্যানেজার রুপে।হোটেল মলিক ছিলেন তার আত্মীয়।আমাকে খবর পাঠালো রেজাল্ট দেখতে গিয়ে। খবর পেয়ে আমি চলে যাই একদিন সন্ধ্যা সাত ঘটিকার ট্রেনে সিলেট শহরে। কলেজে গিয়ে দেখতে পাই রেজাল্ট স্থগিত রাখা হয়েছে।আমি পড়ে গেলাম ভাবনায়। দাড়িয়ে আছি নোটিশ বোর্ডের সম্মুখে। এমন সময় ক্লাস শেষ করে শিক্ষা গুরু শ্রদ্ধেয় বিজিত কুমার দাস আসছেন অফিসে। আমাকে দেখে জিজ্ঞাসিলেন, চেহারা মলিনের কারন। আমি আদ্যপান্ত তিনির কাছে করলাম উপস্থাপন।তিনি দু’মিনিট সময় দিতে বললেন। আমি দাড়িয়ে রইলাম।অফিসে ঢুকে তিনির কাজ সমাপনান্তে আমাকে ডাকলেন হাত ইশারায় প্রিন্সিপালের রুমে ঢুকতে।আমি রুমে ঢুকতে যাব। এমন সময় প্রিন্সিপাল আমাকে দেখেই কডা নির্দেশে বারণ করলেন ঢুকতে।বিজিত স্যার প্রিন্সিপালকে শুধালেন, স্যার ছাত্র আমাদের। ওরা ভুল করবে। আমরাতো আবার ক্ষমাও করতে হবে।ওর অপরাধটুকু কি ক্ষমা করা যায়না?তাৎক্ষণিক প্রিন্সিপাল স্যার রেজাল্টশীট বের করে দেখালেন আমার ফলাফল। একটি বিষয় পরিক্ষা না দেবার কারনসহ বকেয়া অপরিশোধের অপরাধ।আমি নিলাম মিথ্যার আশ্রয়। উপস্থাপন করলাম একটি বিষয়ের পরিক্ষা না দেবার যৌক্তিকতা হিসাবে রোগাক্রান্তের কথা।সাথে ডাক্তারের একটি দেয়া কাগজ। যা আমি পূর্বেই সংগ্রহ করেছি আমার আরেক শিক্ষাগুরু জনাব গোলাম মস্তফা মানিক মিয়ার স্যারের মাধ্যমে।এই স্যার হচেছন উত্তর বিশ্বনাথ স্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক ঘাসিগাঁও নিবাসী। তিনি তখন ষ্টেশন রোড়স্থ অগ্রণী ব্যাংকের ক্যাশিয়ার রুপে ছিলেন কর্মরত।পঞ্চাশ টাকা দিয়ে যা সংগৃহিত ছিল।প্রিন্সিপাল ধমকের সুরে বললেন, কেন মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছ।সত্য বল এবং এ কাগজ কত টাকায় সংগ্রহ করেছ।আমি সব সত্য প্রকাশ এবং এ বইটি সংগ্রহ করার অক্ষমতা স্বীকার করে নেই।তখন উভয় স্যার মনোযোগ দেন আমার রেজাল্টশীটের দিকে।স্পষ্টত: দৃশ্যমান হয় আমি ষাটের উপরে চারটি বিষয়ে নম্বর প্রাপ্ত হয়েছি। আমার মুল অপরাধ বকেয়া টাকা প্রদান না করা।বিজিত স্যার আমার জন্য সুপারিশ করে চলেছেন। এখন আমার করনীয় নিয়ে। প্রিন্সিপাল বললেন, যদি সে এ মুহুর্তে টাকা প্রদান করে রসিদ নিয়ে আসতে পারে।তবে তাকে পরিক্ষায় প্রেরণ বা অংশ গ্রহণ করার সুযোগ দিতে পারি। আমি সুযোগ তখনই গ্রহণ করি। যেহেতু সে টাকা আমার সাথে সকল সময় আমি সংগৃহিত করে রেখেছি পূর্ব থেকেই। আমি টাকা প্রদান করিনি এ ভেবে যদি ফেল করি, তবে আমার টাকাটা চলে যাবে ভেবে।রসিদ নিয়ে আসলাম।স্যারদ্বয়কে প্রদর্শিত করলাম। অংশ গ্রহণের সুযোগ আমার ভাগ্যে জুটে গেল।উভয় স্যার আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনার অভয়বাণী শুনালেন, উপদেশ প্রদান করলেন। মন দিয়ে লেখাপড়া কর। আমরা আশাবাদী সফলতা তোর জীবনে আসবে।মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া এবং উভয় স্যারের আশির্বাদ নিয়ে গাড়ি চালালাম সামনের দিকে গন্তব্যে পৌছার স্বপ্ন সাধনাকে সম্ভল করে।

Manual5 Ad Code

এ সময় উত্তর বিশ্বনাথ স্কুলে আরেকজন শিক্ষক ছিলেন আমার সহপাঠি একই বিভাগে মানে গ্রুপে।তিনি ছয় মাস প্রাইভেট পড়েছেন।ফাইনাল পরিক্ষার জন্য তিনি স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছেন পুরো দুই মাসের। আর আমি প্রাইভেট পড়াতো দুরের কথা।পরিক্ষার জন্য ছুটি নিয়েছি যে দশদিন দশ সাবজেক্টের পরিক্ষা ছিল সে নির্ধারিত দিনই।স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটুক তা চাইনি। লেখাপড়ার মান বৃদ্ধি, সফলতা সার্বিক অগ্রগতিই ছিল আমার মুল লক্ষ্য।যা জানেন শুধু সেই মহান সত্ত্বা যিনি অন্তর্যামী ও সে সময়ের ছাত্র, শিক্ষক, এলাকাবাসী।ডিগ্রি ফাইনাল পরিক্ষার রেজাল্ট হল প্রকাশিত। আমি রেজাল্ট দেখতে যাই না।মনে দ্বিধা,দ্বন্ধ পাশ করতে পারব কি না, দেখে কি লাভ সেই মানসিকতায়? পাঁচ দিন অতিবাহিত ফলাফল প্রকাশের। আমি জানি, তারপরও না জানার ভানে আছি মত্ত।এদিকে আমি সবাইকে ভুল নম্বর দিয়ে রেখেছি।আমার প্রাণপ্রিয় শিক্ষাগুরু কিরণ স্যার আমাকে তাগাদা দিচ্ছেন ফলাফল জানতে, জানাতে। যাচ্ছি যাবো করেই করছি সময়ক্ষেপন।পাঁচ দিনের মত সময় অতিক্রান্তে আমার একান্ত শুভাকাঙ্খিজন আমাকে জোর করে পাঠান রেজাল্ট দেখে আসতে।আমি অত্যন্ত সতর্কতার সহিত গোপনীয়তা বজায় রেখে ঐদিন সন্ধ্যার ট্রেনে রওয়ানা দেই সিলেট অভিমুখে।চলে যাই সোজা কলেজে।ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন বলতেই হয়। না চাহিতে বৃষ্টিসম।প্রথমেই পেয়ে যাই স্যার বিজিত কুমার দাসের সাক্ষাৎ।তিনি অতি উদগ্রীবতায় শুধালেন, মিজান কি খবর তোমার?প্রত্যুত্তরে জানালাম, স্যার আজো জানা হয়নি খবর। এ মাত্র আমার আগমণ কলেজ প্রাঙ্গনে জানার একটু প্রত্যাশায়।ছোঁ-মেরে স্যার আমার হাতটি ধরে নিয়ে রওয়ানা হলেন প্রিন্সিপালের রুমে। প্রিন্সিপাল দেখেই বিজিত স্যারের অনুরুপ আমার খবর জানার উৎসুখ্যতা প্রকাশ করলেন। একই জবাব আমার।বিজিত স্যার ফলাফল শীট বের করে দেখতে লাগলেন। স্যার বললেন, পাশ করেছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না।আমি বিনয়ের সহিত স্যারকে শুধাই। স্যার আমার মার্কশীট দেখতে চাই। স্যার দেখালেন। তখন বিশ্বাস হল।প্রিন্সিপাল শুনে কাছে ডেকে নিলেন, আদর করলেন, আশির্বাদ দিলেন।অনুরুপ বিজিত স্যার অত্যন্ত আনন্দ, আহলাদে বিদায় দিলেন, বিদায় নিলাম। এখন আমার মনের অবস্তা কেমন পাঠক সহজে আপনাদের অনুমেয়।রওয়ানা দিলাম পায়ে হেঁটে রেলষ্টেশন অভিমুখে রাত দশটার ট্রেনে বাড়ি আসার স্বপ্ন নিয়ে।সুরমা মার্কেটের কাছে আসতেই হোটেল থেকে পরিচিতজনের কণ্ঠের আওয়াজ পেলাম আমাকে ডাকার।তাকিয়ে দেখি সম্মুখে দন্ডায়মান আবুল কাহির। ততক্ষনে তিনি এসে হাজির সম্মুখে।আমি স্তম্ভিত। এ সময় এখানে থাকার কথা নয় ভেবে।কাহির শুধালেন, হোটেলে বসা কিরন স্যার তোমার জন্য অপেক্ষমান।আমি দ্রুত চলে যাই স্যারের নিকটে। পাশ করেছি শুনে স্যারের কি যে আনন্দ, তা প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই।মিষ্টির অর্ডার করলেন স্যার।পরে বলতে লাগলেন, মিজান তোমার রেজাল্ট জানার জন্য আজ দুদিন যাবত স্কুল ছুটি দিয়ে তুমি যাও বাড়ি অভিমুখে আর আমি ছুটে আসি এ হোটেলে তোমার সুখবর জানার উদগ্র বাসনায়।তুমিতো আসনা।তবে আশাবাদী হয়ে বসে থাকি, তুমি আসবে, তুমি জানাবে। এ বিশ্বাস ও আমার দৃঢ়।আমার মিজান না এসে পারে না, পারবে না।তোমার দৈন্যতা বুঝি বলেই নিরবে খুজি, স্বপ্ন দেখি। আমার স্বপ্ন সার্থক, বৃথা যেতে পারে না।তোমার শ্রম, তোমার স্বপ্ন, তোমার সাধনা।অবশেষে শুধালেন আমাদের স্কুলের অন্য শিক্ষকের ফলাফলের কথা। আমি যখন জানালাম ব্যর্থতার কথা। তখন কারো মুখে ছিল না ভাষা।সবাই মহাচিন্তিত।ভীষণ দু:খিত, মর্মাহত।অত:পর বিদায় নিলাম। স্যার ও আবুল কাহির চলে গেলেন স্যারের বাসায়। আমি ট্রেন চড়ে বাড়ি।পরম করুনাময় মহান আল্লাহর কি শুকরিয়া আমি আদায় করব।আমি অজানা, অচেনা এক নগন্য বান্দা।আল্লাহ তোমার রহমত দিয়ে শুকরিয়া আদায়ের পথ বাতলে দাও, শিখিয়ে দাও।এইতো আমার সকল চাওয়া-পাওয়া।কেন আমার শিক্ষকবৃন্দ আমায় এতো ভালবাসেন, বাসলেন।তার প্রতিদান বিন্দু পরিমাণ দেবার যে আমার অক্ষমতা।তবে হে আছে আমার ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালবাসা।জানাবার শুধু অক্ষমতা।আল্লাহ তুমি রহমান রহিম। তুমিই সকল কিছুর অন্তর্যামী।(চলবে)

Manual1 Ad Code

লেখক: সাবেক সভাপতি বিশ্বনাথ প্রেসক্লাব, বিশ্বনাথ, সিলেট।

Manual3 Ad Code

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code