প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-৩৬

  |  ১৪:১৬, জুলাই ১৭, ২০২০
www.adarshabarta.com

Manual6 Ad Code

‘ওয়াইফ সিরিয়াস কাম শার্প’ ছিল আগের দিনের বিলাত প্রবাসীদের কাছে একটি অতি পরিচিত বার্তা

Manual4 Ad Code

:: মো. রহমত আলী ::

‘ওয়াইফ সিরিয়াস কাম শার্প’ -এ শব্দটি অন্যান্যের বেলায় যা হোক, আমাদের পূর্ব পুরুষ বিলাত প্রবাসীদের কাছে তা ছিল অত্যন্ত পরিচিত। ‘বিলাত’ হলো বাঙালীদের কাছে যুক্তরাজ্যের একটি আদি নাম। তখন সিলেট অঞ্চলের যারা ছিলেন তারা এ শব্দটিই বেশী ব্যবহার করতেন। এখন অবশ্য এটা তেমন ব্যবহার হতে দেখা যায় না। তবে আরো একটি শব্দ খুব বেশী আগেও ব্যবহার হতো এবং এখনও ব্যবরূত হয়। সেটা যদিও ইংল্যান্ডের রাজধানী কিন্তু তার মাধ্যমে সমগ্র বৃটেনকেই বুঝানোর প্রয়াস চালানো হয়। তা হচ্ছে, লন্ডন।
সে যাই হোক। ‘ওয়াইফ সিরিয়াস কাম শার্প’ এটি যদিও বাংলা বর্ণে উচ্চরণ করা হয়েছে তবুও তা ‘ইংরেজি শব্দ’। এর মানে ‘স্ত্রী সংকটাপন্ন তাড়াতাড়ি আস’। এ শব্দ যখন ব্যবহার করা হয় তখন বুঝা যায় যে, স্বামী বেচারা স্ত্রীর কাছে নন। তিনি দূরে কোথাও আছেন। সেটা হতে পারে দেশের মধ্যে অথবা দেশের বাইরে। আর এর মাধ্যমে তাকে তাড়াতাড়ি চলে আসার কথাই গুরুত্বের সাথে বলা হচ্ছে।
অনেকেই জানেন, যুক্তরাজ্যে আমাদের যারা পূর্বসুরি তারা একসময় পরিবার-পরিজন ছাড়া একাকী বসবাস করতেন। তখন তারা কয়েক বছর পর দেশে যেতেন আবার চলে আসতেন। তবে কোন কোন সময় অনেকের দেশে যাওয়ার জন্য জরুরী প্রয়োজন পড়তো। তখন দেশে যাওয়ার জন্য তাদের নিয়োগ কর্তার কাছে তাৎক্ষনিক অবস্থা বর্ননা করলে হয়তো ছুটি মঞ্জুর হতো অথবা হতো না। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে যেতে হলে তাদেকে এর কারণ দেখাতে হতো। কিন্তু সেটা মূখে বললে তারা গ্রহন করতো না সেটা ডকুমেন্টসহ দেখাতে হতো। আর এই ডকোমেন্টের মাধ্যম ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে ‘চিটি পত্র’ আর জরুরী হলে ‘টেলিগ্রাম’। তবে সব টেলিগ্রাম আবার গ্রহনযোগ্য হতো না। ‘মাদার সিরিয়াস’ ‘ফাদার সিরিয়াস’ বা অন্য কেউ ‘সিরিয়াস হলে তা খুব গুরুত্ব দেয়া হতো না। কিন্তু ‘ওয়াইফ সিরিয়াস’ হলে তা সাথে সাথে মঞ্জুর করা হতো। তাই এভাবে দেশ থেকে টেলিগ্রাম পাঠানো হতো। টেলিগ্রামের বার্তাটি বাস্তবে সত্য হলেতো কথাই নেই কিন্তু অনেক সময় প্রবাসী এ টেলিগ্রাম পেয়ে দেশে গিয়ে দেখতে পেতেন তার স্ত্রী বহাল তবিয়তেই আছেন। সংসারের কাজকর্মও রীতিমত করে যাচ্ছেন।

আজকাল হয়তো বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তির কারণে অনেকে টেলিগ্রামের কথা ভুলেই গেছেন অথবা কেউ কেউ আদৌ চিনেন না। সেকালে মানুষের জরুরি যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল টেলিগ্রাম। আর টেলিগ্রাফ যন্ত্রের মাধ্যমেই পাঠানো হতো টেলিগ্রাম। টরেটক্কা করে খবর পৌঁছে যেত উদ্দীষ্ট ব্যক্তির কাছে। টেলিগ্রাম তো জীবনের আবেগময় এক অনুষঙ্গ ছিল। টেলিগ্রাম আমাদের হাসিয়েছে, কাঁদিয়েছে, আনন্দের বার্তা এনে দিয়েছে, শোক-বিহ্বল করেছে। কী অসাধারণ প্রভাব ছিল এই টেলিগ্রামের। চার থেকে বড়জোর আটটি শব্দের টেলিগ্রাম বার্তা, তাতেই অনেক কিছু বলা হতো। বোঝা যেত অনেক কিছু। শব্দ গুনে হিসাব করা হতো টেলিগ্রামের মাশুল।
এ টেলিগ্রাম নিয়ে অনেক কথা রয়েছে। এই টেলিগ্রামের সংক্ষিপ্ত বার্তা নিয়ে কত যে রসিকতা, কত যে কান্ড ঘটেছে, তার ইয়ত্তা নেই। টেলিগ্রাম নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা রকমের চুটকি গল্প। ‘কাম শার্প’ বলা হলেও কথাটি যে কতজনের মুখে ‘কাম সারা’ হয়ে গেছে, তারও কোনো হিসাব নেই।
টেলিগ্রামের ভাষার এ সংক্ষিপ্তা নিয়ে মজার মন্তব্য পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রে। ছিন্নপত্র-এর এক পত্রে তিনি লিখছেন, ‘আজ তোর কাছ থেকে টেলিগ্রাম পেলুম যে: ‘Missing gown lying post office’। এর এক অর্থ হচ্ছে হারানো গাত্রবস্ত্র ডাকঘরে শুয়ে আছেন। আরেক অর্থ হচ্ছে, গাউনটা মিসিং এবং পোস্ট অফিসটা লাইয়িং। রবীন্দ্র-রসিকতা অথবা টেলিগ্রামের প্রতি রবীন্দ্রনাথের অনাসক্তির বিবরণও পাওয়া যায় একই পত্রে। তিনি লিখছেন, ‘আর তারে চড়ে টেলিগ্রাফ এলেন, কোথাও পথশ্রমের কোনো চিহ্ন নেই, হড়বড় তড়বড় করে যে দ’ুটো বললেন…তার মধ্যে ব্যাকরণ নেই, ভদ্রতা নেই, কিছু নেই, একটা সম্বোধন নেই, একটা বিদায়ের শিষ্টতা নেই…কেবল কোনোমতে তাড়াতাড়ি কথাটা যেমন-তেমন করে বলে ফেলে দায় কাটিয়ে চলে যেতে পারলে বাঁচে। টেলিগ্রামের কথা অনেক গানেও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, “নাইরে পিয়ন, নাই টেলিগ্রাম; বন্ধুর কাছে মনের খবর কেমনে পৌঁছাইতাম”।
টেলিগ্রামের যে ফরম, সেটা পূরণ করা ছিল মহা এক ঝামেলার ব্যাপার। ফরমের একটা ঘরে একটা শব্দ, এক ঘর থেকে আরেক ঘরে গেলেই বিপদ। ফরম বাতিল হয়ে যেত। বড় হাতের ইংরেজিতে পূরণ করতে হতো টেলিগ্রাম করার ফরম। ছোটবেলায় ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারকে আমরা বলতাম বড় হাতের ইংরেজি। আর এ ক্যাপিটাল লেটারে টেলিগ্রাম ফরম একবারে পূরণ করতে পেরেছেন এমন প্রতিভাবান মানুষের তখন সাক্ষাৎ পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। প্রায় প্রত্যেকেরই ক্যাপিটাল আর স্মল লেটারে জট পাকিয়ে যেত। জট ছাড়াতে গেলেই বাতিল হয়ে যেত ফরম। এ রকমটা যে ঘটবে, এমন কথা ভেবেই হয়তো টেলিগ্রাম ফরম কাঠের একটা ট্রেতে পাবলিকের জন্য রাখা হতো। তাই বারবার চাইতে হতো না।
টেলিগ্রাফের যন্ত্রটি পিতলের নানা আকারের ছোট-বড় পাতে তৈরি। ওপরে একটা চওড়া পাত ঢেঁকির মতো ওঠানামা করছে বিরামহীনভাবে। সেটারই সামনেটা বোতমের মতো গোলাকার। আমরা দেখতান পোস্টমাস্টারগন মাঝেমধ্যে এসে সেটা টিপছেন আবার কান পেতে শব্দ শুনছেন। মনে পড়ে, রেলস্টেশনের টেলিগ্রাফ যন্ত্র অবিরাম ধ্বনি তৈরি করে যেত। ধ্বনিগুলো আমরা শুনতাম যেভাবে মাস্টার সাহেবগন শুনতেন অন্যভাবে। আমাদের কাছে সবগুলি শব্দই একিভাবে মনে হতো। কেবল পোস্ট মাস্টার সাহেবই বোঝেন এ ভাষা।
রেলের টেলিগ্রাফ ছিল শুধু রেলের জন্যই। আর পোস্ট অফিসের টেলিগ্রাম ছিল পোস্ট অফিসের জন্যে। টেলিগ্রাফের ধ্বনি শুনে পোস্ট মাস্টার একটা একটা করে শব্দ লিখতেন। এরপর প্রাপকের কাছে তা ইনভেলপে করে পাঠানো হতো। কখনো তা পোস্টে আবার দূববর্তী হলে ডাক যোগে। আর ডাকযোগে হলে সেটি তখন আর জরুরী থাকতো না অন্য চিটির মতো অর্ডিনারী হয়ে যেত।
তবে টেলিগ্রাম প্রাপকের কাছে পৌঁছানো হতোই। এ বার্তাটি আনন্দের হতো বা শোকেরও হতো। আমি ছোটবেলা থেকেই বিলাত প্রবাসীদের সাথে আদান প্রদানকৃত টেলিগ্রাফে খুব কমই খুশির সংবাদ দেখেছি। এরপর যখন হাইস্কুলে লেখাপড়া করি তখন আমাদের এলাকায় আমরা দ’ুজন ছিলাম টেলিগ্রাফ পড়ার মানুষ। একজন ছিলেন আমাদের হাইস্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মরহুম মখলিছুর রহমান ও আমি। তবে আমি অনেক জটিল টেলিগ্রাফ বুঝতাম না। একবার আমার এক আত্মীয় আমার কাছে একটি টেলিগ্রাফের বার্তা নিয়ে আসলেন। আমি তখন তা পড়ে বুঝতে পারলেও তাকে সাথে সাথে বলতে পারলাম না। কারণ তিনি যেভাবে হাসি-খুশি অবস্থায় আমার কাছে এসেছিলেন সে অবস্থায় এটা বলতে আমি সাহস পাচ্ছিলাম না। তখন তিনি বিরক্ত হয়ে আমাকে কিছু ধমক দিয়ে ও সাথে সাথে তাচ্ছিল্য করে চলে গেলেন। এর পর তিনি অন্য কারো কাছে চলে যান। এ বার্তাটিতে, যুক্তরাজ্য প্রবাসী তার আপন ভাইয়ের লাশ গ্রহনের জন্য তাকে নির্ধারিত তারিখে ইয়ারপোর্ট যাওয়ার কথা উল্লেখ ছিল।
এই টেলিগ্রাসের সূচনালগ্নে ট্রেন যোগাযোগের জন্য টেলিগ্রামে প্রথম বার্তা প্রেরণ করে বিশ্বে মহা হইচই ফেলে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। টেলিগ্রাম আবিষ্কার হয় ১৮৩০-এর দশকে। যন্ত্রটির প্রাথমিক সংস্করণ তৈরি করেন ব্রিটিশ নাগরিক ব্যারন শিলিং ভন। তবে আবিষ্কারক হিসেবে বিশ্ব চেনে মার্কিন বিজ্ঞানী স্যামুয়েল মোর্সকে। তিনিই ১৮৩৭ সালে পূর্ণাঙ্গ টেলিগ্রাম আবিষ্কার করেন এবং এর কয়েক বছর পর ১৮৪৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে টেলিগ্রাম পাঠান যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন থেকে বাল্টিমোরে। এরও দুই বছর পর ১৮৪৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম লাইন চালু হয় বেলজিয়ামে। এরপর যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে এটি। ১৯২৯ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০ কোটি টেলিগ্রামের আদান-প্রদান হয়। আবিষ্কারক দেশ বৃটেন টেলিগ্রামের ব্যবহার বন্ধ করেছে ১৯৮২ সালে। এরপর ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং একসময়ে ভারতও ২০১৩ সালে বন্ধ করে দেয় এই সেবা। আর বাংলাদেশে তা এখনও চালু রয়েছে কি না আমার জানা নেই। (চলবে)।

Manual3 Ad Code

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com

Manual4 Ad Code

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code