প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-৩১

  |  ১৬:৪৯, জুলাই ১২, ২০২০
www.adarshabarta.com

Manual8 Ad Code

নামের বাহার যেখানে যেমন

:: মো. রহমত আলী ::

Manual5 Ad Code

মানুষের নাম একবারই রাখা হয়। আর এ নামটি সারা জীবন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ধারণ করে চলতে হয়। কোন বিশেষ কারণে তা পরিবর্তন হলেও পরবর্তীতে মূল নাম তাদের ডাকনাম হিসাবেই পরিগণিত হয়। তবে কোন কোন সময় পূর্বের নাম ও পরিবর্তিত নাম একত্রিত করেও চালিয়ে দেয়া হয়। যেমন আমাদের যুক্তরাজ্যের একজন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার নাম ছিল ‘আব্দুল মন্নান’। পরে তাঁর সে নামের সাথে যুক্ত হয় ‘ছুরাব আলী’। তখন একটি নামকে প্রধান্য না দিয়ে উভয় নামের সংমিশ্রনে রাখা হয় “আব্দুল মন্নান ছুরাব আলী”। সেভাবে একজন কমিউনিটি ও রাজনৈতিক নেতার নাম “আব্দুল গাফফার নছির মিয়া”, একজন শিক্ষকের নাম “আফজল হোসেন সিদ্দিক মিয়া” প্রমূখ। আবার কেউ কেউ নতুন নামের সাথে পূর্বের অংশের একটি অংশ যোগ করে পুর্ণ নাম রেখে থাকেন। যেমন, ‘কয়েছ আলী’ থেকে জাকির হোসেন কয়েছ, ‘কামাল মিয়া’ থেকে কামাল হোসেন প্রভৃতি। আমার এক পরিচিত প্রবাসী বেশ কয়েকবার তার নাম পরিবর্তন করেছিলেন। তিনি যেন কোন নামেই স্ব¯িত পাচ্ছিলেন না। মুল নাম ছিল, ‘ইসমাইল আলী’। এরপর প্রথম অংশ আগে ও পরের অংশ আগে এনে করলেন ‘আলী ইসমাইল’। কিন্তু সেটাও তার মনপ্লোত হলো না। পরবর্তীতে রাখলেন, ‘ইসমাইল আলী ইসমাইল’। যেভাবে অনেক রাজনৈতিক নেতা তাদের নামকে লম্বা করতে ভালবাসেন।
শুনেছি চিন দেশে নাকি মানুষের নাম তিনবার রাখা হয়। জন্মের সময় একবার পিতামাতার দেয়া নাম। মধ্য বয়েসে একবার নিজের পছন্দমত নাম এবং বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর সংমিশ্রনের নাম আরেক বার। মধ্যপ্রাচ্যে আবার আদিপুরুষের নামের ‘অংশ বিশেষ’ বংশ পরম্পরায় চালানোর রেওয়াজ থাকতে দেখা যায়। অবশ্য বংশের কোন খান্দানী উপাধী থাকলে তা সেই বংশের লোকদের নামের সাথে যুক্ত হয়। এটা মূল নাম নয়। এটা তাদের বংশ পরিচয়ের প্রতিক। যেমন চৌধুরী, খান, সৈয়দ, পাটোয়ারী ইত্যাদি।
নামের কিন্তু বিভিন্ন রকম কেরামতি রয়েছে। এ নামের কারণে অনেক লোক ভাল অবস্থানে পৌছায় বা মর্যাদা পায়। আবার কেউ কেউ এ নামের কারণে তেমন গুরুত্ব পায় না। মনে হয় যেন সে খুবই নগন্য। তাই প্রত্যেক পিতা-মাতার উচিত সন্তান জন্মের পর একটি সুন্দর ও অর্থপূর্ণ নাম যেন তার জন্য রাখা হয়। তা না হলে সন্তান সারা জীবনের জন্য বিকৃত বা অসম্পুর্ণ নামের খেসারৎ দিয়ে পিতামাতাকে এর জন্য দায়ি করবে।
এদিকে একটি ভাল নাম হলে বা একজন খ্যাতিমান মানুষ হলে তাকে ঘিরে অনেকেই পরিচিতি পেতে চায়। তিনি আত্মীয় না হলেও আত্মীয়, দূরসম্পর্কের হলেও ঘনিষ্ট সম্পর্কে চলে আসে। যেমন আমার নিজের কথা দিয়েই উদাহরণ শুরু করি। আমার নাম ‘রহমত আলী’। আমি যখন দেশে যাই তখন কেউ কেউ আমাকে ব্রিটিশ এমপি ‘রুশনারা আলী’র’ আত্মীয় বলে মনে করেন। কারণ আমাদের উভয়ের নামটি অনেকটা সমপর্যায়ের এবং আদি বাড়িও সিলেটের বিশ^নাথ উপজেলায়। আমি তখন মৌনতা অবলম্বন করলে সে কথাই সঠিক হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে আমি আমার অন্য একটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করছি। সিলেটের রাগিব আলী সাহেব দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যে ছিলেন। একবার পূর্ব লন্ডনের বাঙালীর নামে প্রতিষ্ঠিত ইংরেজ শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত একটি স্কুলে তাকে আমন্ত্রন জানানো হয়েছিল। আমাকেও সেখানে সাংবাদিক হিসাবে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হয়। আমি যথাসময়ে স্কুলে পৌছি ও আমার নাম বলার পর তারা চা নাস্তাসহ যথাযথ আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে। আমিও তৃপ্তিসহকালে তা উপভোগ করি। এ পর্বটি যখন শেষ হতে যাচ্ছিল তখন রাগিব আলী সাহেব উপস্থিত হলেন ও তার পরিচয় তুলে ধরলেন। সাথে সাথে তার বিলম্বের জন্যেও দৃঃখ প্রকাশ করেন। তখন সেই শিক্ষকবৃন্দ একবার আমার দিকে ও আরেকবার তিনির দিকে দৃস্টি দিতে থাকে। আমি বিষয়টি প্রথমে অনুধাবন করতে না পারলেও পরে বুঝতে পারলাম। ‘ডালমে কুচ কালা হ্যায়’। অর্থাৎ প্রথমে আমি এসে যখন আমার নাম ‘রহমত আলী’ বলি তখন তারা ‘আমাকে রাগিব আলী’ মনে করেছে। কারণ তারা বাংলায় নামের এ সামান্য পার্থক্য খুব সহজে অনুধাবন করতে পারে নাই। এর পরে যখন আসল রাগিব আলী আসলেন তখন সেটা ধরা পড়েছে। তবে তারা অবশ্য তাদের ভুলটি তখন বুঝতে পেরেছে ও তখন থেকে আমাদের প্রতি যথাযোগ্য মর্যদা প্রদর্শন করেছে।
একবার একজন প্রবাসী দেশে আত্মীয়তার জন্য আলাপ শুরু করেন। এক পর্যায়ে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির বংশের পাত্রের সাথে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব আসে। উক্ত প্রবাসী খুব আনন্দের সাথে সে প্রস্তাব গ্রহণ করে আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে বিয়ের দিন-তারিখ পর্যন্ত ঠিক করে ফেলেন। কিন্তু দেশে যাওয়ার পর দেখেন ব্যক্তির নাম ঠিক আছে বটে তবে তিনি যাকে ধারণা করেছিলেন ‘এই ব্যক্তি সেই ব্যক্তি নন’। এ নিয়ে উপস্থিত সময়ে কিছুটা মতবিরোধ হয়েছিল বটে তবে শেষ পর্যন্ত সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। তাই দেশে-বিদেশে বিয়ে-সাদীর ব্যাপারে কেউ কোন প্রস্তাব নিয়ে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে আরো ভালভাবে জেনে-শুনে দিনক্ষণ ঠিক করা উচিত।
নামের উচ্চারণের মধ্যেও অনেকটা লুকোচুরি সৃষ্টি হয়। যেমন একবার দেশের একটি কলেজের প্রিন্সিপাল যুক্তরাজ্য সফরে আসেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তিনি বক্তব্যও প্রদান করেন। একটি সমাবেশে উপস্থাপক তার পরিচয় জানাতে গিয়ে কুলাউড়া কলেজের প্রিন্সিপাল বলে পরিচয় দিয়ে দেন। প্রিন্সিপালও বক্তব্য দিয়ে শেষ করে ফেলেন। পরে জানা যায় যে, তিনি ‘কুলাউড়া কলেজের’ প্রিন্সিপাল নন। আসলে তিনি ‘কুড়ার বাজার’ কলেজের প্রিন্সিপাল। আর প্রিন্সিপাল তখন কেন মৌনতা অবলম্বন করেছিলেন সেটাও অবশ্য সহজেই বোধগম্য।
সমান আকারের নাম থাকলেও বিভিন্ন সময় মানুষের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। পেশাগতভাবে হয়তো তারা দুই ধারার লোক কিন্তু নামে তারা এক। তাই প্রকৃতপক্ষে পেশাগতভাবে তাকে খুঁজে বের করে নেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দেশের একজন প্রয়াত রাজনীতিবিদের নাম ‘পীর হবিবুর রহমান’। কিন্তু সাংবাদিক হিসাবেও দেশে ইতোমধ্যে যিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন তার নামও ‘পীর হাবিবুর রহমান’। প্রয়াত স্পিকার হুমায়ূন রশিদ চৌধুরীর নামেও দৈনিক ইত্তেফাকের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেছেন যিনি তার নামও ‘হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী’। সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক দুই সভাপতির নাম যদিও পুর্ণভাবে এক নয় তবুও উভয়কে সবাই ‘নুর ভাই’ হিসাবে সম্বোধন করে থাকেন। নামের একটি বর্ণের পার্থক্য হলেও অনেক সময় একজনের প্রসঙ্গ এলে অন্যজনের কথা অনেকে বুঝে ফেলেন। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে সাংবাদিকতার সাথে জড়িত রয়েছেন এমন দ‘ুজন হচ্ছেন, সাঈদ চৌধুরী ও সাইম চৌধুরী।
সিলেটে একটি এলাকার নাম ‘ঢাকা দক্ষিণ’। আমি ছোটবেলা মনে করতাম এটা বোধ হয় রাজধানী ঢাকার দক্ষিনে অবস্থিত। পরে অবশ্য জানতে পারি যে এটা সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। এভাবে উত্তর বিশ^নাথ কলেজের নামকরণ হয়েছে। যদিও তা উপজেলা সদর থেকে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত।
মানুষের নামের মধ্যে যদি দু‘জন একই নামের অধিকারী হয়ে থাকেন তবে তাদের পরিচিতির জন্য বিশেষ বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়ে থাকে। যেমন, একই নামের দু‘জনের মধ্যে যদি একজন স্বাস্থ্যবান হন আর অন্য জন হালকা হন তবে একজনকে ‘মোটা’, অন্যজনকে ‘চিকন’। একজন যদি লম্বা হন আর অন্যজন খাটো হন তবে সেভাবে, আবার একজন যদি ফর্সা থাকেন আর অন্যজন কালো থাকেন তবে তাদের সে রং অনুযায়ীই সম্বোধন করা হয়ে থাকে।
এদিকে আবার নামের যথার্থতাও অনেকে ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। যেমন একটি গানে আছে ‘রাজা নেই শাহী নেই ‘রাজশাহী’ নাম। হাতি নেই তবুও ‘হাতিশালা’ নাম, ঘোড়া না থাকলেও ‘ঘোড়া শাল’ হয় ইত্যাদি। (চলবে)।

Manual8 Ad Code

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com

Manual2 Ad Code

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code