প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-১০

  |  ১৫:৫৪, জুন ১১, ২০২০
www.adarshabarta.com

বাংলাদেশের কয়েকজন স্পীকারের সাথে স্মৃতিকথা

:: মোঃ রহমত আলী ::

যে কোন স্পীকার হলেন সে সংসদের অভিবাবক। তাঁর সভাপতিত্বে পার্লামেন্টের সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সংসদ অধিবেশনের কাজকর্ম পরিচালিত হয়। তিনি সভার নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষা করেন। কোনো সদস্য নিয়মবহির্ভূত আচরণ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। তিনি অনাস্থা প্রস্তাব, মুলতবি প্রস্তাব, নিন্দা প্রস্তাব ও দৃষ্টি-আকর্ষণীসহ বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপনের অনুমতি দেন। বিভিন্ন অধিবেশনে কি কি আলোচনা হবে তাও নির্ধারণ করে দেন।

এদিকে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে অথবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে ক্ষেত্রমতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত যদি উপরাষ্ট্রপতির পদ বিরাজমান না থাকে তবে স্পীকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করে থাকেন। অন্যদিকে স্পীকারের অবর্তমানে ডেপুটি স্পীকার, প্যানেল স্পীকার অথবা যে কোন জৈষ্ঠ সংসদ সদস্য স্পীকারের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এডভোকেট আব্দুল হামিদ ২০০৯ সালের জানুয়ারী থেকে ২০১৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তখন তিনি অনেকবার যুক্তরাজ্য সফর করেন। তার মধ্যে একবার যুক্তরাজ্য সফরকালীন তিনি লন্ডনের সাপ্তাহিক জনমত অফিস পরিদর্শন করেন। আর তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। এটা কোন আনুষ্ঠানিক সভা ছিল না, তাই আমরা সবাই তিনির সাথে খোলামেলাভাবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনার সূযোগ পাই। এ সময় প্রথমে তিনি জানতে চান এখানে কতটি বাংলা পত্র-পত্রিকা আছে এবং এগুলির পাঠক সংখ্যা কেমন। সাথে সাথে এদেশের নতুন প্রজন্ম বাংলা চর্চায় কতটুকু উৎসাহিত বোধ করে, এসব ব্যপারেও আলোচনা হয়। আমার স্মরণ আছে তিনি তখন খুবই হাসি-খুশি ও রসিকতা করে কথাবার্তা বলছিলেন। স্বল্প পরিসরে সবাই বসে তখন তাঁর সাথে খুবই আন্তরিক পরিবেশে আলাপ আলোচনা করছিলাম।

আমার কাছে তখন মনে হয়নি যে, তিনি জাতীয় সংসদের মত একটি মহান প্রতিষ্ঠানের স্পীকার এবং তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় দেশের আইন প্রণেতাদের উত্তেজনাপূর্ব অধ্যায়গুলি। আস্তে আস্তে যখন অন্যান্য পত্রিকাগুলিতে তাঁর এ আগমনি বার্তা পৌছে তখন ক্রমান্বয়ে লোক সংখ্যা বাড়তে থাকে। তখন মনে হয়েছিল এখানে যেন একটি মিনি পার্লামেন্টের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি একের পর এক সবার পরিচয় জানতে চান। আমি পরিচয় দিতে গিয়ে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত দর্পণ ম্যাগাজিনের প্রসঙ্গ বলার পর আমার হাতে থাকা ম্যাগাজিনটির প্রতি তিনি অত্যন্ত আগ্রহ দেখালেন। আমি তখন এ সূযোগে তাঁর হাতে ম্যাগাজিনের কপি দিয়ে একটি ছবি তুলে রাখলাম। এরপর আর আমার কোন সূযোগ হয়নি তাঁর সাথে সাক্ষাতের। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগের সূযোগ না হলেও সেই ছবি দেখে এখন মনের তৃপ্তি আসে যে, যদিও তিনি তাঁর অগ্রগতির ধারায় স্পীকার থেকে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন কিন্তু ব্যক্তি মানুষ হিসাবে তো তিনি আগের মতই রয়েছেন। তাই আমিও আমার মনের ধারণাকে প্রসারিত করে বর্তমানে একজন প্রেসিডেন্টের সাথে স্মৃতিময় হয়ে আছি বলে মনে করি। তাও আবার এক মেয়াদ নয় দুই মেয়াদের সৌভাগ্যবান প্রেসিডেন্টের সাথে।

মরহুম হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী স্পীকার থাকাকালীন অনেকবার যুক্তরাজ্য সফর করেছেন। তাঁর আসা উপলক্ষে বিভিন্ন সভা সমাবেশ হলে আমি সেখানে যোগদান করতাম। এ সমস্ত সমাবেশে তিনি যখন প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করতেন তখন মনে হতো তিনি দেশের জাতীয় সংসদে সভাপতিত্ব করছেন। আর প্রবাসীরা যেন একেক জন সংসদ সদস্য। সংসদে যেভাবে এমপিগন তাদের এলাকার দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলেন, সেভাবে প্রবাসীরাও তাদের দাবী-দাওয়া নিয়ে আবেগপূর্ণ বক্তব্য রাখছেন। তাঁর গুরু গম্ভীর কথাবার্তা এবং সাবলীল বক্তব্য আমার খুব পছন্দ হতো। আমি তখন ভাবতাম বিশ্বের সর্বোচ্চ সংস্থা ‘জাতীসংঘের সাধারণ পরিষদে’ তিনি সভাপতিত্ব করেছেন সুতরাং এটা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সাথে সাথে বাংলাদেশেরও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। আর এ ধরণের সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ক’জন আছেন। সে অধিবেশনের সভাপতিদের নামের তালিকায় তাঁর নামতো চীরদিন স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।

১৯৯৬ সালে যখন ইস্টলন্ডনের শহীদ আলতাব আলী পার্কে লন্ডনের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের উদ্বোধন করা হয় তখন তিনি প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। তাই আমি যখন বিভিন্ন সময় সেখানে যাই তখন তাঁর কথা স্মরণ হয়। সাথে ষাথে কল্পনা করি তিনি হয়তো আর কোনদিন আসবেন না কিন্তু তাঁর সেই স্মৃতি অমলিন থাকবে যতদিন এ শহীদ মিনার টিকে থাকবে।

আমার মনে আছে ১৯৯৭ সালের ৮জুন স্থানীয় ওসমানী স্কুলে এক অনুষ্ঠানে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে নানা দাবী বাস্তবায়ন সম্পর্কে বলেন, এগুলি বাস্তবায়নের আমার কোন সূযোগ নাই, কারণ আমি কোন মন্ত্রি, এমপি নই। কিন্তু এগুলি বাস্তবায়নের ব্যাপারে একজন স্পীকার হিসাবে আমার প্রভাব আমি কাজে লাগাতে চেষ্ঠা করবো। সুতরাং এর বেশী কিছু আর বলতে পারবো না। তিনি ১৯৯৬ সালের জানুয়ারী থেকে ২০০১ সালের জুলাই পর্যন্ত স্পীকারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

শেখ রাজ্জাক আলী ১৯৯১ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৯৬ সালের মার্চ পর্যন্ত স্পীকার থেকে দায়িত্ব পালন শেষে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসাবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনকালীন একটি সমস্যার কথা তিনি প্রায় সময় বলতেন। আর তা হচ্ছে, তিনি স্পীকার থাকাকালীন যারা তাঁকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতেন এখানে আসার পর উল্টো তাদেরকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতে হয়। কারণ প্রটোকল অনুযায়ী দেশের মন্ত্রি, এমপি বা পদস্ত অনেকেই তাঁর বর্তমান পদমর্যদা অনুযায়ি তাঁর উপরের পর্যায়ে। এ নিয়ে প্রায়ই তাঁকে বিভ্রতকর অবস্থায় পড়তে হতো। তবে অনেক মন্ত্রি, এমপি বা কর্তাব্যক্তি সাক্ষাৎকালে প্রথমেই তাঁকে পূর্বের সম্মানজনক অবস্থার প্রেক্ষিতে তাঁকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে নিত। ফলে তিনি স্বস্তিবোধ করতেন। তিনি অত্যন্ত সহজ সরল ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। একজন সাবেক স্পীকার বা একজন হাইকমিশনার হিসাবে তাঁর মধ্যে কোন অহংকার ছিল না। আমি আমার দর্পণ ম্যাগাজিন অফিসে যতবারই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেছি তিনি তা রক্ষা করেছেন। সাথে সাথে দর্পণ ম্যাগাজিনের উত্তরোত্তন সমৃদ্ধিও কামনা করতেন।

বর্তমান স্পীকার শিরীণ শারমিন চৌধুরীর সাথে একদিন বাংলাদেশ হাইকমিশন লন্ডনে আমার দেখা হয়। তিনি এ সময় প্রটোকল অফিসার ইসমাইল হোসেন তাকে নিয়ে হাই কমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম এর রুমে আসছিলেন। আর এ সময় আমিও উপর থেকে নীচে নামছিলাম। এ অবস্থায় তাঁর সাথে দেখা হলে তিনি আমাকে উক্ত হাইকমিশনের ষ্টাফ মনে করে কোশল বার্তা জিজ্ঞেস করে বলেন, ‘আপনারা সবাই কেমন আছেন’। কাজকর্ম কিভাবে চলছে, ইত্যাদি। আমিও সাথে সাথে আমরা সবাই ভাল আছি বলে জানালাম। এ সময় তাঁকে অত্যন্ত ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাই কথা না বাড়িয়ে আমিও বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। আসার সময় ভাবলাম বাংলাদেশ হাইকমিশনের বেশ কয়েকটি ফ্লোর রয়েছে কিন্তু নাই কোন লিপ্ট সুবিধা।

সে যাই হউক, এ সময় যুক্তরাজ্য সফরে ছিলেন ‘হিউম্যান রাইটস এন্ড পীস ফর বাংলাদেশ’ এর প্রেসিডেন্ট এডভোকেট মনজিল মোরসেদ। দেখলাম, তাদের মধ্যে খুব অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। উভয়েই যুক্তরাজ্যে থাকাকালীন ফোনে প্রায় সময় আলাপ করতেন। আর আমিও তা শ্রবন করে হাইকমিশনে দেখা হওয়ার স্মৃতি স্মরণ করতাম। পরবর্তীতে তাঁকে নিয়ে আমাদের মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস এন্ড পীস ফর
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা ছিল কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে তা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি। (চলবে)।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com