প্রচ্ছদ

ঢাকায় একটা বিয়েতে

  |  ১৪:১৫, জুলাই ১০, ২০২২
www.adarshabarta.com

 

ঢাকায় একটা বিয়েতে
-জুয়েল আহ্সান কামরুল

অনেক বছর আগে। আমি টোকিও থেকে ঢাকাতে গিয়েছি। আমার এক আত্মীয়ের বিয়ে। স্থানটা ধানমণ্ডির উল্লাস কমিউনিটি সেন্টারে। সেন্টার পরিপূর্ণ অতিথি। আমার আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সকলে সেখানে। মধ্যাহ্ন ভোজনে বা পরিবেশনে ব্যস্ত আমরা। আমি মেহমানদের দেখাশুনা করছি। কোন্ খাবার নেই, কে খাননি বা কোন্ অতিথি এইমাত্র এলেন তাঁকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছি। বরযাত্রী এখনো এসে পৌঁছায়নি। অনেক বিয়েতেই দেখা যায় বরযাত্রী সময় মতো এসে পৌঁছাতে পারে না। বিয়েতে নানান ঝামেলা বেঁধে যায়। কিছু কিছু ঘনিষ্ঠ লোক থাকেন যাঁরা এটা সেটা ধরে বসে থাকেন। অর্থাৎ, ত্রুটি খুঁজে বেড়ান কিছু আত্মীয় থাকেন। বলেন- আমি বিয়েতে যাবো না। আমাকে দাওয়াত ঠিকমত দেয়নি। বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে- আমার উপদেশ বা পরামর্শ নেয়নি অথবা আমাকে অগ্রাধিকার দেয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে বেঁকে বসেন। তারপর তাঁকে আত্মীয়-স্বজনরা মিলে বিয়ের দিন সকালে কোনোভাবে রাজি করিয়ে অনুষ্ঠানে হাজির করান। এটা আমাদের দেশে চিরচেনা চিত্র। প্রতিটি বিয়েতেই কিছু না কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়। আবার তার সমাধানও মিলে দ্রুত। কদাচিৎ হয়তো সমস্যা সমস্যাই থেকে যায় বহুদিন। যাই হোক আমার আত্মীয়ের বিয়েতে এই ধরনের কোনো সমস্যাই দেখা যায়নি। তবে সেদিন যা ঘটে ছিলো তা একটু বলার চেষ্টা করছি। বরযাত্রী আসতে দেরি হচ্ছে বলে যাঁরা উপস্থিত অতিথি ছিলেন তাঁদেরকে আগে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এবং খাচ্ছেন সবাই। এমন সময় দশ/বারোজনের এক-দল অতিথি এলেন। আমি চিনি না। ভাবলাম হয়তোবা বরযাত্রীর সঙ্গের লোক, একটু আগেভাগে তাঁরা চলে এসেছেন, কিংবা আমাদেরই কারো না কারো আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধব হবেন হয়তো m। তাঁরা এসেছেন বলে আমি তাঁদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে এলাম। তাঁরা উপহারের খাতায় নাম লেখালেন। উপহার দিলেন। বেশ বড়সড় উপহার, রঙিন কাগজ দিয়ে মোড়ানো। আমি তাঁদেরকে খাবার টেবিলে নিয়ে গেলাম। যাঁরা খাবার পরিবেশন করছিলেন তাঁদেরকে বললাম- একটু খেয়াল রাখবেন যেন অতিথিদের আদর আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি না-হয়।
দশ/বারোজনের দলের অতিথিদের প্রত্যেকের খাওয়া-দাওয়া শেষ । এমন সময় বরযাত্রী এলো। ব্যস্ গেইট ধরাধরি, এটা সেটা নিয়ে রসিকতা, আনন্দ, ডাকাডাকি, হৈহুল্লোড়তে চারদিক মুখর করে তুললো সবাই। গম গম করছে কমিউনিটি হল। বরযাত্রী হয়ে এসেছেন মেহমানরা বসেছেন সকলে। আমিও ব্যস্ত প্রত্যেকের সাথে সাথে। হাসি মুখে কুশল বিনিময় করছি নতুন আত্মীয়দের সঙ্গে। অকস্মাৎ আমাকে একজন পেছন থেকে ডেকে একটু দূরে নিয়ে গেলেন। বললেন- ভাই আমরা একটা মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছি।
আমি জানতে চাইলাম- কী ভুল করেছেন ভাই?
আমরা আসলে যেই বিয়েতে এসেছি, এটা সেই বিয়ে নয়। বর এবং কনে দু-পক্ষই আমাদের অচেনা। এখানে আমাদের পরিচিত কেউ নেই। আমরা যাবো উৎসব কমিউনিটি সেন্টারে, চলে এসেছি উল্লাস কমিউনিটি সেন্টারে। কাছাকাছি নাম তো দুটো সেন্টারের তাই গুলিয়ে ফেলেছি।
আমি বললাম- সেটা কোনো সমস্যাই নয়। তাড়াতাড়ি চলে যান উৎসব কমিউনিটি সেন্টারে। যে খাতায় ওই দশ/বারোজন অতিথি একটা উপহার দিয়ে নাম লিখিয়েছেন সেই নামটা কেটে দিয়ে তাঁদের দেয়া রঙিন কাগজে মোড়ানো উপহারটা ফেরত দিয়ে দিলাম । খুব ভদ্রভাবে বললাম- দ্রুত যান ওখানটায়, তা না-হলে তো বিয়ের অনুষ্ঠান পাবেন না ।
তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন- আপনাদের অনুষ্ঠানে যে আমরা দশ/বারোজন লোকের খাবারটা খেয়ে ফেললাম, ওটার কী হবে ?
আমি বললাম- আরে ভাই ওটা কোনো ব্যাপারই নয় । সামান্য খাবারই তো । এটা আর এমন কি ?
তারপর ওনারা উৎসব কমিউনিটি সেন্টারে যাবেন বলে শীঘ্রই বেড়িয়ে পড়লেন ।
আমি আবার বিয়ের অনুষ্ঠানে মনোনিবেশ করবো বলে পেছনে ফিরছি । এমন সময় আমার দুই তিনজন আত্মীয় বয়সে তারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বললো- ভাইয়া একটা ভুল করলেন ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম- কিসের ভুল ?
তাঁরা আপনাকে যা বলে গেলেন- সব আসলে নাটক । হয়তো সাজানো কিছু । একদিন উৎসব কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে বলেন উল্লাসের কথা, আবার আরেকদিন উল্লাসে গিয়ে বলেন উৎসবের কথা । অসুবিধে কি, কেউ তো তাঁদের আর দু-বার দেখেন না । সব সময় তো ভিন্ন ভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠান । লোকজন সকলেই ভিন্ন ।
আমি বললাম- ধেৎ, এটা হতেই পারে না । তাঁদের সঙ্গে মহিলাও ছিলেন ।
আরে ভাইয়া আপনি তো বিদেশে থাকেন তাই ঢাকার ভাব বোঝবেন না । কতো ধরনের লোক যে আছে এখানে । হাকুল্লা খাওয়ার লোকের অভাব নেই এই শহরে ।
আমি ওদেরকে ধমকে বললাম- বাজে বকিস না । না-জেনে ভদ্রমানুষ সম্পর্কে এসব বলতে নেই ।
যাক্ সেদিন বিয়ের অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছিলো । কোনোকিছুতেই কোনো সমস্যা হয় নি ।
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হবার কদিন পরেও ওই হাকুল্লা শব্দটা আমাকে খুব ভাবিয়ে তুলেছে । এই শব্দটা বাংলাতে আছে কি নেই আমি জানি না । তবে শব্দটা আমাদের সমাজে প্রচলিত । এবং শব্দটার সঙ্গে আমি নিজেও পরিচিত । কবে, কোথায় শুনেছি সঠিক মনে করতে পারছি না ।
অবশেষে কদিন পরে আমার ঠিক ঠিক মনে পড়েছে । আমি তখন ছাত্র । ঢাকায় থাকি । আমার ঢাকার বন্ধুরা অনেকবার অনেকদিন বলেছে- হাকুল্লা খাওয়ার কথা । যখনই পোলাও-কোর্মা খেতে মন চাইতো অথবা এইসব খাবারের আলোচনা উঠতো, তখনই কজন বন্ধু আমাকে বলতো- দোস্ত চল্ আগামী শুক্রবারে কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠানে হাকুল্লা খাবো ।
আমি বলতাম- নারে দোস্ত হাকুল্লা খেতে যাবো না । টেনশনে খাবার পেটে যাবে না । মাথায় সারাক্ষণ থাকবে একই দুশ্চিন্তা, এই বুঝি কেউ বুঝে ফেললো, এই বুঝি কেউ ধরে ফেললো । আর ধরতে পারলে তো কথাই নাই, কিল, গুঁতো, লাথি একটাও মাটিতে পড়বে না । তারপর শখ মিটে যাবে হাকুল্লা খাওয়ার । হাড্ডিগুড্ডি ভেঙে হাসপাতালে কাটাতে হবে মাসের পর মাস । মানুষ আসবে হাসপাতালে দেখতে, দেখতে এসে বলবে- আহারে কেন্ গেছিলি হাকুল্লা খাইতে ? ডাক্তারও ভালো-মতো চিকিৎসা করবেন না । বলবেন- হাকুল্লা খাওয়া রোগীর আবার এত ভালো চিকিৎসার কী দরকার ? নার্সরাও ঠিকভাবে সেবাশুশ্রূষা করবেন না । তাঁরাও হয়তো মিটিমিটি হেসে বলবেন- ছেলেগুলোর চেহারা সুরত খারাপ না । দেখে তো ভদ্র ঘরের সন্তানই মনে হয় । তবে স্বভাব ভালো নয় । হাকুল্লা খায় ।

আমার নেগেটিভ বক্তব্যে আমার বন্ধুদের হাকুল্লা খাওয়ার পরিকল্পনা সব ভেস্তে গিয়েছিলো । ওরাও সাহস করে নি জীবনে একবারও হাকুল্লা খেতে । কেবল বলাবলিই করেছে । ওরাও ভেবেছে- এই অধমের (আমার) কথা যদি বাস্তবে ফলে যায়, সেই ভয়ে ।