প্রচ্ছদ

বিশ্বনাথ কলেজের প্রয়াত প্রভাষক আব্দুল মালিক বাবুল এর ২২ তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

  |  ১৩:০৩, জানুয়ারি ২৭, ২০২২
www.adarshabarta.com
তাজ উদ্দিন আহমদ:
সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলাধীন ৩নং অলংকারী ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী অলংকারী গ্রামে ১৯৬৬ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন জনাব আব্দুল মালিক বাবুল।
তাঁর পিতার নাম ছিল মোঃ আঞ্জব আলী এবং মাতার নাম ছিল মোছাঃ হামিদা বানু। তাঁরা ছিলেন নয় ভাই-বোন,ভাইদের মধ্যে জনাব বাবুল ছিলেন সবার ছোট। তাঁর বাড়ির সীমানা সংলগ্ন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ১৯৭৭ সালে বিশ্বনাথ রামসুন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ১৯৮৩ সালে উক্ত বিদ্যালয় থেকে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে প্রথম বিভাগে এস এস সি ও ১৯৮৫ সালে একই শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ঐতিহ্যবাহী এম সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচ এস সি পাশ করেন। জনাব আব্দুল মালিক ১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর (এম এস এস) ডিগ্রী অর্জন করেন এবং ১৯৯২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে এল এল বি ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তীতে জনাব আব্দুল মালিক বাবুল ১৯৯৪ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর বিশ্বনাথ কলেজে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান এর মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই পদে থেকে স্বীয় দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করে ছিলেন।
জনাব বাবুল ১৯৯৮ সালের শেষের দিকে মরণ ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং বৎসর অধিক কাল ক্যান্সার এর সাথে লড়াই করে ২০০০ সালের ২৭শে জানুয়ারি রাত ০৯:৪৫ ঘটিকার সময় মাত্র ৩২ বৎসর বয়সে এই ক্ষণজন্মা পুরুষ ইহকাল ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন—)।
পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা হিসেবে তাঁর সাথে আমার পরিচয় ছিল সেই ছোট বেলা থেকেই। স্কুলে পড়ার সময় তিনি ছিলেন আমার এক বছরের সিনিয়র। রামসুন্দর অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় একসাথে পায়ে হেঁটে বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করতে গিয়ে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, নম্র, ভদ্র ও প্রতিহিংসা পরায়ণমুক্ত, সুশিক্ষিত এক সম্ভাবনাময় তরুণ। সব সময় হাসিমুখে কথা বলতেন এবং মানুষের উপকার করার চেষ্টা করতেন।
মালিক ভাইয়ের সাথে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে আমার একটি ছোট স্মৃতি রয়েছে। ১৯৮৬ সাল, আমি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য গিয়েছিলাম। তখন দেশব্যাপী চলছে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের সামরিক শাসন। দেশের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাসের পর মাস বন্ধ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অবস্থা। ছাত্রশিবির ও ছাত্র সমাজের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষের পর ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসের দখল নিয়েছে। সমস্ত ক্যাম্পাস জুড়ে এক ভীতিকর অবস্থা। প্রত্যেক আবাসিক হলের মূল ফঠকে ছাত্রশিবির এর সদস্যদের পাহারা। যখন তখন শরীর ও বেগ তল্লাশি হচ্ছিল। আমাদের গ্রামের আরেক কৃতি ছাত্র মালিক ভাইর সহপাঠী জনাব বাবরুল হোসেন বাবুল ছিলেন তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হল এর আবাসিক ছাত্র। যারফলে ইতিমধ্যে তিনি আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত করেছেন। এছাড়া সৌভাগ্য বশতঃ তখন আব্দুল মালিক বাবুল ভাই আমার সাথে ছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে উনার ও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। ক্যাম্পাসে ভর্তি পরীক্ষা শেষে দুপুরের খাবারের জন্য মালিক ভাই আমাকে নিয়ে শাহ আমানত হলের ডাইনিং হলে ঢুকলেন। ডাইনিং হলের বয় প্লেট সার্ভ করার পর আমি আমার প্লেট ধুয়ে পাশে রাখা দু’টি বৌলের(গামলার) একটিতে পানি ঢালার সাথে সাথেই মালিক ভাই তাঁর স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে উঠেন। আমি কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই তিনি বৌলটি সরিয়ে রাখলেন। আমি তাঁর কাছে হাসির কারণ জানতে চাইলাম, তিনি আমাকে খাওয়ার পর বলবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। পরে তিনি জানালেন আমি যে বৌলে পানি ফেলেছি সেটাতে ডাল রাখা ছিল। কিন্তু আমার পক্ষে সেটি বুঝার কোন উপায় ছিল না, কোনটি ডালের বৌল আর কোনটি প্লেট ধুয়ে পানি ফেলার বৌল। যাইহোক অন্য কেউ দেখে নাই,এটাই ছিল আমার আত্মতৃপ্তি। অবশ্য পরবর্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর দেখেছি অনেকেই আমার মত এ ধরনের ভুল করেছে। ছাত্র জীবন শেষ করে মালিক ভাই যখন বিশ্বনাথ কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করলেন তখন তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি অবসর সময়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও অংশ গ্রহণ করতেন। এদিকে আমিও মাস্টার্স পাশ করে প্রথমে গোলাপগঞ্জে একটি বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পদার্থ বিদ্যা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি এবং পরবর্তিতে ১৯৯৮ সালে সোনালী ব্যাংকে প্রভেশনারী অফিসার হিসেবে ব্যাঙ্কিং ক্যারিয়ার শুরু করায় মালিকভাইরসাথে দেখা-সাক্ষাত সচরাচর কম হত। ‘৯৯ সালের প্রথম দিকে আমি ছুটিতে বাড়িতে এলে জানলাম মালিক ভাই মরণ ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। এ খবর শোনার সাথে সাথেই আমি অনুভব করলাম আমার সমস্ত শরীর অবস হয়ে আসছে।
কিছুক্ষণ পর মন স্থির করে মালিক ভাইর ঠিকানা সংগ্রহ করে দেখার জন্য সিলেট গেলাম। বন্ধু আব্দুল খালিক এর জিন্দাবাজারের প্যারাগণ বুক স্টলে যাওয়ার পর আমার শ্রদ্ধাভাজন বড় ভাই কবি জনাব সাইদুর রহমান সাইদ এর সাথে দেখা হয়। মালিক ভাইর অসুস্থতার কথা শুনে তিনিও যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করায় আমরা জালালাবাদের বাসায় তাঁকে দেখতে যাই। কেমো থেরাপি দেওয়ার কারনে তাঁর মাথার সমস্ত চুল পড়ে গিয়েছিল, স্বাস্থ্য ও আগের মতো ছিল না। তিনি হাসিখুশি ছিলেন, শারীরিক অসুস্থতার কথা ব্যতীত অনেক কথাই বলেছিলেন, আমরা চা পান করে চলে এলাম আর মহান আল্লাহর দরবারে শুধু এ প্রার্থনা করলাম, হে মহান আল্লাহ তুমি তোমার এ বান্দাকে তোমার কুদরতী শিফা নসীব করে সুস্থাবস্থায় আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দাও। ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে তিনি প্রায় বছর দিন শয্যাশায়ী ছিলেন। সে সময় তাঁকে যখনই দেখতে গিয়েছি তখনই বিমূঢ় নয়নে দেখেছি তাঁর করুণ অবস্থা, যা সব সময়ই মর্মবেদনা র কারণ ছিল। অনেক বার মিথ্যে শান্তনাও দিয়েছি। দিন যত অতিবাহিত হচ্ছিল, তিনি ততই দূর্বল হচ্ছিলেন। কিন্তু এমতাবস্থায়ও মালিক ভাইয়ের মনোবল ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি। অবশেষে ২০০০ সালের ২৭ শে জানুয়ারি ভোর বেলা ক্যান্সারের কাছে আত্মসমর্পণ করে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অসময়ে অসীমের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেন আমাদের প্রিয় মালিক ভাই। আজ তাঁর ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী।
আজকের এ দিনে তাঁকে স্মরণ করি বিনম্র শ্রদ্ধায়। মহান আল্লাহতা’লা যেন তাঁকে বেহেশেতের সর্বোত্তম স্থান জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করেন,
আমিন। ইয়া রাব্বুল আ’লামিন।
তাজ উদ্দিন আহমদ
ব্যবস্থাপক
প্রাইম ব্যাংক, আম্বরখানা শাখা, সিলেট।