প্রচ্ছদ

ইতিহাসের নিরিখে বাংলাদেশের ছড়া

  |  ০৯:০৪, অক্টোবর ২৩, ২০২০
www.adarshabarta.com

:: এবিএম সালেহ উদ্দীন ::

ছড়া হচ্ছে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত ঝংকারময় পদ্য। ছড়া সাধারণত স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত হয়। ইহা সাহিত্যের একটি প্রচীনতম শাখা। যিনি ছড়া লেখেন তাকে ছড়াকার বলা হয়। তবে বাংলা সাহিত্যে কবিদের অনেকেই সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মতো ছড়া এবং শিশুতোষ সাহিত্য রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ছড়াকার হিসেবে আলাদাভাবে পরিচিতি না ঘটলেও তাঁদের অনেকের শিশুতোষ লেখা ও ছড়া বহুজন পঠিত এবং জনপ্রিয়। শিশু সাহিত্যে ‘ছেলেভুলানো ছড়া’, কিংবা ‘ঘুম পাড়ানি ছড়া’র সঙ্গে অনেক শিক্ষণীয় বহুপঠিত ছড়া ছোটদের জন্যে এবং বড়দের জন্যে লিখিত।
প্রাচীনকাল থেকে বাংলা ভাষায় ছড়া এবং একই আদলের পুঁথিমালা ও ছন্দময় পদ্য বাংলা লোকজ সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। ছড়ার মধ্যে ধ্বনিময়তা, সুরঝংকার ও অর্থময়তা আছে। সুরের ধ্বনি ও তাল আছে। একজন কবি অথবা দক্ষ ছড়াকার সেই মন মাতানো ঝংকার, তাল ও সুরের লয়-লহমায় ছড়াটিকে বানিয়ে পাঠকের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।
ছড়া বাংলা সাহিত্যের একটি সর্বালোচিত শাখা। ছড়ার আদিসৃষ্ট চর্যাপদ বা চর্যাগীতির প্রথম মূল পদটি স্বরবৃত্তে ছন্দে ছড়ার মতো করে লিখিত। ছড়া কিংবা পদ্যের মতো বাংলার লোকসাহিত্যের ছন্দময়তার পথ ধরে বাংলাদেশের ছড়া, এখন বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য সম্পদ।
বাংলাভাষায় লিখিত ছড়ার রয়েছে প্রায় দেড় হাজার বছরের ইতিহাস। এটি শিশু-কিশোরের জন্য এবং সর্বস্তরের পাঠকের জন্য উন্মুক্ত খোলামেলা কাব্য। পাঠকের মনোরঞ্জন ও মনমাতানোর ছন্দময় পদ্য। ছড়ার ঝংকারময়তায় পাঠককে জাগিয়ে তোলা যায়। পাঠককে আন্দোলিত করে। আগেকার দিনে আমাদের লোক সমাজে ছড়ার মাধ্যমে মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করতেন। একসময় পালাগানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ছড়ার আদলে পংক্তিমালার সাথে বাদ্য-বাজনাও যোগ হতো। সাহিত্যে ভিন্ন স্বাদের আনন্দের খোরাক হিসেবে ছড়ার রয়েছে বিশেষ ভূমিকা।
সাহিত্যে এমন ছড়াও আছে যা অনেক সময় গণআন্দোলনের শ্লোগানেও রূপ নেয়।
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে যোগীন্দ্রনাথ সরকার লৌকিক ছড়াকে প্রথম গ্রন্থভুক্ত করেন এবং গ্রন্থটির নাম দেন ‘খুকুমণির ছড়া’। এই গ্রন্থটির ভূমিকায় সর্বপ্রথম রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী ছড়াকে সাহিত্যের একটি অন্যতম শাখা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। পরবর্তীতে সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৩) এবং বাংলা সাহিত্যের অনেক কবির মাধ্যমে ছড়ার গ্রহণযোগ্যতার স্বীকৃতি জোরালো হয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) তাঁর সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থে সুকুমার রায়ের ছড়া সংকলিত করে, ছড়ার গ্রহণযোগ্যতাকে মজবুত করেন। এ প্রসঙ্গে কবিগুরু বলেন, ‘সুদীর্ঘকাল থেকে আজ পর্যন্ত এই কাব্য (ছড়া) যারা আউড়িয়েছে এবং যারা শুনেছে তারা অর্থেও অতীত রস পেয়েছে। ছন্দতে ঝংকার তুলে একটা মোহময়তা এনে দিয়েছে। সেইজন্য অনেক নামজাদা কবিতার চেয়ে এর (ছড়া) আয়ু বেড়ে চলেছে।’
একসময় ছড়াকে মনে করা হতো শুধুই শিশুসাহিত্য। আসলে তা নয়। বাংলাসাহিত্যে ছড়া ছোটবড় সব বয়সের পাঠকের জন্য নিজস্ব স্বকীয়তায় প্রতিষ্ঠিত। কখনো ছড়া বিপ্লবী শ্লোগানের কাজেও রূপান্তরিত হয়।
এখানে রবীন্দ্রনাথের দুটো ছড়ার উদ্ধৃতি দেয়া হলো :
১.
আমাদের ছোটো নদী
‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি ।’
২.

ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা
‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।
রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে
আজকে যে যা বলে বলুক তোরে,
সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ করে
পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।
আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।’
সুকুমার রায়ের ছড়ার সংখ্যা এত বেশি, যা আদ্যাক্ষরিক অনুপাতে পড়তে হয়। বেঁচেছিলেন মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর। বাংলা সাহিত্যভূবনে তিনি এখনো জনপ্রিয়। ছড়ায় তাঁর সমতুল্য এখনো কাউকে পাওয়া যায়নি। নিম্নে সুকুমার রায়ের একটি ছড়া তুলে ধরা হলো :
আয়রে আলো আয়
‘পুব গগনে রাত পোহাল,
ভোরের কোণে লাজুক আলো
নয়ন মেলে চায়।
আকাশতলে ঝলক জ্বলে,
মেঘের শিশু খেলার ছলে
আলোক মাখে গায়।।
সোনার আলো, রঙিন আলো,
স্বপ্নে আঁকা নবীন আলো-
আয়রে আলো আয়।
আয়রে নেমে আঁধার পরে,
পাষাণ কালো ধৌত করে
আলোর ঝরণায়।।
ঘুম ভাঙান পাখির তানে
জাগার আলো আকুল গানে
আকূল নীলিমায় ।
আলসভরা আঁখির কোণে,
দুঃখ ভয়ে আঁধার মনে,
আয়রে আলো আয়।।’

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) তাঁর ছড়ার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে যে ঝংকার তুলে দিয়েছেন; তা বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ। বাংলা কবিতা ও ছড়ার ঝংকারের ক্ষেত্রে নজরুল প্রতিভার সমকক্ষ যে নেই, তা নজরুল বিদ্বেষীরাও স্বীকার করবেন। শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তিনি যে স্বাক্ষর রেখেছেন, তার তুলনা বিরল। তাঁর অনেক গান, কবিতা ও ছড়া হারিয়ে গেছে। অনেক প্রতিকুলতার মধ্যেও তিনি ছিলেন সমাজের সবচেয়ে সাহসী ও প্রতিবাদী কবি। নজরুল বাকরুদ্ধ না হলে এবং নিষ্কন্টক জীবন-যাপন করতে পারলে, সাহিত্যে তিনি নোবেল পুরস্কার পেতেন, তা সহজেই বলা যায়।
নজরুলের অনেক ছড়া অসাধারণ এবং এখনো জনপ্রিয়। যেমন ‘ঝিঙেফুল’, ‘খুকী ও কাঠবিড়ালী’, ‘মা’, ‘খাঁদু-দাদু’, ‘খোকার বুদ্ধি’, ‘খোকার গল্প বলা’, ‘চিঠি’, ‘লিচু চোর’, ‘ঠ্যাংফুলী ও পিলে-পটকা’, ‘হোঁদল-কুঁৎকুতের বিজ্ঞাপন’, ‘প্রভাতী’ ইত্যাদি ছোটদের জন্য এমন অনেক লেখা জনপ্রিয়। প্রভাতী কবিতায় প্রভাতের বর্ণনা করেছেন অত্যন্ত সুন্দর ও মনোমুগ্ধকরভাবে। শিল্প-সাহিত্যে চির অনির্বাণ কাজী নজরুল ইসলামের তিনটি জনপ্রিয় ছড়ার উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো :
১.
‘ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠরে!
ঐ ডাকে যুঁই শাখে ফুল-খুকী ছোটরে।’…
এই প্রভাতি কবিতাটি তাঁর ‘ঝিঙেফুল’ কাব্যগ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য পদ্য কবিতা, যা মূলত একটি জনপ্রিয় ছড়া।’ ঝিঙেফুল’ কবিতাটিও একটি মিষ্টি কবিতা। এটিকে ছড়াও বলা যায়-
২.
‘ঝিঙেফুল! ঝিঙেফুল!
সবুজপাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল-
ঝিঙেফুল!’
গুল্মে পর্ণ
লতিকার কর্ণে
ঢল ঢল স্বর্ণে
ঝলমলে দোলে দুল
ঝিঙে ফুল।’

৩.
মা
যেখানেতে দেখি যাহা
মায়ের মতন আহা
একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,
মায়ের যতন এত
আদর সোহাগ সে তো
আর কোনখানে কেহ পাইবে না ভাই।
হেরিলে মায়ের মুখ
দূরে যায় সব দুখ,
মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,
মায়ের শীতল কোলে
সকল যাতনা ভোলে
কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।
কত করি উৎপাত
আব্‌দার দিন রাত,
সব স’ন হাসি মুখে, ওরে সে যে মা!
আমাদের মুখ চেয়ে
নিজে র’ন নাহি খেয়ে,
শত দোষে দোষী তবু মা তো ত্যাজে না।..

ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) ছিলেন সুশিক্ষিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাস করেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন অখন্ড ভারতে তিরিশের উপান্তের অন্যতম প্রধান কবি। কবিতার প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং বাক্‌প্রতিমার অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল এই কবির কবিতায় আধুনিকতার ব্যাপ্তি আছে। আছে ধর্মবোধ ও রোমান্টিকতা। সাহিত্যের সকল শাখায় রয়েছে তাঁর দোর্দণ্ড বিচরণ। শিশু সাহিত্যেও রয়েছে তাঁর অবদান। বাংলা বর্ণমালায় এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে শিশুদের জন্য লিখে তাদের অন্তর জয় করেছেন। আদ্যাক্ষরিকভাবে ছড়া লেখায় পাণ্ডিত্যের ছাপ পাওয়া যায়। যেমন :
‘অ তে অতসী-তিসির মাঠ,
অশ^ত্থ গাছের সামনে হাট
অলি গলি শহর চাই
অলি গলি শহর পাই ।’…

অন্য একটি শিশুতোষ ছড়া :

‘আয়রে ঘোড়া পরেন দা
পাখনা মেলে উড়ে যা
কিসসা শুনি রোজ আমি
করি যে তার খোঁজ আমি।’…

বাংলার গাছপালা, লতাপাতা, ফলফুল ও ছায়াঘন বনবনানী, মাঠঘাট ও নদী নিয়ে যাঁর আকুলতার কোমল স্পর্শে অসংখ্য পদ্মময় ছড়া, মাটি ও মানুষের সাথে মিশে আছে; তিনি হলেন, পল্লীকবি জসীম উদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬)। নিম্নে তাঁর দুটি ছড়ার উদ্ধৃতি দেয়া হলো :
১.
মামার বাড়ি
‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা
ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে
মামা বাড়ি যাই ।’…
২.
আমার বাড়ি
‘আমার বাড়ি যাইও ভোমর
বসতে দেব পিঁড়ে
জলপান যে করতে দেব
শালি ধানের চিঁড়ে।’…

বাংলা সাহিত্যে বাংলাদেশের ছড়া সাহিত্যেরও রয়েছে বিরাট ভূমিকা। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) সাহিত্যের সকল শাখার মতো ছড়া লিখনেও বিরাট ভূমিকা রেখেছেন।
এখানে মাকে নিয়ে তিনি যেমন দীর্ঘ কবিতা লিখেছেন। তেমনি তাঁর বেশ কিছু ছড়া ও শিশুতোষ সাহিত্য রয়েছে। এখানে তাঁর দুটি ছড়া তুলে ধরা হলো :
১.
মাগো তুমি
‘মাগো তুমি কোথায় গেলে
অচিন কোনো সাগর তীরে?
আমায় ফেলে কোথায় গেলে?
মেঘ-মুলুকে? তারার ভিড়ে?
মাগো তোমায় ডেকে ডেকে
ভাইবোনেরা হলাম সারা।
তবে তুমি এমন কেন?
একটুও আজ দাও না সাড়া।
স্বপ্নে দেখি, রূপালি এক
পালকি থেকে নামলে তুমি;
জানি না হায় কোন সে মুলুক,
আঁধার ছাওয়া কোন সে ভূমি?
যখন আমি পড়তে বসি,
কিংবা রাতে ঘুমোতে যাই,
হঠাৎ যেন আমার মাথায়
তোমার হাতের ছোঁয়াটি পাই।
পড়ার ঘরের চেয়ার থেকে
তাকাই যখন শূন্য খাটে,
হয় যে মনে শুয়ে আছো,
সূয্যিমামা যাচ্ছে পাটে।
তোমার কোরান, চশমা তোমার,
শাড়িগুলো তেমনি আছে,
আলমারিটা কেমন নিঝুম,
কেবল তুমি নেই যে কাছে।
মাগো যদি একটি বার আজ
দেখি তোমার মুখের জ্যোতি,
দিচ্ছি কথা- কাঁদবো না আর,
করবো না আর চোখের ক্ষতি!
এখন কে আর বলবে আমায়,
আয়রে বাচ্চু আমার কাছে?
দমকা হাওয়ায় পর্দা কাঁপে,
পাতা নড়ে একলা গাছে।’
২.
কাকের ছায়া
‘কাঠফাটা সেই দুপুরে
কাকটা গেল পুকুরে।
পানি খাওয়ার আমেজে
পুকুরপাড়ে নামে যে।
সরিয়ে ঝরা পাতাটা
দেখে কাকের মাথাটা।
কে এল ফের দুপুরে
ভাগ বসাতে পুকুরে?
ঠুকরে মজা পানিকে
নিজের ছায়াখানিকে
তাড়িয়ে দিয়ে ঘুসিতে
নেচে ওঠে খুশিতে !”

আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯) আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি। সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি ছিলেন বিচরণশীল ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি শিশুতোষসহ সব বয়সের পাঠকের জন্য অনেক নন্দিত ছড়া রচনা করেছেন। তাঁর ছড়াগুলো জনপ্রিয়। নিম্নে তাঁর দুটি ছড়া তুলে ধরা হলো :
১.
একুশের কবিতা
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায় ?
বরকতের রক্ত।
হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে!
প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে
ছড়াও ফুলের বন্যা
বিষাদগীতি গাইছে পথে
তিতুমীরের কন্যা।
চিনতে না কি সোনার ছেলে
ক্ষুদিরামকে চিনতে?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে
মুক্ত বাতাস কিনতে?
পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায়
ঝাঁপ দিল যে অগ্নি,
ফেব্রুয়ারির শোকের বসন
পরলো তারই ভগ্নী।
প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, আমি
জন্মেছি এই বঙ্গে।’

২.
পাখির মতো
‘আম্মা বলেন, পড়রে সোনা
আব্বা বলেন, মন দে;
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
আমার কেবল ইচ্ছে জাগে
নদীর কাছে থাকতে,
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মতো ডাকতে।
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলীর কূলটায়,
দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি
ফেরেস্তারা উল্টায়।
তখন কেবল ভাবতে থাকি
কেমন করে উড়বো,
কেমন করে শহর ছেড়ে
সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো!
তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি না হয় পাখিই হবো,
পাখির মতো বন্য।’
সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬) বাংলাদেশের অন্যতম কবি ও সব্যসাচী লেখক। শিল্প-সাহিত্যে অসংখ্য রচনা সমগ্রের মধ্যে শিশুদের জন্যেও তিনি নানারকম ছড়া লিখেছেন।
কাব্যভূবনে তাঁর শিশুতোষ বই ও বেশকিছু অসাধারণ ছড়া আছে। একটি ছড়ার কয়েকটি লাইন এমন :
‘একটি দুটি পাতার ফাঁকে ভোরের আলো পড়ছে।
রাতের কালো লোহার গায়ে একটু একটু মর্চে।
সেই মর্চের গা ঘষবে সূর্যমামা কামার।
সোনার মতো ফুটে উঠবে। ঘুম ভাঙবে আমার।
ঘুম ভাঙবে জেগে উঠবে এক্ষুনি রাজধানী।
ভরবে কলরবে শহর, কলে আসবে পানি।
বাজার জমে উঠবে, ঘড়ি বেজে উঠবে টং।
জানালাতে ফুটে উঠবে সোনার মতো রং ।’

বাংলাদেশের সাহিত্যভূবনে কবিতা ও ছড়ার জয়জয়কার। স্বাধীনতার পর ছড়াও কবিতার যে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে, তা যেন শিল্প-সাহিত্যের বিপ্লবে রূপান্তরিত হয়। বাংলা সাহিত্যের অসংখ্য কবি সাহিত্যিকের মধ্য থেকে এই লেখায় কয়েকজন বিখ্যাত (প্রয়াত) কবির ছড়ার উদ্ধৃতির মধ্যদিয়ে সকল কবি- সাহিত্যিকের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। বাংলাদেশে নবীন ও প্রবীণের মেলাবন্ধনে আমরা গণঝংকারের পদধ্বনি শুনতে পাই। সেটি হচ্ছে ছড়ার ছন্দময় জাগরণ। বাংলাদেশে অসংখ্য কবি- সাহিত্যিক আছেন, যাঁদের সকলের পরিসংখ্যান করা দুঃসাধ্য। তাঁদের অনেকের ছড়া কবিতার মতোই পরিব্যাপ্ত। তাঁদের ছড়ার মান অন্যান্য দেশের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়। কবি ও ছড়াকারদের আন্তরিকতা ও সমন্বয় থাকলে এটি আরও বেগবান হয়ে উঠবে। আমাদের কবি-সাহিত্যিকের নিষ্ঠাবোধের সঙ্গে দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যের সমন্বিত ভাবনাবৃত্তের মিলিত প্রয়াস থাকলে, বাংলাদেশের সাহিত্য বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাবে। বাংলা কবিতা ও ছড়া সাহিত্যের উন্নয়নের পথ তৈরি হবে।
দেশে-বিদেশে অবস্থানরত কবি-সাহিত্যিকের ছড়া ও কাব্যসৃষ্টির ক্রমবর্ধমান ধারাবাহিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকুক। বিশ্বসাহিত্যের সাথে বাংলাদেশের শিল্প- সাহিত্যের যোগসূত্রিতার জাগরণ সৃষ্টি হোক ।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।