প্রচ্ছদ

গ্রামীন জনপদের কোড়া শিকার এখন শুধু ঐতিহ্য

  |  ১৬:১৭, জুন ২৫, ২০২০
www.adarshabarta.com

:: আবু সালেহ আহমদ ::

কোড়া পাখি পালন ও শিকারের কথা আপনাদের মনে আছে কি? আশির দশকের পূর্বেও গ্রাম বাংলা বিশেষ করে সিলেটের ভাটি এলাকায় কোড়া শিকারের ব্যাপক প্রচলন ছিল। কোড়া সুদর্শন প্রজাতির পাখি। হাওর বিল পুকুরের জলজ উদ্ভিদে ছিল এদের বসবাস। এরা লাজুক হলেও হিংসাত্মক। কু হু কুহু ডাক অতীতে গ্রামাঞ্চলের সৌখিন মানুষকে আকৃষ্ট করতো। ভাটি এলাকার সৌখিন বিত্তশালীরা এই পাখি শখের বশবর্তী হয়ে নৌকা নিয়ে শিকারে বের হতেন। শিকারীরা প্রথমে তার নিজের পালিত কোড়াটিকে হাওরের বনে বা ধান গাছে ছেড়ে দিতেন। পালিত কোড়ার ডাক শুনে বন্যা কোড়া তখন এগিয়ে আসতো। এবং যুদ্ধ বেঁধে দিত।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সভাপতি, সাবেক অতিরিক্ত সচিব জালাল আহমেদ বলনে, “কোড়া পাখির সাথে অন্য আরেকটি কোড়া পাখি যুদ্ধ করতে ভালোবাসে। এদের যুদ্ধ অনেকটাই মোরগের লড়াইয়ের মতো। শ্রাবণ, ভাদ্র,আশ্বিন, এই তিন মাস পুরুষ প্রজাতি কোড়ার প্রজনন মৌসুম। তাই এই সময় শিকারীদের শিকার সহজ হয়”

এ সম্পর্কে বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশক আলম সাইন বলেন, “বিশেষ করে পুরুষ পাখি প্রজনন মৌসুমে অন্য পুরুষকে প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখে। সামনাসামনি হলে তো কথাই নেই, ভীষণ যুদ্ধ বাধিয়ে বসে ওরা। এই সময় মানুষ অন্য কোন প্রাণী কাছে গেলও ওদের যুদ্ধ থামেনা। ফলে সুযোগটি নেই শিকারীরা। খপ করে দুটোকে ধরে ফেলে”।

বিশিষ্ট লেখকও গবেষক, অদ্ধৈত লিখেছেন, “আষাঢ় শ্রাবণ মাস যখন ধান নালিতা গাছগুলো ডুবো ডুবো তখনই কোড়া ধরিবার উপযুক্ত সময়। কোড়া শিকারীরা বৃবদাকারের একপ্রকার পিঞ্জিরাতে পোষামানা কোড়াকো লইয়া ডুবো জমিতে যায়। পোষা কোড়ার ডাকে আকৃষ্ট হয়ে জঙ্গলের (বুনো) কোড়া উহার নিকট আসে এবং দুই জীবের মধ্য তখন রীতিমতো যুদ্ধ বাধিয়া যায়”।
পাখি গবেষক, শরীফ খান বলেন, “ঠোঁট পা দিয়ে একে অন্যকে আঘাত করে। প্রতিপক্ষের পায়ের ৪টি নখ দিয়ে নিজের নখরে কষ্টে আখড়ে ধরে।”
ঐসুযোগে শিকারীরা দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলতে পারে দুটিকেই।”

কোড়া ও তার শিকার নিয়ে সিলেটের প্রখ্যাত জমিদার ও মরমী কবি হাসান রাজা লিখেছেন অনেক গান। কোড়া শিকার ছিল তার শখ। তিনি সাথী আত্বীয় স্বজন নিয়ে পানশি নৌকা করে ভাটি এলাকায় কোড়া শিকারে বের হতেন। এতে তাঁর ভ্রমণ হতো শিকারও হতো। তিনি শখের বসবর্তি হয়ে রঙ্গ বেরংয়ের কোড়া পাখি পালন করে গিয়ছেন। যাহা তিনি তাঁর জীবন কাহিনিতে উল্লেখ করেছেন। শিকারের প্রতি আসক্ত হয়ে তিনি লেখেছেন,
এই দোয়া কর মমিন মছলমান ভাই
বেহেস্ত গিয়া যেন কুড়া শিকার পাই।
সৌখিন বাহার নামক মরমী গ্রন্থে লিখেছেন,
“আল্লাহ আল্লাহ বলো ভাই, আল্লার নাম সার,
মুহাম্মদ মোস্তফা নামে হইয়া যাইবায় পার,
ভালা বুরা কোড়ার যত করিব বয়ান,
না দেখিলে তুষ্ট নাহি হয় মনপ্রাণ”।
হাসন রাজার কোড়া শিকার নিয়ে বিশিষ্ট লেখক, দেওয়ান মাসুদুর রহমান চৌধুরী লিখেন,”
অতীতে সিলেটসহ অন্যান্য জেলার ভাটি অঞ্চলের সৌখিন জমিদাররা কোড়া পাখি শিকার করতেন। জানাযায়, কোড়া শিকারের প্রথা ইরানের বাজপাখি শিকার থেকে বাংলাদেশে এসেছিল। হবিগঞ্জের কুরশা পরগনার প্রখ্যাত দেওয়ান গোলাম মোস্তফা চৌধুরী স্বযত্নে কোড়া পাখি পোষতেন এবং কোড়া পাখি শিকার করতেন, কথিত আছে যে, সরাইল পরগণার জমিদার দেওয়ান মোস্তফা আলী চৌধুরী, সুনামগঞ্জের মরমী কবি দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরীর সাথে, তাঁর সখ্যতা ছিল। বয়সের ব্যবধান থাকলেও তাদের মধ্যে গভীর ভাব ও আত্মিয়তার সম্পর্ক ছিল। বর্ষাকালে হাসন রাজা কোড়া পাখি শিকারের জন্য ভাওয়ালী, পানসী ও অন্যান্য খোলা নৌকায় বিরাট জলিয় তৈরী করে বিভিন্ন এলাকায় জল বিহার করতেন।
গ্রামীন জনপদে দীর্ঘ কয়েক শতক কোড়া পালন ও শিকারের প্রচলন থাকলেও এখন হরেক রকমের কোড়া গুলো যেমন দেখা মিলেনা, তেমনি শিকার ও বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এর কারণ হিসেবে বলাযায়, স্থানীয় কিছু লোক শিকারকে নেশা ও পেশা হিসেবে গ্রহণ করার ফলে কোড়াপাখি গুলো আস্তে আস্তে স্থান ত্যাগ করে। কোড়া ও কোড়া শিকার এখন আমদের জন্য ইতিহাস, কিংবদন্তী ও ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে।

লেখক: আবু সালেহ আহমদ
লোক গবেষক,
abusalahahmad@gmail.com