প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-২৩

  |  ১৩:৫০, জুন ২৪, ২০২০
www.adarshabarta.com

লন্ডনে ভূপেন হাজারিকার গান শুনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সীমানা পেরিয়ে ছবির কথা মনে পড়ে যায়

:: মোঃ রহমত আলী ::

সত্তর দশকে বাংলাদেশে যারা ছায়াছবি দেখতেন তাদের নিকট বহুল পরিচিত এবং জনপ্রিয় একটি গানের প্রথম কলি হল, মেঘ থম থম করে, কেউ নেই- নেই। এ গানের শিল্পীর নামও অনেকে জানেন- যিনি হচ্ছেন, ভারত তথা উপমহাদেশের জনপ্রিয় শিল্পি ভূপেন হাজারিকা। যে ছায়াছবিতে গানটি গাওয়া হয়েছিল ছিল সেটি হচ্ছে, “সীমানা পেরিয়ে”। অত্যন্ত দরাজ গলায় তিনি এ গানটি গেয়েছিলেন।

আমি তখন এ ছবিটি দেখার সময় গান শুনে তাঁর দারূন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু কোন সময় চিন্তা করি নাই যে, তাঁর সাথে জীবনে সাক্ষাৎ হবে। কিন্তু সেটা বাস্তব হল ১৯৯৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্ব, রবিবার লন্ডনে। তখন পূর্ব লন্ডনের ইয়র্ক হলে রাত ৮ঘটিকার সময় যুক্তরাজ্য উদিচি শিল্পি গোষ্ঠির পক্ষ থেকে একটি গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আর আমি সুরমা পত্রিকার পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে সেখানে যাই। তখন দীর্ঘক্ষন বসে বসে তাঁর গান শুনেছিলাম ও অতীত স্মৃতি রোমন্তন করছিলাম। তখর তাঁর শারীরিক অবস্থা খুব ভাল ছিল না।
এই কণ্ঠশিল্পীর জনপ্রিয়তা ছিল সমসাময়িককালে আকাশচুম্বী। অসমিয়া চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে গানের জগতে প্রবেশ করেন তিনি। পরবর্তীকালে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় গান গেয়ে অসম্ভব জনপ্রিতা অর্জন করেন। তাঁর কয়েকটি জনপ্রিয় গান হচ্ছে, মানুষ মানুষের জন্য, গঙ্গা আমার মা, হে দোলা-হে দোলা, আমার দুই চোখে দুই ধারা- মেঘনা যুমনা, এত হাহাকার শুনেও গঙ্গা তুমি বইছ কেনো? আমি এক যাযাবর, মালিক সারা জীবন, সাগর সঙ্গমে ও চোখ ছলছল করে ইত্যাদি।

ভূপেন হাজারিকার গানগুলোতে মানবপ্রেম, প্রকৃতি, ভারতীয় সমাজবাদের, জীবন-ধর্মীয় বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। এছাড়াও, শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী সুরও উচ্চারিত হয়েছে বহুবার। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুদিত একটি গান গেয়েও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্ঠা করেছিলেন। সেটি হলো, “আমরা করব জয়, আমরা করব জয়, আমরা করব জয় – নিশ্চয়”।
“আমরা করবো জয়” এর মূল ইংরেজি গানটি হলো ‘উই শ্যাল ওভারকাম’। যেসব সঙ্গীত সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে করেছে প্রতিবাদী, রক্তে জাগিয়েছে উদ্দীপনা, চেতনাতে জাগিয়েছে অনুরণন, কল্পনাকে করেছে জাগ্রত, তাদের মধ্যে অন্যতম হল এ গানটি । উক্ত গানের ভক্তশ্রেুাতা সারা বিশ্বের নিগৃহীত মানুষ, সৎ ও প্রতিবাদী মানুষ এবং সাথে সাথে আশাবাদী মানুষ। এ গান মানবতার গান। অনেক দেশে জাতীয় সঙ্গীতের পরপরই গাওয়া এই গান সংশ্লিস্ট জাতির মানুষকেই উদ্দীপ্ত করে তোলে। বিশে^র সব প্রধান ভাষাতেই গানটি অনুবাদ করা হয়েছে এবং গেয়েছেন সকল ভাষার মানুষ।

১৯৬৩ এর অগস্টে ওয়াশিংটনে মার্টিন লুথার কিং এর পদযাত্রায় এই গান পৃথিবী জুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। তা সকলের হৃদয় ছুঁয়েছিল। শীতলযুদ্ধের সময় বহু কমিউনিস্ট বিরোধী আন্দোলনে এই গান অনুরণিত হয়েছিল। এই গান সম্পর্কে জুনিয়র বলেছিলেন, এটি স্বাধীনতা আন্দোলনে ঐক্য এনে দিয়েছে। ১৯৬৫ সালে আলাবামাতে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের কর্মী শ্বেতাঙ্গিনী ভায়োলা লুৎসিকে খুন করা হয়। মরতে মরতে ভায়োলা গাইছিলেন, ‘উই শ্যাল ওভারকাম’।
১৯৬৫ সালের ১ এপ্রিল দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্সবার্গের জেলখানায় ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে জন হ্যারিসও এই গানটি গেয়েছিলেন। তারপর থেকে অনেকদিন দক্ষিণ আফ্রিকায় এই গানটি গাইতে দেওয়া হয়নি।

উই শ্যাল ওভারকাম-কৃষ্ণাঙ্গদের স্বাধীনতা আন্দোলনের গান। মানুষ এই গানটির শক্তিশালী, সম্মোহনী সুরকে তীব্র আবেগের সাথে গাইত। একজন গানটির নেতৃত্ব দিত, আর অন্যরা এক অন্যের হাত ধরে ক্রমান্বয়ে একবার এগোত, একবার পিছিয়ে যেত, গানের অনুচ্ছেদগুলোর পুনরাবৃত্তি করত।

বাংলা ভাষাতে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এগানটি বাংলায় অনুবাদ করেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। এই গান প্রথম বাংলায় গেয়েছেন কলকাতার ধর্মঘটের শ্রমিকরা, ‘এক দিন সূর্যের ভোর’ নামক অন্য একটি অনুবাদ করেন শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, যা রুমা গুহঠাকুর তার তত্ত্বাবধানে ক্যালকাটা ইউথ কয়ার রেকর্ড করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। বাংলায় এ গানটির কয়েকটি লাইন হলো,
আমরা করব জয়, আমরা করব জয়, আমরা করব জয় নিশ্চয় ।
আহা বুকের গভীরে, আছে প্রত্যয়, আমরা করব জয় নিশ্চয় ।
আমরা করব জয়, আমরা করব জয়, আমরা করব জয় নিশ্চয়।
এইতো গেল মুক্তযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। এরপর বাংলাদেশ স্বাধিন হলে, বাংলাদেশের ছায়াছবিতে ভূপেন হাজারিকা অনেক গান রচনা করেছেন, সুর দিয়েছেন অথবা কন্ঠ দিয়েছেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁর লেখা ও কন্ঠ দেয়া ছায়াছবির সে গানটি আজও অনেকে অবসরে শুনার চেষ্ঠা করেন। সে গানটির আরো কয়েকটি লাইন হলো,
“মেঘ থম থম করে কেউ নেই, নেই
জল থৈ থৈ তীরে কিছু নেই, নেই
ভাঙনের যে নেই পারাপার
তুমি আমি সব একাকার”।

এ গানের ছবি ‘সীমানা পেরিয়ে’ ১৯৭৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়। ছবিটি পরিচালনা করেন আলমগীর কবির। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এক ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিচালক এ ছবিটি নির্মাণ করেন। ছবিতে মূল ভূমিকায় ছিলেন, বুলবুল আহমেদ ও জয়শ্রী কবির। চলচ্চিত্রটি ১৯৭৭ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।
এ ছবিতে ভূপেন হাজারিকা শুধু নিজে গেয়ে নয়, সঙ্গীত পরিচালকও ছিলেন তিনি। তার মধ্যে ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার’। গানটির জন্য কণ্ঠশিল্পী ছিলেন, আবিদা সুলতানা।
এ প্রসঙ্গে আবিদা সুলতানার বক্তব্য ছিল, “একদিন জানতে পারি, সীমানা পেরিয়ে ছবিটির ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার’ গানে কণ্ঠ দিতে তাঁরা আমাকে নির্বাচন করা হয়েছে। তাও আবার ভূপেন হাজারিকার সুরে! এটা যে আমার জন্য কী আনন্দের ছিল, তা বলে বোঝাতে পারব না। তবে আনন্দের পাশাপাশি প্রচন্ড ভয়ও কাজ করছিল।

ভূপেন হাজারিকার জন্ম ৮ সেপ্টেম্বর ১৯২৬ ইংরেজি ভারতের অসমে। ব্যক্তিগত জীবনে ভূপেন হাজারিকা কানাডায় বসবাসরত প্রিয়ম্বদা প্যাটেলকে বিবাহ করেন। একমাত্র সন্তান তেজ হাজারিকা নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন।
ড. ভূপেন হাজারিকা তার ব্যারিটোন কণ্ঠস্বর ও কোমল ভঙ্গির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তার রচিত গানগুলি ছিল কাব্যময়। গানের উপমাগুলো তিনি প্রণয় সংক্রান্ত সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয় থেকে তুলে আনতেন। তিনি আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়ে লোকসঙ্গীত পরিবেশন করতেন।
সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকা ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ও মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। তার জন্মবার্ষিকী একসময় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন, পররাষ্ট প্রতি মন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধিনতা আন্দোলনে অবদান রাখার জন্য বিদেশী বন্ধু হিসাবে পুরস্কৃতও করা হয়।
ভূপেন হাজারিকা পেয়েছেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ভূষিত হয়েছিলেন ‘পদ্মভূষণ’, ‘অসমরতœ’, ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে’। সেরা সংগীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা তিনি অর্জন করেন। ভারত সরকার তাকে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ভারতরতœ’ পুরস্কারেও ভূষিত করে। যদিও তার পরিবার আসামে নাগরিকত্ব তালিকার প্রতিবাদে পুরস্কারটি গ্রহণ করেনি। তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘মানুষ মানুষের জন্যে’, ‘আমি এক যাযাবর’, ‘প্রতিধ্বনি শুনি’, ‘হে দোলা হে দোলা’ ও ‘চোখ ছলছল করে’। ২০১১ সালের ৫ নভেম্বর ৮৫ বছর বয়সে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। (চলবে)।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com