প্রচ্ছদ

যেতে যেতে পথে (১০)

  |  ১৯:১১, জুন ১৩, ২০২০
www.adarshabarta.com

কইতরি মাঝির উপাখ্যান, পর্ব-২

:: মুহম্মদ আজিজুল হক ::

সাতদিন পর আমাদের গ্রামের বাড়ী গোপীনাথপুর থেকে ফরিদপুরের পথে লঞ্চযোগে ভাটিয়াপাড়া পৌঁছলাম বিকেল তিনটের দিকে। ভাটিয়াপাড়া থেকে আমাকে ট্রেনে যেতে হবে মধুখালী। সময়সূচী অনুযায়ী ভাটিয়াপাড়ায় ট্রেন আসার কথা সাড়ে চারটায় এবং ওখানে ঘণ্টাখানিক অপেক্ষা করার পর ছেড়ে যাবার কথা বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। তাই হাতে দুই ঘন্টারও বেশি সময়। ভাবলাম কইতরি মাঝির সঙ্গে দেখা হলে তাঁর সাথে ঘণ্টাখানিক তো আলাপ করা যাবেই। লঞ্চ থেকে অবতরণ করেই জড়ো হওয়া নৌকাগুলিকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলাম, কইতরি মাঝির নৌকা কই? কয়েকজন তরুণ মাঝি প্রায় সমস্বরেই অন্য মাঝিদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এই, কইতরি চাচার নাও কো? এই যে ইনি, কইতরি চাচার নাও খুঁজতেছে।
পরপরই জবাবে কেউ কেউ বললো, আজ তো সারাদিন কইতরি চাচারে দেহি নাই। আজ মনে হয় চাচা আসে নাই।

শুনেই হতাশায় মনটা চুপসে গেল। লোকটাকে দেখার এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলার একটা দারুণ স্পৃহা আমার মনে জেঁকে বসেছে। অথচ তাঁর সাথে দেখা হলো না! আবার সেই কবে এদিকে আসবো! আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি; ছুটিতে ফরিদপুরের বাসায় যাই। কিন্তু এই দুষ্প্রবেশ্য গ্রামের বাড়িতে দুই তিন বছরে এক আধবারের বেশি আসা হয় না।
তিন বছর পরের কথা। সবেমাত্র অনার্স পরীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ সেই ধাপটি পার হয়ে পাখির মতো স্বাধীনভাবে উড়তে ইচ্ছে হলো। ফরিদপুরের বাসায় কিছুদিন আব্বা-আম্মা ও ছোট ভাইবোনদের সঙ্গে কাটিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলাম। ভাবলাম, এবার যাবার পথে কইতরি মাঝির সাথে ভাটিয়াপাড়ায় দেখা হবে। আশ্চর্য, সেবারও তাঁকে দেখতে পেলাম না। মনে হলো বিধি বাম; তিনি হয়তো চান না কইতরি মাঝির সঙ্গে আমার দেখা হোক। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ঐদিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনি কাজে ছিলেন। শরীর ভালো না থাকায় সন্ধ্যায় বাড়ি চলে গেছেন। অবশ্য, বাড়িতে তাঁর শূন্যঘরে একাকীত্বের হাহাকার! মা-বাবা পরকালে গিয়েছেন বহুকাল পূর্বেই; কোনো ভাইবোনও ছিল না তাঁর কখনো। যৌবনের শুরুতে কইতরির গভীর প্রেম-পরশে তাঁর অন্তরের ঊষর ভূমিতে জল সিঞ্চিত হয়। মরুভূমি মরুদ্যানে রূপান্তরিত হবার সকল লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু হতভাগা কইতরি মাঝির কপালে তা সয় না। অচিরেই কইতরি তাঁর জীবন থেকে হয় নিলীন। তো কার জন্য কইতরি মাঝি বাড়ি ফেরে? না, কেবল শারীরিক ক্লান্তিতে পড়ে থেকে ক্লান্তি হ্রাসের প্রয়াসে বাড়ি ফেরা তাঁর। চিরদুখী মানুষটির ওপর এখন বার্ধক্যের অপচ্ছায়া। তাই মাঝে মধ্যে তিনি কাজে আসেন না।

সেবার বাড়িতে দিনদশেক ছিলাম। বাড়িতে আমার এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলির আপনজনদের সান্নিধ্যে সময়টি ছিল আনন্দে ভরপুর। গ্রামের লঞ্চঘাটে সময়মতই লঞ্চ আবির্ভূত হলো। ভাটিয়াপাড়া যখন পৌঁছলাম তখন অপরাহ্ন দুটো। লঞ্চের গা ঘেঁষে ঘাটে পরপর দাঁড়িয়ে আছে বেশ অনেকগুলি কেরায়া নৌকা। লঞ্চের এক-তক্তার সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে নৌকাগুলির দিকে দৃষ্টি রাখতেই দেখি জনাবিশেক মাঝি নিজ নিজ নৌকার সামনের গলুইতে দাঁড়িয়ে যাত্রীদেরকে তাদের নৌকায় ওঠার জন্য আহবান করছেন। সবাইকে দেখামাত্র আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে কইতরি মাঝি সেখানে উপস্থিত। আমি দ্রুত তাঁর নৌকায় গিয়ে উঠতে উঠতেই জিজ্ঞেস করলাম, আপনিই তো কইতরি চাচা, তাই না? একজন অপরিচিত লোক তাঁকে “কইতরি চাচা” বলে সম্বোধন করায় তিনি ঈষৎ অপ্রতিভ হলেন। ওষ্ঠাধর একটু লজ্জামিশ্রিত স্মিত হাসিতে বিস্তৃত হলো। এতো মাঝিদের মাঝে দীর্ঘ ও সুঠামদেহী, গৌরবর্ণবিশিষ্ট ও সুদর্শন কইতরি মাঝিকে চিনতে আমার এতটুকু অসুবিধে হয় নি। ছ’ফুটের ওপরে লম্বা, মেদহীন আঁটসাঁট শরীর, মোটাসোটা হাতের কব্জি ও পায়ের গোছা। বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ বছর। মাথায় অযত্নে লালিত রুক্ষ ও সাদাকালো বাবরি চুল, সংকীর্ণ ভিত্তির ওপর উপবিষ্ট সরু ও উন্নত নাসিকা। মুখে নাতিদীর্ঘ শ্মশ্রু, এবং বার্ধক্যজনিত ও রোদবৃষ্টিতে বারংবার খোলামেলাভাবে চলার কারণে কপালের দু’পাশে বিভিন্ন আকারের বেশ ক’টি লালচে-কালো দাগ। সংকর বাঙ্গালি জাতির এই সদস্যটির দর্শনদারিতে অবাঙ্গালির বৈশিষ্ট্যই অধিক। তাঁর দৈহিক বর্ণে ও গড়নে আর্যের প্রভাব অনেক বেশি, দ্রাবিড়ের কম। আমার মনে হলো কেরায়া নৌকার মাঝি না হয়ে যুবক বয়সে কোনো বৃটিশ বা আমেরিকান এ্যাডভেঞ্চার মুভির দুঃসাহসিক নায়ক হলে তাকে মানাতো ভালো। কৈশোর ও যৌবনে যে তিনি কত বেশি সুদর্শন ছিলেন তা অনুমেয়। তো এই হলো কইতরি মাঝি! কোনো মেয়ে যে এমন সুপুরুষের প্রেমে পড়বে এতে আর আশ্চর্য হবার কি আছে? আমি তাঁকে বললাম, “চাচা, আমি আপনাকে বেশ আগে থেকেই চিনি। আমার দেশের বাড়ি এদিকেই। বছর দুই তিন পরপর আসি যাই।

ততক্ষণে আরো কয়েকজন যাত্রী কইতরি মাঝির নৌকায় উঠে এলো, সকলেই পুরুষ মানুষ। নৌকাযোগে লঞ্চ থেকে ভাটিয়াপাড়া বাজারে পৌঁছতে আধাঘন্টার মতো সময় লাগে। সহযাত্রীদের একজনের কথা থেকে বুঝলাম তিনি কইতরি মাঝির সাথে পূর্ব থেকেই পরিচিত। লঞ্চঘাট থেকে নৌকা ছাড়লেন কইতরি মাঝি। একটু খেয়াল করতেই নজরে এলো যে কইতরি মাঝি বেশ আনমনা, তাঁর ডান চোখটি অনবরত সামান্য সংকুচিত হয়েই আবার প্রসারিত হয়ে স্বাভাবিক আকারে ফিরছে; এবং মাঝে মাঝে তিনি বিড়বিড় করে আপন মনে কী যেন বলছেন। মনে হলো কি এক আচ্ছন্নতায় উদাস তিনি। তথাপি তাঁর বৈঠার তেজস্বী টানে নৌকা বেশ দ্রুত এগোচ্ছে। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতেই আমি সাহস করে তাঁকে বললাম, চাচা, তিন বছর আগে এক রাতে ট্রেন থেকে নেমে আমি এমনই এক নৌকায় করে লঞ্চের দিকে যাচ্ছিলাম। তখন আপনিও আপনার নৌকায় যাত্রী নিয়ে লঞ্চের দিকে যাচ্ছিলেন। আমাদের নৌকায় বসেই আপনার গান শুনছিলাম। কী মিষ্টি গলা আপনার! এখন কি একটা গান গেয়ে শুনাবেন? কইতরি মাঝির পূর্ব পরিচিত লোকটিও আমার প্রস্তাবটি সমর্থন করে বললো, হ চাচা, একটা গান ধরেন।
আমাদের কথায় যেন কইতরি মাঝির আচ্ছন্নতা উবে গেল। তিনি বললেন, আজকাল আর গান গাতি ভালো লাগে না, বাবা। মনডার মতো শরীলডাও আর ভালো থাহে না। একথা বলে তিনি সাত-আট সেকেন্ড নীরব হয়ে থাকলেন। এ কয়েক মুহূর্ত সময়ে জলের সঙ্গে তাঁর শক্ত ও লম্বা বৈঠাখানার মিথস্ক্রিয়ার ছন্দময় আওয়াজই শুধু সেই নীরবতাকে হালকা করছিলো। একটু খাঁকারি দিয়ে গলা ঝেড়ে কইতরি মাঝি তাঁর দরাজ কণ্ঠে গান ধরলেন,

“তোমার লাগিয়া রে
সদাই প্রাণ আমার কান্দে বন্ধুরে…………..
আমায় ফাঁকি দিয়ে ফেলে গেলি রে বন্ধু।
না পুড়াইলি আশা…………………
প্রাণ বন্ধু কালিয়া রে।”

কইতরি মাঝির কন্ঠে বরেণ্য গায়ক আব্দুল আলিমের এই গানটি শুনে খ্যাতিমান ইংরেজ রোম্যান্টিক কবি শেলীর বিখ্যাত কবিতা To a Skylark-এর অমর দু’টি চরণ মনে এল, “Our sincerest laughter/With some pain is fraught;/Our sweetest songs are those that tell of saddest thought.” ভাবলাম, দুঃখ-প্রকাশক বিষণ্ন সংগীতগুলো কেন আমাদের কাছে এত প্রিয় হয়? কেন ওগুলো শ্রবণে মন এত বিকম্পিত হয়? ঐ দুঃখ-জাগানো সংগীতগুলি কেন হৃদয়ে যুগপৎভাবে বিপরীতমুখী অনুভূতির ঝড় তোলে? কেন আমরা একই সাথে ব্যথিত ও আনন্দিত হই? হৃদয়ে দুঃখবোধের ঝঞ্ঝা জাগানো এসব গানে কেন আমরা বারংবার প্রত্যাবর্তন করি? আমি ভাবি, আমাদের হৃদয়-অভ্যন্তরে একটি সুপ্ত বীণা আছে, যার তারগুলি আমাদের মনে আনন্দ ও বেদনার অনুভূতি সঞ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তবে সেই বীণার মূল ও গভীর সুরধারাটি দুঃখের, বেদনার ও বিয়োগবিধুর। বীণার সেই মূল সুরটি আমাদের মানসকে বেশি প্রভাবিত করে; তাই ওটিই আমাদের অধিক প্রিয়।

আমাদের নৌকা ভাটিয়াপাড়া বাজারঘাটে পৌঁছে গেল। আমি পরিকল্পিতভাবে সবার পরে নামার জন্য একটু দেরি করলাম। পাঁচ টাকা ভাড়া সত্ত্বেও কইতরি মাঝিকে দশ টাকার একটি নোট দিয়ে প্রস্থানের ভান করতেই তিনি আমাকে পিছন থেকে ডেকে উঠলেন। বললেন, বাবা, ভাড়া তো পাঁচ টাহা, আপনি পাঁচ টাহা ফেরত পাবেন; ন্যান। বলে আমাকে অতিরিক্ত পাঁচ টাকা ফেরত দেবার জন্য হাত বাড়ালেন।
আমি বললাম, চাচা, আমি ইচ্ছে করেই আপনাকে পাঁচটি টাকা বেশি দিয়েছি।
-ক্যান বাবা, ক্যান বেশি দিলেন?
-আপনি এত ভালো কেন? তাই ইচ্ছে হলো একটু বেশি দিতে।
-আমার মধ্যি ভালো কি আছে, বাবা?
আমি তাঁর ঐ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বললাম, চাচা আমি তো ট্রেনে যাবো। ট্রেন আসতে এখনো ঘন্টা দুই বাকি। আপনার সময় থাকলে, চলুন না ঐ চায়ের দোকানে বসে আপনার সাথে একটু গল্প করি!

কইতরি মাঝি ইতস্তত করতে করতে সম্মত হলেন। আমি তাঁকে নিয়ে নৌকাঘাটের ঠিক পাশে অবস্থিত একটি চায়ের দোকানে প্রবেশ করে নিরিবিলি একটি টেবিলে বসেই দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম।
-আমি চা খুব এট্টা খাই নে, বাবা।
-এখন না হয় একটু খেলেন আমার সাথে!
তিনি আর আপত্তি করলেন না। দোকানিকে চায়ের সঙ্গে কয়েকখানা বিস্কুট দিতেও বললাম। অতঃপর, কইতরি মাঝিকে বললাম, চাচা আমি শুনেছি আপনার কৈশোরে আপনি কইতরি নামক একটি মেয়েকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আপনার সঙ্গে তার বিয়ে হয় নি; এবং লোকে ভাবে সেই কারণেই আপনি আর বিয়েশাদী করেন নি। আপনার এমন খাঁটি এবং গভীর প্রেমের দৃষ্টান্ত তো সমাজে খুবই বিরল। আপনার কাহিনীটি আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। আমাকে এ বিষয়ে একটু বিস্তারিত বলবেন কি?
এমন প্রৌঢ় বয়সে কারো নিকটে, তা আবার তাঁর বয়সের অর্ধেকেরও কম বয়সী কারো কাছে, তাঁর নিজের প্রেম-কাহিনী বর্ণনা করতে হবে ভেবে তিনি যে বেশ বিব্রতবোধ করলেন তা তাঁর চোখ-মুখের অভিব্যক্তিতে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠলো। বললেন, এই বয়সে ঐ পুরনো কাহিনী বলতে চাই নে, বাবা। আর তা শুনে আপনিই বা কি করবেন? আমার বিয়েসাদি হলে আমার ছাউয়াল-মাইয়ারা বয়সে আপনার চাইতেও বড় থাকতো। আপনার কাছে সে কাহিনী বলতি তো আমার শরম করতিছে।
-শরমের কিছু নেই, চাচা। আপনাদের দু’জনের ভালোবাসাকে আমি সম্মান করি। আপনাদের ভালোবাসা প্রকৃ্ত ও নজীরবিহীন একটি ভালোবাসা ছিল। তাই কাহিনীটি আমি আপনার মুখ থেকেই শুনতে আগ্রহী। আর আপনার কোনো সন্তান থাকলে যেহেতু সে আমার বয়সী হতো, তাই আপনি আমাকে তুমি করে বলতে পারেন।
-না, না, বাবা, আপনি শিক্ষিত্ মানুষ; আপনারে তুমি কওয়া আমার সাজে না। ঠিক আছে আপনারে গল্পডা আমি বলতিছি। তয় জীবনে এই পেরথম কেউরে আমি নিজের কথা বলতিছি। আপনার ব্যবহার এত মধুর তাই আপনারে না কথিও পারতিছি না।

এরপর কইতরি মাঝি আমাকে তাঁর প্রেমকাহিনী বলতে শুরু করলেন। কইতরি মাঝির প্রকৃ্ত নাম হাবিবুর রহমান। গ্রামের লোকেরা ডাকতো হাবিব। কইতরির ভালো নাম ছিলো কুলসুম বেগম। বাবা-মায়ের আদরের ডাক ছিলো কইতরি, অর্থাৎ কবুতর। কইতরিরা ছিলো তাঁদের গ্রামেরই একটি সচ্ছল ও বর্ধিষ্ণু পরিবার। তার বাবা বেশ জমিজমার মালিক ছিলেন; সাথে পাটের ব্যবসা। বাবার ইচ্ছে ছিল মেয়েকে আইএ, বিএ পাশ করাবেন এবং বড় কোনো চাকুরের সাথে বিয়ে দেবেন। কইতরিদের বাড়ি থেকে হাবিবদের বাড়ি ছিল প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে। আর যে হাইস্কুলে কইতরি পড়তো তা ছিল ঐ পথে আরো আধা কিলো্মিটার দূরে। যেতে হতো হাবিবদের বাড়ির সম্মুখের রাস্তা দিয়েই। কইতরির জন্মের চার-পাঁচ বছর পর তার একটা ভাইয়ের জন্ম হয়। কিন্তু ভাইটি জন্মের তিনদিন পরেই মারা যায়। আর কোনো ভাইবোন হয় নি তার। তাই কইতরিকে ঘিরেই ছিলো তাঁর বাবা-মার সব স্বপ্ন; সব সাধ।

নদী যেমন সাগরের সন্ধানে বিভোর হোয়ে পথ চলে, স্কুলে যাওয়া-আসার পথে প্রণয়াসক্ত কইতরির চোখ দু’টিও তেমনি হাবিবের সন্ধানে ফেরে। দেখা হলে স্মিত হাসিতে কইতরি হাবিবের দিকে তাকায়। তার সে হাসিতে পল্লবঘেরা বিষণ্ন পল্লীপথপার্শ্বের মঞ্জুল বঞ্জুলও বিদ্যুদ্দীপ্ত হয় চকিতে। আর হাবিবের তারুণ্যভরা হৃদয় সে তড়িতালোকে হয় রোমাঞ্চিত; অনির্বচনীয় পুলকে পুলকিত। কুলসুম ওরফে কইতরি দুষ্টু হাসি হেসে হাবিবুর রহমান ওরফে কইতরি মাঝিকে লক্ষ্য করে ছোটখাটো প্রশ্ন ছুড়তো, কি হাবিব ভাই, শুনলাম নাওয়ের মাঝি হইছো? ঈষৎ অপ্রতিভ হয়ে হাবিবুর রহমান জবাব দেয়, হু, কাজ তো একটা করতি হবি। আমার তো আর তুমাগে মতো পয়সাকড়ি নাই যে বসে বসে খাবো।
তাতো বটেই; তা তুমার মতো চ্যাংড়া মাঝির নায়ে কি যাত্রীরা ওঠে?
ওঠে তো। উঠফি না ক্যা? আমি কি আর নাও চালাতে পারি নে?
না, মানে আমার মতো সুন্দরী মাইয়্যারা কি ওঠে তুমার নায়ে? আর উঠলি তুমার দুই ঠ্যাং কাপতি কাপতি তুমি পানিতে পড়ে যাও কি না?
প্রথম প্রথম দুষ্টু কুলসুমের এমনতর প্রশ্নে নৌকার বৈঠার মতো অবক্র, সহজ, সরল মন ও মানসের তরুণ সুদর্শন যুবক হাবিবুর রহমানের গাল ও কর্ণদ্বয় সহসাই রক্তের মতো লাল হয়ে উঠতো। কিন্তু ক্রমে ক্রমে সে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে কুলসুমের মধুর বাক্যবাণ মোকাবেলায়। সে উপলব্ধি করে যে আকাশঢাকা মেঘের ফাঁক গ’লে মাঝে মাঝে যেমন কোরে অপ্রত্যাশিতভাবে সূর্যালোক ভূ-পৃষ্ঠে পৌঁছোয়, তেমনি কোরে তার মনোমধ্যে একটি অপ্রতিরোধ্য প্রণয়রশ্মি যেন আপতিত হচ্ছে কোথাও থেকে। ভালোবাসার সেই রশ্মিটি ধরে মনে মনে সে এগোতে থাকে তার উৎসের খোঁজে। অবলীলায় সে পৌঁছে যায় কুলসুমের হৃদয়ের গভীরে; সেখানেই এক ভয়মিশ্রিত আনন্দে সে আবিষ্কার করে সেই প্রণয়রশ্মির উৎস। কুলসুমের মতো দীর্ঘাঙ্গী, উজ্জ্বল বর্ণ ও আকর্ষণীয় মুখাবয়ব ও দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী ধনী পরিবারের কোনো মেয়ে যে তার মতো দরিদ্র ও কার্যত অশিক্ষিত কোনো পুরুষকে ভালোবাসতে পারে, তা সে বিশ্বাসই করতে পারে না। সে যেন এক অজানা বিপদের অশনি সংকেত দেখতে পায়।
(চলবে………………)

লেখক: কবি, সাহিত্যিক ;
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত