প্রচ্ছদ

যেতে যেতে পথে (১০)

  |  ১৩:৫৮, জুন ০৬, ২০২০
www.adarshabarta.com

Manual8 Ad Code

কইতরি মাঝির উপাখ্যান, পর্ব-১

Manual8 Ad Code

:: মুহম্মদ আজিজুল হক ::

মনে পড়ছে সেই ‘কইতরি মাঝি’র কথা, যাঁর প্রকৃত নাম প্রায় সকলেই বিস্মৃত হয়েছিল। যাহোক, সে উপাখ্যানে একটু পরে আসছি। গত শতাব্দীর ষাট এবং সত্তুরের দশকে ফরিদপুর শহর থেকে গোপালগঞ্জের গোপীনাথপুরে আমাদের গ্রামের বাড়ীতে যেতে আঠারো থেকে বিশ ঘন্টা সময় লাগতো। মধুখালীতে সন্ধ্যা সাতটার ট্রেন ধরবার উদ্দেশ্যে বিকেল চারটের দিকে আমরা ফরিদপুর হতে বাসযোগে আনুমানিক ২০ মাইল দূরের মধুখালীর উদ্দেশ্যে রওনা হতাম । অনেক সময় লাগতো মধুখালী পৌঁছতে। কারণ, সে রাস্তার কোথাও ছিলো পাকা, কোথাও কাঁচা, কোথাও শুধু হেরিংবোন বন্ডে ইট সাজিয়ে বসানো। বলা বাহুল্য, যাত্রা মসৃ্ন ও আরামদায়ক ছিলো না। মধুখালী পৌঁছে ট্রেনের অপেক্ষায় স্টেশনে অধীর প্রতীক্ষার প্রহর গুনতাম। সময়মত গাড়ীর আবির্ভাব ঘটা পরম সৌভাগ্যের বিষয় ছিলো। ট্রেন প্রায়শঃই তিন চার পাঁচ ঘন্টা বিলম্বে আসতো। গাড়ীর আগমনের মিনিট পাঁচেক পূর্বে স্টেশনের ঘন্টা বাজানো হতো। তখন অপেক্ষার ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়া যাত্রীদের মাঝে নতুন করে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিতো। ট্রেনে ওঠবার জন্য সকলেই দ্রুত প্রস্তুতি নিতো। গাড়ী স্টেশনে ভিড়তেই সকলেই হই-হুল্লোড় করে যে যেখানে পারতো দ্রুত বসে পড়তো। গাড়ীতে উঠতে পারার সে কী আনন্দ! ট্রেনটিতে ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্ট কখনো থাকতো বলে মনে পড়ে না। থাকতো ইন্টার ক্লাস এবং থার্ড ক্লাস। লক্কড় মার্কা সেই রেলগাড়ীর কোনো কিছুই যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো না। গাড়ীর গতি বোধকরি কখনোই ঘন্টায় তিরিশ-পয়ত্রিশ মাইলের ওপর উঠতো না। কিন্তু চলবার সময় গাড়ীর দরোজা জানালা যেহেতু বন্ধ করা্র কোনো কালচারই ছিলো না, তাই ঝড়ের শব্দ ও গতি নিয়ে বাতাস ঢুকতো প্রতি কমপার্টমেন্টে। সাথে থেকে থেকে কয়লার কিছু অদৃশ্য ছাই। ওদিকে শতপদী কীটের মতো অগণিত লৌহ-চাকায় ততক্ষণে তবলার তাল উঠতো। সেই তালের আওয়াজের সাথে নিজের মনের যে কোনো বাক্য মিলানো যেতো। মনে মনে তুমি যে বাক্যই আওড়াও না কেন দেখবে রেলগাড়ীর চাকার তবলা সহস্রবার সেই কথাটিরই পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। আজকালকার ইলেকট্রিক ট্রেনের চাকায় সেই তবলা আর বাজে না। এ প্রসঙ্গে যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’-এর একটি কথা খুব মনে পড়ছে, “বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ।” আমাদের একালে বিজ্ঞান রেলগাড়ীতে যুক্ত করেছে আরো বেগ, কেড়ে নিয়েছে প্রাচীনকালের্যে রেলের চাকার নৃ্ত্যে সৃষ্ট তবলার আবেগ। দৈত্যের শক্তিধারী স্টীম এঞ্জিনের জ্বালানী ছিলো কয়লা। কালো ধোঁয়া উদগীরণকারী গাড়ীর সেই স্বল্প গতিকেই তখন রকেটের গতি মনে হতো। ফাঁকা জায়গা দিয়ে চলার সময় যত না শব্দ হতো, রেল্ লাইনের দু’পাশে চেপে আসা বাড়িঘর গাছপালার মধ্য দিয়ে যাবার সময় মনে হতো এক প্রলয়ংকরী ঝড় উঠেছে পৃ্থিবীতে। মধুখালী থেকে প্রায় ৩০ মাইল দূরের ভাটিয়াপাড়া পৌঁছতে ঘন্টা দুই সময় লেগে যেতো। মাঝখানের স্টেশনগুলি ছিলো ঘোড়াখালী, ঘোষপুর (সাতৈর), বোয়ালমারী, সহস্রাইল, ব্যাসপুর, কাশীয়ানী, ইত্যাদি। ভাটিয়াপাড়ার মাটিতে পা রাখতেই মনে হতো যেন আমার আপন ভিটেয় পৌঁছে গেছি। বাপ-দাদা, পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির প্রাণ-ভরানো গন্ধ। ভাটিয়াপাড়ার পাশেই আমার অন্তরে প্রবাহিত সেই গভীর জলধারা; আমার প্রিয় নদী মধুমতি। হায়রে, আমার প্রিয় মধুমতি আজ মৃতপ্রায়! কিন্তু সেকালে মধুমতির ছিলো ভরা যৌবন; লাস্যময়ী অপরূপা এক রমনী যেন।

ট্রেনের অতিশয় বিলম্বের কারণে ভাটিয়াপাড়ায় পৌঁছতে প্রায়ই রাত বারোটা একটা বেঁজে যেতো। ভাটিয়াপাড়া থেকে মধুমতি দিয়ে লঞ্চযোগে গোপীনাথপুর পৌঁছতে হতো। সময় লাগতো ঘন্টাদুই। কিন্তু গভীর রাতে ঐ রুটে লঞ্চ চালানো বন্ধ থাকতো। ভাটিয়াপাড়ায় লঞ্চ আসতো খুলনা থেকে। বহু দূরের পথ পাড়ি দিয়ে। দিনরাত্রির চব্বিশ ঘন্টায় গোটাতিনেক বড় লঞ্চ ঐ পথে আসাযাওয়া করতো । যাত্রী এবং মালপত্রে বোঝাই থাকতো সে সব জলযানগুলি। সেকালে গোপালগঞ্জ, যশোর নড়াইল, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিম অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা ছিলো খুলনাকেন্দ্রিক। দৌলতপুর শিল্পাঞ্চল ছিলো বৃহত্তর খুলনা শহরের অন্তর্গত ।ঐ অঞ্চল অধ্যুষিত জনগণের জন্য রাজধানী ঢাকা ছিলো দুরধিগম্য। খুলনায় যাতায়াত ছিলো তুলনামূলকভাবে কম কষ্টসাধ্য । চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কেনাকাটা, পড়ালেখা, ইত্যাদির জন্য ঐ অঞ্চলের প্রধান শহর ছিলো খুলনা । এসকল কারণে, বৃহত্তর খুলনা শহর ছিলো দিবারাত্র লোকারণ্য, কর্মমুখর। দেশের রোড নেটওয়ার্ক ছিলো খুব অনুন্নত। অধিকাংশ নদ-নদী, খাল, বিল, ইত্যাদির ওপর সেতু না থাকায় যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের প্রধান মাধ্যম ছিলো নৌপথ। নদী, খাল, বিলের নাব্যতা ছিলো সাংবাৎসরিক। ভাটিয়াপাড়ায় পৌঁছে ট্রেন থেকে নামতেই আমার দৃষ্টি কাড়তো ওখানকার জেনারেটরচালিত ওয়ারলেস স্টেশনের দেড়শ’ ফুট উঁচু মাস্টটি, যেটি হয়তো আজও বিদ্যমান ভাটিয়াপাড়ার ল্যান্ডমার্ক হিসেবে। সম্ভবতঃ বৃটিশ আমলে স্থাপিত ঐ ওয়ারলেস স্টেশনটি্ ভাটিয়াপাড়ার গুরুত্বকে বৃ্দ্ধি করেছে সেই তখন থেকেই। মাস্টের মাথায় ও মাঝামাঝি উচ্চতায় বসানো লালবাতিদ্বয় জ্যোৎস্নাহীন রাত্রিতে বহুদূর হতে দৃষ্ট হতো। নদীপথে ভাটিয়াপাড়া অভিমুখে আগমনরত নৌযানসমূহের জন্য সেগুলো আজো এক ধ্রুব বাতিঘর।

Manual7 Ad Code

ট্রেন থেকে নেমে ভাটিয়াপাড়া বাজারের মধ্য দিয়ে হেঁটে একটি খালপাড়ের নৌকাঘাটে যেতে হতো। দিবালোকে মুখর মফস্বলের এই ছোট্ট বাজারটি তখন থাকতো নিশীথের নিশুতি কোলে বেঘোরে নিদ্রিত । রাত্রির সকল যাত্রীর পদধ্বনিতে তার নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটতো। বাজার সংলগ্ন খালপাড়ের নৌকাঘাট থেকে লঞ্চঘাট ছিলো প্রায় এক কিলোমিটার দূরে, নদীর একটি বাঁকসন্নিকটে। অধিকাংশ যাত্রীগণ, বিশেষ করে যাঁদের পরিবার সঙ্গে থাকতো, তাঁরা ঐ পথটুকু কেরায়া নৌকায় যেতেন। উদ্যমী তরুণ ও যুবকদের কেউ কেউ হেঁটেই চলে যেতো।

সেবার আমার এক চাচাতো ভাই গোপীনাথপুর হতে ফরিদপুরে আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। মাহবুব ভাই। আমি তখন সেভেন বা এইটের ছাত্র। মাহবুব ভাই ছিলেন আমার চেয়ে সাত-আট বছরের বড়। বাড়ীতে প্রত্যাবর্তনকালে আমি তার সঙ্গী হলাম। ভাটিয়াপাড়ার নৌকাঘাটে পৌঁছিয়েই ত্বরিৎ একটি নৌকায় আরোহণ করলাম আমরা । তখন অন্যান্য নৌকায়ও অনেক যাত্রীরা উঠতে শশব্যস্ত । সবাই ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন । অনেকগুলি ছইয়া নৌকা একসাথে ছুটছে অন্ধকার খাল দিয়ে লঞ্চের উদ্দশ্যে। আকাশে চাঁদ নেই। একটা হালকা মিষ্টি হাওয়া দিচ্ছে প্রকৃ্তিতে। প্রত্যেক নৌকা থেকে হারিকেন ল্যানটার্নের অনুজ্জ্বল আলো খালের ঝিরিঝিরি ঢেউয়ে পতিত হয়ে নৃ্ত্যমান । নৌকার সম্মুখগতির কারণে উত্থিত ও ক্রমশ অপসৃ্য়মান ভিন্ন আরেক মৃদু টানা-ঢেউ ঝিরিঝিরি ঢেউগুলিকে ভেঙ্গে দেয়ায় জলপৃষ্ঠে বিশৃংখলা সৃষ্টি হচ্ছে। তাতে করে প্রত্যেকটি লন্ঠনের আলো জলে নানাদিকে রিফ্রাক্টেড হয়ে অনেকখানি জায়গায় হতো বিস্তৃত। হঠাৎ করেই অনতিদূরের একটি নৌকা থেকে গানের সুর ভেসে এলো। আর সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের নৌকার তরুণ মাঝি বলে উঠলো, “ঐ দ্যাহেন, পাগলা কইতরি চাচা গান ধরছে। কইতরির গান। ওনার কোনো কিলান্তি নাই। সারাক্ষণ খালি কইতরি আর কইতরি আর কইতরি।”
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কইতরি চাচাটা কে?
–ঐ যে গান শুনতিছেন না? ঐডাইতো কইতরি চাচা। আমরা ডাহি চাচা। আমার বাপের বয়সী লোকজন ডাহে ভাই।
মাহবুব ভাই বললেন, বাহ্! সুন্দর গলা তো!
আমাদের মাঝি ছেলেটা আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে মাহবুব ভাই বললেন, আচ্ছা, শুনতে দাও না গানটা!

আশেপাশের নৌকাগুলোয় কেউ কেউ কথাবার্তা বলছিলো। তাঁরাও যেন নিশ্চুপ হয়ে গেলো। তখন স্পষ্টভাবে সুরতরঙ্গ কর্ণবিবরে প্রবেশ করলো। সাথে নির্দিষ্ট তালে জলে বৈঠার প্রবেশ ও জল থেকে বৈঠার নিষ্ক্রমণের শব্দ –ঝুপ-চারাৎ, ঝুপ-চারাৎ, ঝুপ-চারাৎ –কইতরি মাঝির সঙ্গীতে তবলার ধ্ব্নিস্পন্দ সংযোজন যেন। কী সুরেলা দরাজ কন্ঠ! কইতরি মাঝি গাইছেন, স্বরচিত সঙ্গীত, নিজেই করেছেন সুরারোপঃ-
“ওরে আমার এতো সাধের কইতরী
ছাইড়া মোরে উইড়া গেলি
কোন বাড়ি………..
এ জীবনে এই যাতনার অন্ত নাই
তোরে বিনে বাঁচার আমার
সাধ নাই।
ওরে আমার সর্বনাশা
কইতরি”…………
সঙ্গীতজ্ঞ, এবং প্রশিক্ষিত ও বরেণ্য গায়ক-গায়িকাদের বিচারে হয়তোবা অনেক অপাংক্তেয় ছিলো গীতিকার, সুরকার ও গায়ক কইতরি মাঝি। কিন্তু আমার মতো যারা সঙ্গীতের সুর, তাল, লয়, রাগ-রাগিনী সম্পর্কে বিশেষ অজ্ঞ তারা সকলেই কইতরি মাঝির গান শুনে যে মুগ্ধ হবেন, এ বিষয়ে আমার সন্দেহ রইলো না। এ গান তার বিরহবিধুর অন্তরের নিরন্তর হাহাকার। প্রেমাস্পদকে হারানোর সঞ্চিত বেদনার বিরামহীন ক্যাথারসিস; মর্মবেদনা নিষ্ক্রমনের একমাত্র পথ। গান শুনে মাহবুব ভাই বললেন, বাহ্! চমৎকার তো! রেডিওতে ওঁর চান্স পাওয়া উচিত।

Manual1 Ad Code

আমাদের মাঝি কুদ্দুসকে জিজ্ঞেস করলাম, কইতরি মাঝি কি শুধু এই একটা গানই গায়? ও জানালো, “নাহ্! রেডিওতে আবদুল আলিমের গান আছে না? তাও উনার ভারী পছন্দ। সর্বনাশা পদ্মা নদী, হলুদিয়া পাখি, –এইসব গান উনার মুখস্ত। এগুলোও উনি গায়। তয় সবচাইয়ে পছন্দ উনার কাছে ঐ কইতরির গানডাই। অনেক দরদ লাগায়ে গায়।”
আমার মনে হলো কইতরি মাঝির কথা বলতে পেরে কুদ্দুস খুব আনন্দিত। তাঁকে নিয়ে হয়তো কুদ্দুস গর্বিতও। তাই আরো প্রশ্ন রাখলাম ওর কাছে।
–আচ্ছা ওঁনার নাম কইতরি মাঝি হলো কেন, বলো তো?
–ও এই কথা। একথা তো স-বা-র জানা। গিরামের এক টাকাপয়সাওয়ালা লোকের মাইয়া ওনার পেরেমে পড়ছেলো। ঐ মাইয়ার আসল নাম কি ছেলো জানি না। তয় ডাকনাম ছেলো কইতরি, মানে কবুতর।
মাহবুব ভাই ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, মেয়েটা ওনার প্রেমে পড়েছিলো, না উনি মেয়েটার প্রেমে পড়েছিলেন?
–না, মাইয়াডাই আগে ওঁনার পেরেমে পড়ছেলো; পরে কইতরি চাচা তার পেরেমে পড়ে। আর মাইয়াডা পড়বিই বা না ক্যা?
–আমি বললাম, ‘কেন পড়লো’?
–আপনারা যদি কইতরি চাচারে দ্যাহেন তাহলি বুঝতি পারবেন কইতরি ক্যান উনার পেরেমে পড়ছেলো। উনার মতো দেখতি সুন্দর মানুষ আশেপাশের দশ গিরামে ছেলো নাকি? ওই তো উনি, বেশি দূরি না। কিন্তু অন্ধকারে দ্যাখফেন ক্যাম্বালা? এহন তো উনার আগের সেই চেহারা নাই। বয়েস অইছে, আর খাটাখাটনিতে সেই চেহারা তো নাই! তয় দেখলি আজো বুঝা যায় জ়োয়ানকালে উনি কিরম ছেলেন। ফর্সা, লম্বা, রাজার লাহান। গায়েও শক্তি ছেলো। আজো উনি পাল্লা দেলে উনার সাথে নৌকা বাইয়্যা পারবি কিডা? উনার বয়স যহন সতেরো, আঠারো তহন আশেপাশের দশ-বিশ গিরামের ফুটবল টিমে খেলার জন্যি চাচারে হায়ার করা হতো। মাঠের এক গোলপুস্টের কাছে থাইকা লাথি মারলি বল আরেক গোলপুস্টের কাছে যাইয়ে পড়তো। গায়ে এত জোর ছেল উনার। কিন্তু কইতরির সাথে যহন উনার বিয়ে হলো না, তহন থাইকা উনি আর ফুটবল খ্যালে নাই। আর উনার কথাবারতার কথা কি কবো! উনি কারোর সাথেই ঝগড়া-ফ্যাসাদে নাই। সগগলিই উনারে ভালোবাসে।
মাহবুব ভাই বললেন, “বলো কি? আশ্চর্য লোক তো!”
আর আমার মনোমধ্যে কইতরি মাঝিকে একবার দেখার এবং তার সঙ্গে আলাপনের একটি তীব্র স্পৃহার জন্ম হলো। মনের মধ্যে তাঁর প্রতি একটুখানি শ্রদ্ধাবোধও অনুভব করলাম। যাহোক, সে ইচ্ছে ও অনুভূতিকে আপাততঃ চাপা দিয়ে কুদ্দুসকে জিজ্ঞেস করলাম, “তা কইতরির সঙ্গে ওঁনার বিয়ে হয় নি কেন?
–হবি কি করে, মাইয়ার বাবা টাকাপয়সাআলা। মাইয়া সুন্দরী, তার উপর নাকি কিলাশ টেনে পড়তেছেলো। সেই আমলে কিলাশ টেনে পড়া মাইয়াগো জন্যি তো অনেক ছাওয়ালরাই ছেলো। আর কইতরি চাচা তো নাকি কিলাশ ছেভেনের পরে আর পড়ে নাই। ওনার বাবা মারা গেছিলো ওনার বয়স যহন মাত্তর দশ বছর। আর মা মারা গেছিলো বয়েস যহন উনার চোদ্দ পুনারো। মাইয়ার বাপে কয় মাইয়া কাইটা নদীতে ভাসায় দেবো, তবু ঐ গরীব, মিসকিন, অশিক্ষিত ছাওয়ালের সাথে বিয়ে দেবো না। ওর ঐ শরীলডা আর চেহারাডা ছাড়া আছেডা কি? মাইয়া নাকি ইন্দুর মারা্র বিষ খাইছেলো। কাজ অয় নাই। ডাক্তার তারে বমি করাইয়া সুস্ত করছেলো। পরে বাপে জোর কইরাই মাইয়ারে দূরের এক শিক্ষিত বেটার সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। কইতরি চাচা তহন থেইকাই পাগল। তহন থেইকাই জায়গা নাই অ্জায়গা নাই সময় নাই অসময় নাই, খালি কইতরি কইতরি কইরা চিল্লায়। কইতরির বাপে হুমকি দেছেলো মাইরা ফ্যালানোর। কিন্তু কইতরী চাচা কি ভয় পাওয়ার মানুষ? তার সেই চিল্লানো আজ পর্যুন্তু চলতিছে।
মাহবুব ভাই বললেন, “কোথায়? এখন কি চিল্লাচ্ছে?” কুদ্দুস বললো, “না। এ্য্যহোন চিল্লাচ্ছে না। উনার নায়ে যাততিরি থাকলি উনি চিল্লায় না। এতে যাততিরিদের অসুবিদা হতি পারে। তয় কেউ উনারে গান গাতি কলি উনি গান গায়।

Manual2 Ad Code

কিছুক্ষণ পর নৌকা লঞ্চের অবস্থানে পৌঁছে যায়। গভীর রাতের ঘাটে ভিড়িয়ে রাখা লঞ্চ। জলযানটির সাথে কুলু কুলু শব্দে আলাপচারিতারত বহমান মধুমতি। লঞ্চটির নীচের তলা ও ওপর তলায় গোটাতিনেক ব্যাটারীচালিত লাইট জ্বলছে। লাইটগুলো অনুজ্জ্বল; এই গভীর রাতে যেন ওরাও নিদ্রাতুর। লঞ্চের সারেং, এঞ্জিনচালক ও অন্যান্য কর্মচারীদের প্রায় সবাই নিদ্রিত। ট্রেনের যাত্রীগণ এ সময় লঞ্চে এসে পৌঁছায় বিধায় কেবলমাত্র লঞ্চে যাত্রীদের নামানো-উঠানোর দায়িত্বে আছে এমন একজন কর্মচারী জেগে আছেন।ষাট-সত্তুর জন যাত্রী এসে লঞ্চে উঠলেন। বাকীরা রেলগাড়ী থেকে নেমে অন্যান্য গন্তব্যে চলে গেছেন। রাতের বাকি সময়টা শুয়ে-বসে একটু ঘুমিয়ে নেবার জন্য হুড়োহুড়ি করে যে যেখানে পারছে জায়গা করে নিচ্ছে। মাহবুব ভাই ও আমি দ্রুত আপার ডেকের নাতিপ্রশস্ত কেবিনে গিয়ে উঠলাম। ততক্ষণে বেশ কয়েকজন ওখানে জায়গা করে নিয়েছেন। আমরা বসলাম। আমাদের পরে আরো কয়েকজন এলেন। সব মিলে পনেরো-ষোলজন। তার মধ্যে দু’টি পরিবার। একটু ঝিমিয়ে নেবার জন্য যেইমাত্র শরীরটা এলিয়ে বসেছি ঠিক সেই মুহূর্তে অদূরে এক গুরুগম্ভীর কন্ঠে ‘কইতরি’ শব্দের ব্জ্রনিনাদ। আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো লাফিয়ে উঠে সোজা হয়ে বসলাম। ঐতো সেই কই্তরি মাঝি! তাঁর সেই ‘কইতরি’ ডাক যেন আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনি তুললো। মধুমতির প্রশস্ত বুকের ওপর দিয়ে সে ধ্বনি এক শব্দকুন্ডলী হয়ে গড়াতে গড়াতে দূরের অন্ধকার দিগন্তে গিয়ে হয়তো আঘাত হানলো। আমি দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে লঞ্চের খোলা ডেকে গিয়ে সেই কইতরি ডাকের উৎস খুঁজে বের করতে ব্যাকুল হলাম। কিন্তু নদীর আঁধার-আবৃত বুকে বেশ কয়েকটি ছৈইয়া নৌকা থেকে হারিকেনের মৃদু, করুণ ও অপসৃয়মান আলো এবং নদীর ঝিরিঝিরি ঢেউয়ে সে আলোর এলোমেলো প্রতিফলন ব্যতীত আর কিছুই চোখে পড়লো না। ভাবলাম, সাতদিন পর আবার ফরিদপুরের উদ্দেশ্য এ পথে যখন ফিরবো তখন কইতরি মাঝির সাথে দেখা করবোই। (চলবে)।

লেখক: কবি, সাহিত্যিক ;
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code