প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-৪৬

  |  ১৯:০৩, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২০
www.adarshabarta.com

Manual6 Ad Code

বিয়ে-সাদীর সেকাল-একাল

:: মো. রহমত আলী ::

Manual7 Ad Code

বিয়ে-সাদি হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক সৃস্টির একটি অন্যতম উপাদান। অতীতে এটি অনুষ্ঠিত হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছে, আগামীতেও হবে। তাই এটি চীরন্তন। তবে বিভিন্ন ধর্মে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা বিভিন্নভাবে হয়। তাই এগুলির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন আমেজ পরিলক্ষিক হয়ে থাকে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিয়ের নানা রীতি প্রচলিত রয়েছে। কখনো এক সমাজের বিয়ের রীতি অন্য সমাজের বিপরীত। কোনো সমাজের বিয়ের রীতি আবার আরেক সমাজে হাসির ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এমন কি তা খুবই কৌতুহলপূর্ণও হয়ে থাকে। তাই স্থান,কাল, পাত্র ভেদে এগুলির আযোজন বা রীতিনীতি নানা প্রকার হয়ে থাকে।

বিয়ের ব্যাপারে চীনের ইতিহাস সুদীর্ঘ। আগেকার দিনে চীনে একটি বিয়ে উপলক্ষ্যে ৬টি অনুষ্ঠান হতো। বিয়ের দিনেও চীনের আরো কিছু মজার রীতিনীতি আছে। যেমন: বিয়ের দিন কনে লাল পোশাক পরে। শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় বাংলাদেশের কনেদের মত কাঁদতে হয়। এ সময় কনের বিদায়ের সময় বাবা-মাও চোখের জলে বুক ভাসায়। চীনের কোনো কোনো অঞ্চলে স্বামীর ঘরে প্রবেশের আগে কনেকে আগুন জ্বালানো একটি গামলা পার হতে হয়।

ফ্রান্সে সাদা রং বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রধান রং। সাজগোঁজের অলংকার, ফুল, কনের কাপড় সবই সেখানে সাদা হয়ে থাকে। তাই বিয়ের সময় যেদিকেই তাকাবেন সর্বত্রই সাদা আর সাদা ছাড়া আর তেমন কিছু দেখা যায় না।

তবে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে ঐতিহ্যবাহী ব্রিটিশ-রীতির বিয়ে অনুষ্ঠানে কনে পদ্মফুল হাতে রাখে। ব্রিটিশদের চোখে এই ফুল সৌভাগ্যের প্রতীক। ব্রিটিশরা তাদের বিয়ের কেক তৈরিতে হরেক রকম ফল ব্যবহার করা হয়। এ কেককে তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম পর্যন্ত রেখে দেওয়া হয়।

Manual6 Ad Code

জার্মানে বিয়ের পার্টিতে বর ও কনেকে কেন্দ্র করে নানা মজা করা হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপারটি হচ্ছে, নাচতে নাচতে আনন্দের সঙ্গে থালা-বাসন ছুঁড়ে ফেলা। এ সময় স্বামী যদি স্ত্রীকে দেখতে চায়, তাহলে স্ত্রীর বন্ধুকে ঘুষ দিতে হয়, নইলে স্ত্রীকে দেখার অনুমোদন দেয় না বন্ধুরা।

গ্রীসে কনেরা নিজের হাত মোজার ভেতরে কিছু মিষ্টির ক্যান্ডি রাখে। এ ব্যতিক্রমী কাজের কারণ, নিজের বিবাহিত জীবনকে আরো মিষ্টিময় করে তোলা ও তা লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে স্বামীকে দেয়া।

Manual3 Ad Code

রাশিয়ার বিয়ের অনুষ্ঠানে যে শব্দ সবচেয়ে বেশি শোনা যায়, তা হলো ‘তিক্ত’। অনুষ্ঠানে যদি কেউ উচ্চস্বরে বলে, “তিক্ত, তিক্ত”, তাহলে সবাই একসঙ্গে “তিক্ত” বলবে। আর স্বামী ও স্ত্রীকে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে চুমু খাবে। এরপর যতবার অতিথিদের মধ্য থেকে উচ্চস্বরে তিক্ত, তিক্ত বলা হবে, ততবার দম্পতিকে মিষ্টি চুমু দিয়ে অতিথিদের প্রতি সাড়া দিতে হবে।

আমাদের সমাজে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে আইনগত বিভিন্ন দিক। তবে প্রাথমিকভাবে অনেকগুলি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে উভয় পক্ষের মুরব্বীগনের মাধ্যমে। বাংলাদেশে ঘটকালী প্রথা এখনও চালু রয়েছে। তাদেরকে আঞ্চলিক ভাষায় “রায়বার’ বলা হয়ে থাকে। এ সমস্ত রায়বারগন ছেলে বা মেয়ের পক্ষ হয়ে প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি যাবতীয় যোগাযোগ রক্ষা করে থাকেন। এমতাবস্থায় তাদের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে ছেলে ও মেয়ে উভয়কে পরস্পরের কাছে আকর্ষণীয়, সুদর্শন ও যোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করা। এ সমস্ত রায়বারগনকে পেশাদার ও শখের- এ দুই শ্রেণীতে দেখা যায়। পেশাদার রায়বারগন প্রতিটি ঘটকালির জন্য নির্দিষ্ট অর্থ ও দ্রব্যসামগ্রী গ্রহণ করে থাকেন। আর শখের ঘটকালি হচ্ছে আত্মীয়-স্বজনের পক্ষ থেকে বিশেষ প্রয়োজনে ঘটকের দায়িত্ব পালন করা।

Manual8 Ad Code

আমাদের দেশে অতীতে যে সমস্ত বিয়ে হতো সেগুলি যেখানেই অনুষ্ঠিত হোক না কেন তার অধিকাংশই অনুষ্ঠিত হতো রাত্রে। বরপক্ষ কনে পক্ষের বাড়ীতে স্বদলবদলে যাত্রা করতেন আর সমস্ত রাত্রি তাদের অবস্থান করতে হতো সেখানে। রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর সারারাত গল্প-গুজবে মত্ত থাকতেন উভয় পক্ষ। কেউ ঘুম-নিদ্রায় যেতেন না। কেউ কেউ অবশ্য একটু সূযোগ পেলে কোন একটি ফাঁকে সামান্য ঘুম সেরে নিতেন। তবে তা হতো খুবই ক্ষণস্থায়ী। তাই ঘুমে কাতর অনেকেই সেই রাত্রে খুব কষ্ট পেতেন।এদিকে কনে পক্ষ রাত্রের খাওয়া-দাওয়ার পর পরবর্তী আয়োজনে নিয়োজিত থাকতেন। ভোর হওয়ার সাথে সাথেই নাস্তার বদলে বিদায়ি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে নিতেন। যতটুকু সম্ভব তাড়াতাড়ি তারা এ কাজ সম্পন্ন করে কনে বিদায় দিতে চাইতেন। কাছে হউক, দূরে হউক প্রায় সব বিয়েতেই এ রেওয়াজ পরিলক্ষিত হতো।

বরযাত্রীরা সকাল হওয়ার সাথে সাথেই প্রস্তুত হয়ে যেতেন বাড়ী ফেরার জন্য। আর যৌতুকসহ যাবতীয় কিছু রাত্র থেকেই প্রস্তুত করে রাখা হতো। তখনকার দিনে যৌতুক হিসাবে গবাধিপশু, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদি দেয়া হতো। আর তার বদলে কনে পক্ষের যারা এ সমস্ত দান করতেন তাদেরকে ভাল শাড়ী কাপড় শ্রেনীমত উপহার হিসাবে দেওয়া হতো। তাদের মধ্যে বড় বোন, খালা, মামী, দাদী বা এ পর্যায়ের মুরব্বী মহিলারাই থাকতেন। শাল-শালী বা এ বয়সের যারা তাদেরকে সাইজমত পোশাক প্রদান করা হতো। মোটামুটি কমবেশী সবাই এ সমস্ত উপহার সামগ্রি পেতেন।
আজকাল এ সমস্ত পোশাক বা গেইট পাস এর নিয়েমে অনেকটা চালু থাকলেও-অন্যান্য অনেক কিছুতে পরিবর্তন হয়েছে। তখনকার দিনে কনের বাড়ীতে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার ব্যবস্থা হতো। কারণ কমিউনিটি হল বা বিয়ের সুসজ্জিত হলের কোন ব্যবস্থা ছিল না।

আজকাল যে সমস্ত কমিউনিটি সেন্টার বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় তা হয় খুবই সুসজ্জিত ও উচ্চ ভাড়া সম্পন্ন। ধনীরা এ সমস্ত হলে বিয়ে সাদির কাজ সম্পন্ন অনায়াসে করতে পারলেও অপেক্ষাকৃত কম অবস্থাসম্পন্ন লোকেরাও চেষ্টা করে অন্তত একটি হলে বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করার।
তবে সবচাইতে লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো কমিউনিটি হলের বিয়ে মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। কোন কোন সময় একই সাথে বিয়ে-অলিমা ব্যবস্থা হয়ে থাকে। তাই উভয় পক্ষের যারা এতে উপস্থিত হন তারা যতক্ষণ টেবিলে বসে আলাপ-আলোচনা ও ভোজনপর্ব চালিয়ে যান ততক্ষনই দেখা সাক্ষাৎ হয়। ভোজন পর্বশেষে যতটুকু সম্ভব তাড়াড়াড়ি সবাই চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এর ফলে সেই পরিচয়পর্ব বা আন্তরিক পরিবেশ সৃষ্টির সূযোগ হয়ে উঠে না। আত্মীয়তার বন্ধন খুব একটা দৃঢ় হওয়ার মত লক্ষণ দেখা যায় না। এভাবেই চলছে আজকালকার বিয়ে অনুষ্ঠান। (চলবে)।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code