প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-৩৬

  |  ১১:৪৯, জুলাই ০৭, ২০২০
www.adarshabarta.com

Manual6 Ad Code

বাবার এদিনের ধমকেই আমি জীবনের জন্য ধুমপান ছেড়ে দেই

:: মোঃ রহমত আলী ::

‘ধূমপান’ শব্দটি ‘ধূম’ + ‘পান’ শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে গঠিত। ধূম হলো ধোঁয়া বা বাষ্পের প্রতিশব্দ আর ‘পান’ হলো গ্রহন। যেহেতু তামাকজাতীয় পদার্থের ধোঁয়া গ্রহণ করা হয় বা পান করা হয়, তাই একে ‘ধোঁয়া পান’ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। চুরুট, সিগারেট বা পাইপের মাধ্যমে জ্বলন্ত ধোঁয়টা নিঃশ্বাসের সঙ্গে টেনে নিয়ে এবং তা অনুরুপভাবে বের করে দিয়েই এ প্রক্রিয়া চালানো হয়। ধূমপান কবে কখন আবিস্কার হয়েছিল সে বিষয় আলোচনা না করে এর অন্যান্য দিক নিয়ে আজকে আলোচনা করা হলো।

Manual7 Ad Code

প্রথমেই বলে নেয়া ভাল যে, ‘ধূম পান বিষ পান’ তাই ধূমপায়ীরা আজকাল বড়ই অসহায়। অফিস-আদালত, রাস্তাঘাট, ট্রেনে-বাসে এমন কি নিজ ঘরেও তারা স্বাধীন নন। কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে তাদের এ প্রক্রিয়া চালাতে হয়। কোথাও আবার তারা কোন প্রকারেই তাদের এ অভ্যাস বাস্তবায়নের সূযোগ পান না। কঠোর নির্দেশনা থাকে- এটা না করার জন্য। সুতরাং এ থেকেই প্রতিয়মান হয় তাদের অসহায়ত্বের কথা। মনোকষ্টের কথা। কিন্তু এর পরেও কেউ কেউ করছেন অবলীলায়। তবে আশার কথা অনেকেই এ থেকে নিভৃত হতে চেষ্টা করছেন। এতে কেউ সফল হচ্ছেন আবার অনেকে বিফল হচ্ছেন। কেউ কেউ আবার কিছুদিন বন্ধ রাখার পর পূর্বের মত যেই-সেই।

ধূমপান আসলে একটি নেশা। এটা ক্ষতিকার জেনেও অনেকে সেটা গ্রহন করে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যদিও তাঁর গানে ‘জেনেশুনে বিষ পান’ করার কথা লিখে গিয়েছেন। তবুও উপমা হিসাবে সেটা উল্লেখ করা যায়। ধূমপান একটি মারাত্মক বিপজ্জনক অভ্যাস, কারণ সিগারেটের প্যাকেটের গায়েই লেখা থাকে সতর্কীকরণ ‘স্মোকিং ইজ হার্মফুল টু ইউর হেলথ’ বা ‘স্মোকিং কিলস্’, ইত্যাদি। বিভিন্ন বিজ্ঞাপনচিত্র ছাড়াও সামাজিক ও পারিবারিকভাবেও এ থেকে সরে আসার তাগিদ থাকে। তবুও নিভৃত হতে পারেন না তারা। যারা এ অভ্যাসের দাস একবার হয়ে গেছেন তারা জীবনের অনেক কিছুই ত্যাগ করতে পারেন কিন্তু ধূমপান ত্যাগের প্রসঙ্গ এলে তাদেরকে বড়ই হতাশ মনে হয়। ফ্যাঁকাশে হয়ে যায় তাদের চেহারা। কেউ কেউ ক্রমশও বলে থাকেন যে, খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিতে পারেন কিন্তু ধূমপান ছাড়া সম্ভব নয়। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে, এ আসক্তি তাদের কিভাবে জবর-দখল করে আছে। একজন ধূমপায়ীর মন্তব্য, “ধূমপান ছাড়া তিনি জীবনের কোন কিছুই কল্পনা করতে পারেন না”। কাজ কর্ম, বিশ্রাম-নিদ্রা, হাটা-চলা সব কিছুই এ ধূমপান তাকে প্রাণশক্তি জোগায়। কোন কোন ধূমপায়ির কাজের গতিও আবার এ ধূমপানের উপর নির্ভর করে। তবে বৈজ্ঞানিক মতে এর মধ্যে থাকা অসংখ্য কেমিক্যাল শরীরে প্রবেশ করে সাময়িক উদ্দীপনা সৃষ্টি করে বটে, কিন্তু কখনই মস্তিষ্ককে উজ্জীবিত করতে পারে না।

Manual7 Ad Code

সে যাই হোক, এমন এক সময় ছিল যখন একজন ধূমপায়ীকে খুবই মর্যাদাবান ও অহংকারী হিসাবে মনে করা হতো। এ ধূমপানকে সে সময় ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে ধারণা করা হতো। সমাজে যারা উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বলে মনে করতেন তাদের কাছে ধূমপানকে একটা বিশেষ আভিজাত্যের প্রতিক বলে ধরে নেয়া হতো। আর যে, যত দামী সিগারেট পান করতো তাকে তত বেশী অবস্থাসম্পন্ন মনে করা হতো এবং তাকে সমীহ করা হতো। দেশে এক সময় একটা বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডে লেখা ছিল, ‘জীবনে যারা বহুদুর যায়- স্টার সিগারেট তাদেরই মানায়’। তখন যদি কেউ ধূমপান না করতো তবে সমাজে বা সহপাঠিদের আড্ডায় তাকে নানাভাবে উপহাস করা হতো। এ নিয়ে নানা হালকা রসিকতাও করা হতো। তাকে বলা হতো ‘নিরামিশ’ বা ‘পুরুষত্বহীন মানুষ’ অথবা ‘মেয়েলী স্বভাবের’ ব্যক্তি ইত্যাদি, ইত্যাদি।
আমাদের অনেক বয়স্ক ব্যক্তি আছেন, যারা এক সময় হুক্কা দিয়ে তাদের ধূমানের কাজ সারতেন। কিন্তু ক্রমে ক্রমে সে হুক্কা বিলিন হয়ে যায়। পকেটে রাখার উপযোগি বা সহজে বহনযোগ্য চুরুট বের হয়। এতে ‘সূখটান’ দিয়ে অনেকেই কল্পনায় ভাসতেন। মনের সূখে বিরহের গান গাইতেন। আজও কথা প্রসঙ্গে- দেশে তৎকালীন ভারতীয় ‘নাসির উদ্দিন’ বিড়ির কথা কেউ কেউ বলে থাকেন। পাকিস্তান আমলে এটা সরকারীভাবে বেন্ড করা হয়েছিল। তাই পুলিশ কারো কাছে এটা পেলে এরেস্ট করে নিয়ে যেত। অনেকে এ বিড়ির কারণে ধরা পড়ে জেল-জরিমানারও সম্মূখীন হয়েছে। পুলিশ যখন কোন এলাকায় আসামী গ্রেপ্তার করতে আসতো তখন স্থানীয় হাট-বাজারে তল্লাশী চালাতো ভারতীয় বিড়ি কেউ বিক্রি করছে কি না। পাওয়া গেলে তাদের একটা বাড়তি টু-পাইস কামাইয়ের সূযোগ হয়ে যেত। কাউকে এটা বিক্রি করতে বা পান করতে পাওয়া গেলেও কিছুটা জরিমানা বা উত্তম-মধ্যম দিয়ে ছেড়ে দেয়া হতো।

Manual2 Ad Code

বিশেষ করে দেশ স্বাধিন হওয়ার পর ধীরে ধীরে কাগজের তৈরী অন্যান্য বিড়ির সাথে নানা প্রকার সিগারেট বাজারে বের হয়। এগুলির মধ্যে বক মার্কা, স্টার, রমনা ছিল অন্যতম। এর পর ব্রিস্টল, কেপ্সটেন বাজার দখল করে। সাথে সাথে রথমেন্স সিগারেটও বের হয়। ভেনসন, ডানহিলসহ বিভিন্ন ধরনের সিগারেটের কথা সবার জানা। তবে এখন কোন কোনটা আছে আমার তেমন জানা নেই।

আমি একসময় সহপাঠিদের পাল্লায় পড়ে এতে আসক্ত হয়ে যাই। তবে আমার বাবার একদিনের ধমক খেয়েই তা পরিহার করি। এ জন্য আমার সহপাঠিদের কাছে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল। এদিকে অনেক পিতা আছেন যারা নিজেরা ধুমপান করেন কিন্তু সন্তানদের তা থেকে বিরত থাকতে বলেন। এটা শুধু স্ববিরোধী নয় তা শটতারও নামান্তর।

আজকাল সময় পাল্টেছে। মানুষের বোধশক্তি বা ক্ষতিকারক বিষয় সম্পর্কে ধারণা জন্মেছে। অধিকন্তু স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে এ ধুমপানকে ‘জীবন ধ্বংশকারী’ উপাদান হিসাবে উল্লেখ করে এটি পরিত্যাগ করার জন্য বার বার বলা হচ্ছে। কিন্তু ধূমপানকারীরা এগুলি শুনেও যেন শুনছেন না।

নিচে এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃস্টি ও তা ছাড়ার ব্যাপারে কিছু উপদেশ উল্লেখ করা হলো।
প্রথমে সিদ্ধান্ত নিন কেন ধূমপান ছাড়া আপনার জন্য জরুরী। যারা চুড়ান্তভাবে আসক্ত তারা কোন ধরনের থেরাপি বা মেডিকেশন ছাড়া ধূমপান ছাড়া ঠিক নয়। কারণ সিগারেটের নিকোটিনের ওপর ব্রেইন অনেক ক্ষেত্রে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ছেড়ে দিলেই নানা উপসর্গ শুরু হতে পারে। তাই প্রাথমিকভাবে সিগারেটের বিকল্প থেরাপির কথা চিন্তা করতে হবে। নিকোটিনের বিকল্প গাম, লজেন্স ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। একা একা ধূমপান না ছেড়ে পরিবারের অন্যান্য ধূমপায়ি সদস্যসহ বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদের উৎসাহিত করে একসঙ্গে ধূমপান ত্যাগের ঘোষণা দিন। মানসিক চাপ কমাতে চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে হালকা ম্যাসাজ নিন। একবার ছেড়ে দিলে দ্বিতীয় বার আর ধূমপান করবেন না। নিয়মিত ব্যায়াম করুন। প্রচুর পরিমাণ সবুজ শাক-সবজি ও রঙিন ফলমূল খান। ধূমপান বন্ধ করে যে আর্থিক সাশ্রয় আপনার হবে তার একটা অংশ হালকা বিনোদনে ব্যয় করুন। আর ধূমপান ছাড়ুন বন্ধু-বান্ধব বা প্রেমিককে খুশী করার জন্য নয়, বরং আপনার সুস্বাস্থ্যের জন্যই করেছেন বলে জোরালো অবস্থান নিন। (চলবে)।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com

Manual8 Ad Code

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code