প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-১৭

  |  ১৫:৫৬, জুন ১৮, ২০২০
www.adarshabarta.com

Manual1 Ad Code

একে একে চলে গেলেন পূর্ব লন্ডনের বাঙালী কমিউনিটির ‘পাঁচ উদ্দিনের’ সবাই

Manual6 Ad Code

:: মোঃ রহমত আলী ::

কর্মগুণে মানুষ বেঁচে থাকে। আর এই কাজের মাধ্যমেই মানুষের পরিচিতি বৃদ্ধি পায়। আর এ পরিচিতির কারণে তার নামও উচ্চারিত হতে থাকে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের মধ্যে। সেটা দেশের মত বিদেশেও হতে পারে। আর তা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা যে কোন ক্ষেত্রে হওয়া স্বাভাতিক। তবে আজকের আলোচনা বিলেতে বাঙালী কমিউনিটর পূর্ব লন্ডনের পাঁচজন “উদ্দিনকে” নিয়ে, যাদের কেউই এখন আর জীবিত নেই। অথচ তারা এক সময় ছিলেন নিত্যসঙ্গী। তাঁদেরকে বলা হতো ‘উদ্দিন জুটি’। যেভাবে এক সময় বাংলাদেশে তিন উদ্দিনের নামে সরকার পরিচালিত হতো। অর্থাৎ ইয়াজ উদ্দিন, ফখর উদ্দিন ও মঈন উদ্দিন এর তত্বাবধায়ক নামধারী সরকার। সর্বশেষে চলে গেলেন, প্রবীণ কমিউনিটি নেতা হাফিজ মজির উদ্দিন। অন্যরা আগেই পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।

এক সময় সিলেটের মানুষের মধ্যে যখন বিলাতে আসার হিড়িক পড়েছিল তখন এ ব্যাপারে মানুষকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতার জন্য যাদের নাম শোনা গিয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, মরহুম ছোট মিয়া, বশর মিয়া, তৌরিছ মিয়া, সাথে ছিলেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক মিয়া। মোটামুটি তাঁদেরকে ‘চার মিয়া’ হিসাবে লোকজন উল্লেখ করতো। তাঁদেরকে নিয়ে সমসাময়িককালে অনেক গানও রচিত হয়েছিল। যেমন “উঠল-রে-লন্ডনের জ¦র, জমিন-বাড়ি বিক্রি কর, তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট কর, দিনতো গইয়া যায়। সিলেটের গজনবী নাম, ছোট মিয়া চান্দভরাং, বন গাওয়ের বশর মিয়া ভাল কাজ চালায়, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

এরপর লন্ডনে আসার পর অনেকে প্রবাসীদের ইমিগ্রেশন সমস্যা, চাকরি প্রাপ্তিতে সহযোগিতা, থাকা-খাওয়া এমনকি দেশের চিঠিপত্র লেখার ব্যাপারে যারা বিশেষ সহযোগিতা করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, ‘আলী জুটি’। সেই ব্যক্তিরা হলেন, আফতাব আলী, নেছার আলী, আফরোজ আলী (হাতেম তাই), আইয়ুব আলী (মাস্টার) প্রমূখ। অনেকে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে মানুষকে সহযোগিতা করেছিলেন। তাই আজ মানুষ তাদেরকে স্মরণ করে। হয়তো যতদিন লন্ডনের কোন প্রসঙ্গ আসবে ততদিন মানুষের মুখে শোনা যাবে তাদের নাম।

মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশে। আর তখন সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন দেশের মানুষ। কিন্তু প্রবাসীরা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন বিদেশে থেকেও। এই যুদ্ধে বিশেষ করে যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের অবদানের কথা স্মরণ করা হয় বেশী। আর তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন ছিলেন লন্ডনে বসবাসকারী। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয় কমিউনিটির বিভিন্ন বিষয় নিয়েও ছিলেন সবসময় সোচ্চার। তাছাড়া বাংলাদেশী রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্রও তারা ছিলেন অগ্রগণ্য। বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ সেন্টার, ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে ছিল তাদের বিচরণ। একজনকে দেখা গেলে মনে হতো অন্যজন তার পাশেই আছেন। ইস্ট লন্ডনের বাঙালি কমিউনিটির ‘উদ্দিন জুটি’ নামে পরিচিত এ ব্যক্তিবর্গ হচ্ছেন, আলহাজ্ব শামসুদ্দিন, আলহাজ্ব খন্দকার ফরিদ উদ্দিন, হাফিজ মজির উদ্দিন উদ্দিন ও তাদের সাথে আলহাজ্জ নিজাম উদ্দিন। তাদের দেশের বাড়িও ছিল প্রায় কাছাকাছি। দেশে তাঁদের নির্বাচনী এলাকাও ছিল একই, গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার আসন।

Manual8 Ad Code

আলহাজ্জ শামসুদ্দিন ছিলেন, যুক্তরাজ্য জাতীয় পার্টির দীর্ঘদিনের সভাপতি। যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি ছিলেন, আলহাজ্জ কমর উদ্দিন, যুক্তরাজ্য জাতীয় পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ছিলেন, হাফিজ মজির উদ্দিন, খন্দকার ফরিদ উদ্দিন, নিজাম উদ্দিন । এ ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি শামসুদ্দিন খান ও আলহাজ্জ জিল্লুল হকের নামও চলে আসে। কিন্তু সেই পাঁচ জনের মধ্যে যে অন্তরঙ্গতা ছিল তা অন্যদের বেলায় তেমন ছিল না। আমার সাথে তাদের নানা কারণে ঘনিষ্টতা সৃস্টি হয়। আমাকে তাদের কেউ কেউ নাম ধরে ডাকতেন। তবে হাফিজ মজির উদ্দিন সাহেব আমাকে ‘রহমত আলী সাব’ বলে সম্বোধন করতেন।

Manual5 Ad Code

ইস্ট লন্ডনের এই পাঁচ অগ্রজের মধ্যে প্রথমেই মারা যান আলহাজ্জ শামসুদ্দিন। তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০০৮ সালের জুলাই মাসে হঠাৎ মৃত্যুবরন করেন। তাঁর বাড়ি ছিল বিয়ানী বাজার উপজেলার বাউরবাগ। তারপর ২০১১ সালের ২২ এপ্রিল আকষ্মিকভাবে মৃত্যু কোলে ঢলে পড়েন আলহাজ্জ কমর উদ্দিন। তাঁর বাড়িও ছিল বিয়ানী বাজার। গত ১ এপ্রিল (২০২০) দীর্ঘদিন অসুস্থতার পর মারা যান খন্দকার ফরিদ উদ্দিন। তাঁর দেশের বাড়ি ছিল গোলাপগঞ্জ উপজেলার রানাপিং গ্রামে। সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাস শুরু হওয়ার পর গত ২৩ এপ্রিল (২০২০) মারা যান আলহাজ্জ নিজামুদ্দিন। তাঁর দেশের বাড়ি ছিল গোলাপগঞ্জ উপজেলার হাজিপুর গ্রামে। সর্বশেষ হাফিজ উদ্দিন গত ১৬ জুন (২০২০) সিলেটের নুরজাহান হাসপাতালে মারা যান। মৃত‚কালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ দেশে অবস্থান করছিলেন। তবে এই বয়সেও তিনি বিভিন্ন সামাজিক

Manual8 Ad Code

যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। আমি অনেক সময় ফেসবুকে তার তৎপরতা লক্ষ্য করেছি। তাই ইচ্ছা ছিল এবার দেশে গেলে তাঁর সাথে দেখা করব। কিন্তু সে সুযোগ আর হলো না। আমি তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
যুক্তরাজ্যে আমাদের বাঙালি কমিউনিটির এ অগ্রজগনের শুধু নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতায় সীমাবদ্ধ ছিলো না, তারা রাজনীতি বা অন্যান্য কারণে বিভিন্ন দল ও মতের অনুসারী হলেও কমিউনিটির বিভিন্ন জটিল পরিস্থিতিতে ছিলেন শেষ আশ্রয়স্থল। যেকোনো বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিলে তারা এগুলি সমাধানে অগ্রনি ভ‚মিকা পালন করতেন। তাই, কমিউনিটির ছোট-বড় সকলের কাছে ছিলেন তারা শ্রদ্ধার পাত্র। শেষ বয়সে পৌছার পরেও তাঁদের মধ্যে যে তারন্য লক্ষ্য করেছি তা ছিল অভাবনীয়। তাদের মৃত্যুর পর কমিউনিটিতে যে শুন্যতার সৃস্টি হয়েছে তা সহজে পূরণ হবার নয়।

পরিশেষে বলতে চাই, এ লেখার সময় আমার মধ্যে যে মর্মবেদনার সৃস্টি হয় তাতে চোঁখের জল আটকে রাখতে পারিনি। তাঁদের নানা স্মৃতি আমার সামনে ভেসে উঠতে থাকে। তখন আর বেশিদূর অগ্রসর হতে পারলাম না। কলম হাতে থাকলেও তা যেন অবশ হয়ে যাচ্ছিল। চেষ্ঠা করেও চালাতে পারছিলাম না। তাই অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা থাকলেও আর হলো না। আশা করি আগামীতে আরো লেখার চেষ্ঠা করবো, বিশেষ করে ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে। (চলবে)।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code