প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-৫

  |  ১৮:৫৫, জুন ০১, ২০২০
www.adarshabarta.com

দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নিয়ে নানা স্মৃতি

:: মোঃ রহমত আলী ::

বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মধ্যে যুক্তরাজ্য সফরের তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছেন শেখ হাসিনা, দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন এরশাদ, তৃতীয় স্থানে বেগম খালেদা জিয়া এবং পরবর্তীতে রয়েছেন ডঃ কামাল হোসেনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। শেখ হাসিনা শুধু শীর্ষয়েই নন, তিনি সরকারী সফরের পাশাপাশি বৃটেনের প্রধানমন্ত্রীদের সাথে সাক্ষাতের বেলায়ও অন্যান্যদের চাইতে অগ্রগামী। পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও শেখ হাসিনা তাঁর বোন শেখ রেহানার সূত্র ধরে এখানে তিনি প্রথম অবস্থানে। খালেদা জিয়া তাঁর ছেলে তারেক রহমানের সূত্র ধরে দ্বিতীয় অবস্থানে আর এরশাদ বিভিন্ন সূত্র ধরে ছিলেন তৃতীয় অবস্থানে। তবে আমার ব্যক্তিগত সাক্ষাতের তালিকায় এরশাদ প্রথম, শেখ হাসিনা দ্বিতীয় এবং বেগম খালেদা জিয়া তৃতীয় সারিতে রয়েছেন। অন্যান্যদের সাথেও সময় সূযোগমত দেখা হয়। আর এ সব কিছুর মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডন। আমি একজন সাংবাদিক হিসাবে সংবাদ সম্মেলন, মতবিনিময় সভা ও জনসভার মাধ্যমে তাদের দর্শন লাভের সূযোগ হয়। আমি দেখেছি এ সমস্ত সভা-সমাবেশে প্রবাসীদের ও দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দাবী-দাওয়া উপস্থাপন করা হলে তার অনেকটা বাস্তবায়িত হয় আবার অনেকটা হয় না। এ পর্যায়ে আমার ভিন্ন কিছু স্মৃতির কথা এখানে উল্লেখ করছি।

৯৫ সালের ১৫ মার্চ, বুধবার বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসাবে যুক্তরাজ্য সফরে আসেন। তখন সেন্ট্রাল লন্ডনের একটি হোটেলে বিভিন্ন কমিউনিটির নেতুবৃন্দের সাথে ধারাবাহিকভাবে চলছিল মতবিনিময় সভা। এ সময় একটি দাবী বার বার আলোচিত হচ্ছিল। বেগম খালেদা জিয়া বিষয়টিকে রহস্যজনক মনে করে বেশ রসালো মন্তব্য করেন। বলেন, আমেরিকায় গেলাম সেখানেও যে দাবী করা হলো এখানে আসার পরও দেখি সে একই দাবি। সবখানেই কেবল ‘সিলেট বিভাগ’ প্রতিষ্ঠার দাবী। সুতরাং এ দাবী বাস্তবায়িত করা হলে দেশে আর কোন জেলা থাকবে না, সবগুলোকেই বিভাগ করার দাবী উঠবে। সুতরাং এটা বস্তবায়ন করা সম্ভব নয় । তিনি আরও বলেন, বিভাগ যখন একটি আছে (চট্রগ্রাম বিভাগ) তখন আরো একটি বিভাগের প্রয়োজন কেন? পরে অবশ্য আন্দোলনের ফলে তাঁর সময়েই সিলেট বিভাগ বাস্তবায়িত হয়েছিল। আর এর অন্যতম কৃতিত্বের দাবিদার ছিলেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে ও পরে যুক্তরাজ্যে এসেছেন অসংখ্য বার। ‘৭৫এর পটপরিবর্তনের পর তাঁর দীর্ঘদিন বিলেতে অবস্থানের কথা সবার জানা। এ কারণে স্থানীয় আওয়মীলীগ নেতাকর্মীদের সাথে তিনি এতই ঘনিষ্ট যে, অনেকের নাম-পরিচয় অনায়াসে বলে দিতে পারেন। দলীয় নেতাকর্মীদের মতো আমি তাঁর সাথে এত ঘনিষ্ট না হলেও একজন সাংবাদিক হিসাবে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিতে সক্ষম হই।

১৯৯৫ সালে একবার যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগ নেতা শফিকুর রহমান চৌধুরী (পরে এমপি) কর্তৃক আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে যোগদান করি। এদিন অনেকটা ঘরোয়া পরিবেশে তিনি সবার সাথে কথাবার্তা বলেন। তবে সবার সাথে তিনি যখন কথাবার্তা বলছিলেন তখন শেখ হাসিনাকে তাঁর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে এক মহিলা একটি ছোট্ট বাচ্চাকে তাঁর কোলে তুলে দিয়ে সে মহিলা আনন্দে আত্মহারা হয়ে খুশিতে গদ গদ করতে থাকেন। সাথে সাথে কথা বলার সময় বার বার বাচ্চাটিকে তাঁর কাছে দিয়ে নানাভাবে ছবি তোলা প্রচেষ্ঠা চালানোতে কিছুটা বিরক্ত হচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। এমতাবস্থায় এক পর্যায়ে তিনি (শেখ হাসিনা) অনেকটা উপহাসস্থলে সে শিশুটিকে উপরের দিকে তুলে ধরে বলেন, এখন আমি শিশুটিকে কী করবো বলুন! সে মহিলা তখন বুঝতে পারেন যে, এটা ঠিক হচ্ছে না। তাই বাচ্চাটিকে সরিয়ে নেন। এভাবে শুধু শেখ হাসিনা নন। দেশের যে কোন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বা অন্য কেউ এদেশে আসলে অনেকে চেষ্ঠা করেন বিভিন্নভাবে ছবি তোলার। এতে তারা বিব্রত হতে দেখা যায়।

আলহাজ্ব হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতাসীন থাকাকালীন ও পরবর্তিতে বিভিন্ন সময় বৃটেন সফর করেছেন। আমি পূর্বেই বলেছি যে, তাঁর সাথে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। তবে একবার তিনি আমেরিকা থেকে দেশে যাওয়ার পথে লন্ডনে যাত্রা বিরতি করেন। আমি তখন তিনির সাথে হোটেলে দেখা করতে যাই। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ও তাঁর প্রেমিকা মনিকাকে নিয়ে সংবাদ মাধ্যম তখন বেশ সরগরম। আমি তখন ভাবলাম এতে নিশ্চই এরশাদ কিছুটা হালকা অনুভব করবেন। কারণ তিনিও তখন এ সমস্ত ব্যাপারে মিডিয়ার উপদ্রবে জর্জরিত। আর তাই, তাঁর সাথে দেখা হওয়ার পর একটু হালকাভাবে জানতে চাইলাম যে, সে বিষয়টাকে তিনি কিভাবে দেখছেন। তিনি তখন অত্যন্ত ভাবগম্ভির সুরে বল্লেন, তারা বড় দেশের বড় মানুষ, তাই তাদের জন্য এগুলি কিছুই না। “আমরা হলাম সে তুলনায় চুনুপুটি। তাই আমাদের কিছু হলে সেটা হয়ে যায় লংকা কান্ড। সুতরাং এ ব্যাপারে আর কি মন্তব্য করবো”। তখন তাঁর অন্তরের বেদনা অনুভব করে আমি আর অগ্রসর হইনি।

১৯৯৫ সালের ৩১শে অক্টোবর, মঙ্গলবার জাতীসংঘের ৫০তম সাধারণ অধিবেশনে যোগদান শেষে জেনেভা থেকে কুয়ালালামপুর যাওয়ার পথে গণফোরাম সভাপতি ডঃ কামাল হোসেন লন্ডনে যাত্রাবিরতি করেন। এ সময় স্থানীয় গনফোরামের পক্ষ থেকে ইস্ট লন্ডনের হ্যানবারি স্ট্রিটের কবি নজরুল সেন্টারে একটি মত বিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে বিশেষ করে দলীয় নেতাকর্মী ছাড়া কেবলমাত্র সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। এ সভায় বিভিন্ন প্রশ্নের মধ্যে সে সময়ে বাংলাদেশে আয়োজিত নির্বাচনে যোগদান সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে ডঃ কামাল হোসেন বলেছিলেন, উক্ত নির্বাচনে “একমাত্র হেমায়েত পুরের পাগল ছাড়া আর কেউ যোগদান করবে বলে মনে হয় না”। তাই তাতে যোগদানের প্রশ্নই আসে না।

উক্ত সভায় প্রবাসীদের ভোটাধিকার সংক্রান্ত আমার এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সংবিধানের আলোকে এর যৌক্তিকতা তুলে ধরে এ ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহনের কথা বলেন। এ সময় আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সহযোগিতা চাওয়া হলে তিনি সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন। উল্লেখ্য, পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য গনফোরামের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জনাব মোকাব্বির খান (বর্তমানে বিশ্ববনাথ ওসমানী নগর আসনের এমপি) এর বিশেষ প্রচেষ্ঠায় ও প্রবাসী আলী রেজা খানের দায়ের করা রিট মামলার মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটাধিকারের পক্ষে রায় হয়। এতে আইনজীবি ছিলেন ডঃ কামাল হোসেন। (চলবে)।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com