প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-১

  |  ১৫:৩৬, মে ২৫, ২০২০
www.adarshabarta.com

Manual2 Ad Code

মোঃ রহমত আলী

নাড়িতে টান পড়লেই মনটা মোচড় দিয়ে ওঠে। এক অদ্ভুত নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসে আমাকে। প্রিয় স্বদেশ, স্বদেশের জন্ম মাটি তখন অবিরাম হাতছানি দিয়ে ডাকে। প্রিয় জন্ম মাটির চিরচেনা রূপ চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়। মনে হয়, শঙ্খচিলের ডানায় চড়ে পাড়ি জমাই সেখানে, যেখানে আমার নাড়ি প্রোথিত। ঐ নাড়ির টান যাকে আন্দোলিত করেনা, সে কিসের দেশপ্রেমী? দেশ প্রেমের সংজ্ঞা যদি হয় দেশের মানচিত্র জুড়ে মমত্ব ছড়িয়ে দেয়া, আর সেখানে যদি কারো ঘাটতি থেকে থাকে তাকে আমি দেশপ্রেমী বলবোনা।

Manual4 Ad Code

দেশপ্রেমের অনুভূতিটাই কিন্তু অন্যরকম। এই প্রবাসে আছি দীর্ঘদিন। বিলেতের অর্থ-বিত্ত, সামাজিক প্রতিষ্ঠা, আলো ঝলমলে আধুনিকতা আমাকে যে আকৃষ্ট করেনি সে কথা বলবো না, তবে এটা নির্ধিদ্বায় বলতে পারি যে, প্রিয় দেশ বাংলাদেশের সাফল্যে এখনও মনটা উৎফুল্লিত হয়, আর দেশের সঙ্কটে-ক্রান্তিকালে মনটা বেদনায় নীলাভ হয়ে যায়। সত্যি বলতে কি, টেমস নদীর তীরে আমার বসবাস হলেও সেই নদীর জলে তাকিয়ে এখনও আমি সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই ও বাসিয়া নদীর রূপ-সৌন্দর্য্যকে খুঁজি নিরন্তর। বিলেতের কর্মব্যস্ত জীবনে যখন হাঁপিয়ে উঠি, তখন মনটাকে অনেকটা জোর করেই ঠেলে দেই বাংলাদেশে, আমার জন্মমাটি সিলেট তথা বিশ্বনাথের এক নিভৃত পল্লীগ্রামে। রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে বিচরণ করি বাসিয়া-চরচন্ডি নদীর এপারে-ওপারে, ধান ক্ষেতের আ’ল ধরে হাঁটি মনের সুখে, চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যায় ফড়িং-প্রজাপতি, ধরার চেষ্টা করি। হঠাৎ পা ফসকে মাটিতে পড়ে যাই-তখন ঘুমও ভেঙ্গে যায়। রাতে আর ঘুম হয় না। দেশের জন্য মনটা কাঁদে। মনে মনে স্থির করি, আবার দেশটা ঘুরে আসি।

Manual5 Ad Code

মনের মধ্যে প্রস্তুতি এ রকম থাকলে কি হবে, বাস্তব যে অন্যরকম। ইচ্ছে করলেই উড়াল দেয়া যায় না। পাখী হলে না হয় অন্য কথা ছিল। আমি আশাহত হই-দেশে আর যাওয়া হয়না। তবে কালে-ভদ্রে যে নাড়ির টানকে উপেক্ষা করতে পারিনা, সবকিছু অগোছালো রেখেই দেশে চলে যাই। সত্যিকার অর্থেই আমি একজন স্বদেশপ্রেমী সে কথা বলবোনা, তবে স্বদেশপ্রেম যদি দাঁড়ি-পাল্লায় মাপা যেতো, তাহলে ওজন করে দেখতাম। প্রেমটা আপেক্ষিক ব্যাপার, অশরীরি। বুকে থার্মোমিটার চেপে ধরলেও তার পরিমাপটা বুঝা সম্ভব নয়। এটা হলো হৃদয়গত ব্যাপার। সত্যিকার হৃদয় দিয়ে প্রেমকে কব্জা করতে হয়। গানে আছে না, ‘হৃদয় আছে যার, সেইতো ভালোবাসে।’ তাই বলছিলাম, থাকতে হবে হৃদয়ের মতো হৃদয়। সেটা না থাকলে লোকে বলবে, আপনি হৃদয়হীন।
আমার হৃদয়টা কিন্তু বাংলাদেশের একটি চমৎকার ছায়া-সুনিবিড় গ্রামের অনিন্দ-সুন্দর পরিবেশে বিকশিত।

সিলেট বিভাগের বিশ্বনাথ উপজেলার দশঘর ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামে জন্ম ও বেড়ে উঠা। সিলেট তখন বিভাগের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়নি। উপজেলা ছিল তখন থানা। আমাদের উপজেলাটি বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের অন্যতম প্রবাসী জনবহুল এলাকা হিসেবে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিত। এখনকার বিশ্বনাথ আর আগের বিশ্বনাথ-এর মধ্যে রাত-দিন ফারাক। ‘৭১ সালে টানা ন’মাস মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার রক্তসূর্যকে ছিনিয়ে আনার পর প্রবাসী বিশ্বনাথবাসীরা নিজেদের জনপদ বিশ্বনাথের সার্বিক উন্নয়নে নজিরবিহীন অবদান রাখার সুবাদে একসময়ের এই অবহেলিত জনপদের আজ উজ্জ্বল চেহারা। অথচ স্বাধীনতার পূর্বে বিশ্বনাথের ভগ্নদশা ছিল চোখে পড়ার মতো। সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নাজুক। প্রতিটি ইউনিয়নেই ছিল জরাজীর্ণ সেতু ও কালভার্ট। অধিকাংশ গ্রামেই ছিল কাঁচা রাস্তাঘাটের আধিক্য। নদীভাঙ্গন ছিল বাসিয়াপারের জনগণের ললাট লিখন। উন্নত হাটবাজার যেমন ছিল না, তেমনি ছিলোনা চাহিদার তুলনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উপজেলায় পরিপূর্ণ প্রশাসনিক অবকাঠামো খুব একটা গড়ে উঠেনি। চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আজ সবকিছুই পাল্টে গেছে।

বিশ্বনাথ এখন একটি সমৃদ্ধ উপজেলা। লোকে বলে, লন্ডনীদের উপজেলা। হ্যাঁ, এই বিশ্বনাথ উপজেলায়ই আমার জন্ম। নোয়াগাঁও গ্রামের আলো-বাতাস এবং মুরব্বীয়ানদের স্নেহ-মমতায়ই আমার বেড়ে উঠা। শৈশব-কৈশরে আমি কতটুকু দূরন্ত ছিলাম নিজে বলতে না পারলেও বয়সের চপলতায় যে জন্মমাটি দাপিয়ে বেড়াতাম, সেটা অবশ্য পিতা-মাতার কাছ থেকে জানতে পেরেছি সুস্থিরমতিসম্পন্ন হবার পর। সেই সব দিনের স্মৃতি মানসপটে পরিপূর্ণভাবে ধরা না দিলেও কিছু কিছু স্মৃতি আজও আমাকে আন্দোলিত করে। তখনকার সময়ের সহপাঠি বা খেলার সাথীদের কথা এখনও ভুলতে পারিনা। এরা প্রত্যেকে কে কোথায় আছে বলতে পারিনা। তবে এদের কথা মনে হলেই চোখের পাতা ঝাপসা হয়ে আসে।

আমার পিতা মরহুম চেরাগ আলী ছিলেন একজন অত্যন্ত ধর্মপরায়ন, পরহেজগার ব্যক্তি। তিনি ছিলেন নির্লোভী মানুষ। বিষয় সম্পত্তির প্রতি তাঁর মোহ ছিলোনা। সন্তানদের ‘মানুষ’ হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। জীবদ্দশায় তিনি সে চেষ্টাও করেছেন নিরন্তর। বলা হয়নি, আমার জন্মমাটি নোয়াগাঁও গ্রামের দশঘর নোয়াগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম আমার শিক্ষাজীবনের শুরু। এরপর দশঘর এন ইউ উচ্চবিদ্যালয় এবং শ্রীরামসী হাইস্কুলে অধ্যয়নের পর সর্বশেষ সিলেট নগরীর ঐতিহ্যবাহী মদন মোহন কলেজ। (চলবে)।

Manual7 Ad Code

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক।

Manual8 Ad Code

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code