প্রচ্ছদ

জীবন বড় বৈচিত্রময়, পর্ব-৬

  |  ১১:৪৭, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২০
www.adarshabarta.com

:: মিজানুর রহমান মিজান ::

’৭৪ সালের আগষ্ট মাস।আমার এক ছোট বোনকে সাথে নিয়ে নিজ পুকুরে বডশি দিয়ে মাছ ধরছি সকাল বেলা।একটি মাছ ধরার পর পরই বোনটি মাছ নিয়ে সীমাহীন আনন্দে দৌড়ে যেত মায়ের কাছে। মায়ের হাতে দিয়ে প্রাণ পণে ছুটে আসত আরো নেবার বুক ভরা প্রত্যাশায়। মাছ প্রাপ্তি ও ছিল প্রচুর।এসেই বলতো ভাইয়া ওটা আমি খাবো ভাজি করে, ওটা আপনার….. ওটা আমার মায়ের…. ইত্যাদি। বোনটির আনন্দ উচ্ছ্বাসের সহিত আমার আনন্দের ফল্গু ধারা যেন উপছিয়ে পড়ছিল জোয়ারের পানির মতো দু’কুল বেয়ে। আমিও ছিলাম আনন্দে আত্মহারা পাঁচ বৎসরের বোনটির কচি মুখের বুলি শুনে।তখন আমার পাঁচটি বোন, মা-বাবা আর আমাকে নিয়ে আট সদস্যের পারিবারিক বন্ধন।মা আমাদের ধৃত মাছগুলি রান্না করতে ব্যস্ত অত্যন্ত সযত্নে।খাবার গ্রহণের তর যেন সইছিল না বোনটির। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম ও কঠিন কষাঘাত আসছিল ধেয়ে ঝড়ের বেগে। অল্প খাদ্য গ্রহণের পরই বলল পেটে ব্যথার কথা।চলে গেল ভাতের থালা টেলে দিয়ে টয়লেটে। পাতলা পায়খানা।কলেরা নামে চিহ্নিত।আমরা কলেরাকে জয় করতে পেরেছি।তবে ধেয়ে এসে সে স্থান দখল করেছে বর্তমান সময়ের ভয়াবহ কোভিড-১৯ করোনা। তখন এলাকায় কোন ডাক্তার নেই, ছিলেন না। প্রয়াগমহল গ্রামে মনিন্দ্র নামে একজন ডাক্তার ছিলেন যিনি মিক্সার তৈরী করে বোতলের গায়ে খাঁজ কাটা কাগজের লেবেল বোতলের গায়ে লাগিয়ে দিতেন। প্রতিবার খাঁজকাটা একটি অংশ সেবনের নির্দেশ থাকতো। আমার বাবা ঐদিন বাড়িতে ছিলেন না বিধায় আমি মানুষকে জিজ্ঞেস করে করে ডাক্তার বাড়ি উপস্থিত। অবস্থার বর্ণনা প্রদান করে তিনির প্রদত্ত তিনটি শিশি নিয়ে আসি।ঔষধ সেবন চলে যথারীতি।কিন্তু ফলোদয় কিছুই না। বিছানা থেকে উঠার ক্ষমতা হারিয়ে নিস্তেজ। দু’টি চোখের চাহনী ছিল আমার প্রতি তীর বিদ্ধের মতো। আমার মনে হত ওর বাঁচার আকুতি আমাকে জানিয়ে দিতো চোখের ভাষায় এবং মুখে ছিল ভাই, “ কাল মাছ ধরলে আমরা মজা করে খাবো”।পরদিন আমি কাউকে কিছু না বলে চুপিসারে ডাক্তারের নিকট গিয়ে আবার অবস্তার সচিত্রতা তুলে ধরি। কিন্তু তিনির কথা ছিল,“ ঔষধ নির্দেশ মতো সেবন করান”। এ সময় কলেরা রোগকে মানুষ অত্যধিক ভয় পেতো।তাই বোনটি রোগাক্রান্ত হবার পর পরই আমরা হয়ে পড়ি নির্জন দ্বীপের অধিবাসী। পাশের ঘরের লোকজনও সম্পর্কচ্ছেদ করেন। আমরা যেন অস্পৃশ্য।এমন তরো পরিবেশ ছিল বিরাজমান। তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় তা বা সে চিত্র আজ নির্বাসনে। বডই আশার আলোর উজ্জ্বলতায় দেদীপ্যমান।সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে তৃতীয় দিবসে বোনটি পরপারের পথে পাড়ি জমায় চোখের জলে ভাসিয়ে পরিবারের সবাইকে। স্মৃতির দর্পণে আজো দেখি সে করুণ দৃশ্যের হুবহু অবতারনা দৃশ্যপটের। আপনা থেকে চোখ হয়ে উঠে অশ্রু সজল।মনে হয় এ মুহুর্তটি সে ক্ষণের প্রতিচিত্র।আমার প্রিয় বোনটিকে আল্লাহ বেহেস্ত নসীব করুন এ কামনা আমার সতত এবং সবার কাছে দোয়া কাম্য।

এ সময় আমি উত্তর বিশ্বনাথে এসে আমার পরম শ্রদ্ধেয় যে সকল শিক্ষকদের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম একে একে তাঁদের নাম বলছি এক্ষুণি।পূর্বে বলা নাম ব্যতীত শিক্ষকবৃন্দ। প্রয়াত জনাব কামাল উদ্দিন হাজারি গাঁও, জনাব জামাল উদ্দিন পাখিচিরি,ফরিদ উদ্দিন হাজারী গাঁও, জনাব মাসুক মিয়া ও গোলাম মস্তফা (মানিক মিয়া) ঘাসি গাঁও, বাবু জিতেন্দ্র কুমার নাথ দিরাই, আব্দুল হাসিম ময়মনসিংহ, মুহিবুর রহমান কিরণ হাজারী গাঁও, মরহুম আব্দুর রাজ্জাক বি.এস.সি তেলিকুনা ও দপ্তরি হিসাবে পেয়েছিলাম নোয়া গাঁও নিবাসী প্রয়াত ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকের নিকট যিনি বেয়াই (তাহির আলী)নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন।

দারিদ্রতা আমার নিত্য সঙ্গি।একটি ঝড়ের তান্ডব শেষ হতে না হতেই আরেকটি ঝড়ের আঘাত। আমার পড়ালেখায় ইতি টানার উপক্রম। এলাকার একজন প্রবাসী ব্যক্তি আমাকে শুনালেন আশার বাণী। তিনি বললেন, “এস.এস.সি পর্যন্ত তিনি আমার পড়ালেখা করার খরচ বহন করবেন”।সিলেট সুরমা মার্কেটে তখন ছিল উত্তরা ব্যাংকের শাখা।স্বদেশে থাকা তিনির ভাইকে বলে দিলেন, আমি একাউন্ট খোলে নম্বর প্রদান করতে। দশ টাকায় আমার একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলা হল জীবনের প্রথম একাউন্ট খোলা ব্যাংকে। মানুষ জানল তিনি আমার পড়ার খরচ বহন করছেন। অথবা একজন সুহৃদ ব্যক্তি প্রদান করছেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটল উল্টো।একটি টাকাও পেলাম না। আমাকে আমার পথ বেঁচে নিতে হল। পাঠক সহজেই অনুমেয় আপনাদের হবার কথা। কি অপরিসীম দুর্ভোগ, কষ্ট, যাতনা নিয়ে আমাকে অগ্রসর হতে হল।আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা তখন আটজন। পাঁচ বোন আমি ও পিতামাতা। এক্ষেত্রে কাজ করল আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস, নির্ভরশীলতা, আমার জেদ, আত্ম-বিশ্বাস, দৃঢ়তা, একাগ্রতা ও স্বপ্ন। কিন্তু তেমন স্বপ্ন দেখার রসদ কি আমার ছিল?সময় তো একটি নিরবচিছন্ন ধারাসম ছিল। দারিদ্র্যতাকে জীবনের পরম বন্ধু ভেবে নিলাম। বৈঠাবিহীন নৌকার মাঝি সেজে সমুদ্র যাত্রায় পাড়ি ধরলাম। তারুণ্যের হাতিয়ার আমি পারব, জয় করব, এ ছিল মোর হৃদয়জ আর্তি মহান স্রষ্টার দরবারে কামনা বাসনার বস্তু।রাখে আল্লাহ মারে কে? আমি চললাম অভিনব পন্থা অবলম্বন করে সামনের দিকে।পন্থাটি হচেছ- সকল ছাত্রছাত্রী খাতায় লিখত কলম দিয়ে, খাতার পাতা একবারই করতো ব্যবহার। আর আমি একই খাতার পাতা ব্যবহার করতাম দু’বার। কৌশলটি তাহলে এখানে বলি আপনাদের মনের দরজায়।আমি একটি খাতা বানিয়ে সম্পূর্ণ খাতায় লিখতাম কাঠপেন্সিল দিয়ে। এ সময় কোনমতেই কলমের আঁচড় তুলতাম না। কাঠপেন্সিল দিয়ে লিখা শেষ হলে লিখতাম কলম দিয়ে পুরো খাতাটি।হলাম সাশ্রয়ী।অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পরিক্ষার প্রস্তুতি নেই, নেই না। এভাবে যাচিছল দিবস রাতি। অপরদিকে আব্দুন নুরের পিতা একদিন সকাল বেলা জানালেন, “আব্দুন নুর বৃত্তি পরিক্ষার জন্য সুনাম গঞ্জ যাবে পরশু দিন। বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে গেছে চলে।” আমি পরদিন স্কুলে গিয়ে উকিল আলী স্যারকে বললাম, স্যার আমাদের বৃত্তি পরিক্ষা কবে?আব্দুন নুরের কাহিনীটি শুধালাম তিনিকে?তাৎক্ষণিক বেলা দু’টার ট্রেনে তিনি চলে গেলেন সিলেট অভিমুখে।স্যার বেলা ৪টায় ফিরে এসে জানালেন, পরিক্ষার কথা।ঐদিন রাত্রেই চলে গেলাম সিলেট শহরে স্কুল প্রতিষ্ঠাতা জনাব ছাদ উদ্দিন খান সাহেবের বাসায়। তিনির বাসায় থেকে পরিক্ষা দিলাম সিলেট সরকারি স্কুলে (কালিঘাটস্থ)।হলাম অকৃতকা‌র্য।নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলাম। অনেক সময় মনে হয়েছে পড়া ছেড়ে দেবার।কিন্তু অজানা আকর্ষনে হয়েছি আকর্ষিত। মনকে শক্ত হাতে করেছি নিয়ন্ত্রিত। বাধ্য করেছি পড়ালেখা করতে,পরিক্ষা দিতে।মহান আল্লাহর ইচছা ও অপার করুনায় ঠিকে থেকেছি।বৃত্তি পরিক্ষা চলাকালীন মধ্য সময়ের এক শুক্রবারে আমার প্রিয় শিক্ষক শ্রদ্ধেয় আলতাফুর রহমান ছাদ মিয়া’র বিয়েতে বরযাত্রী হবার সুযোগ পেয়ে যাই। ছাত্রদের মধ্যে আমিই একমাত্র বরযাত্রী রুপে অংশ গ্রহণকারীর তালিকায় নাম হয়ে যায় অন্তর্ভুক্ত।

অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরিক্ষায় এ সকল সমস্যার পাহাড় নিয়ে ছিল অংশ গ্রহণ।বৃত্তি দিয়ে সফলতা আনতে অক্ষম হলেও বার্ষিক পরিক্ষায় প্রথম স্থানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হইনি।ছিল কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল।অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক পরিক্ষার রুটিন অনুযায়ী প্রত্যেক ক্লাসের অংক পরিক্ষা ছিল একই দিনে নির্ধারিত প্রত্যেকটি ক্লাসের। পরিক্ষা চলাকালীন সময়ে তৎকালীন সহ-প্রধান শিক্ষক নওরোজ আলী ঘোষণা করেন-“আজকের অংক পরিক্ষায় যে আশি নম্বর’র উপরে মার্ক পাবেন, তাকে বিশেষ পুরস্কারে ভুষিত করা হবে”।ঘোষণা অনুযায়ী প্রাপ্ত A.T.dev এর ইংরেজী হতে বাংলা ডিকশনারীটি আমারই হয়েছিল প্রাপ্য বা অর্জন।(চলবে)

লেখক: সাবেক সভাপতি বিশ্বনাথ প্রেসক্লাব, বিশ্বনাথ, সিলেট।