প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-৩৩

  |  ১৬:০৫, জুলাই ০৪, ২০২০
www.adarshabarta.com

জীবনে যারে দেওনি মালা-মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল

:: মোঃ রহমত আলী ::

জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা,
মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল-
মুখপানে যার কভু চাওনি ফিরে,
কেন তারি লাগি আঁখি অশ্রæ সজল।
আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তবে অনেকদিন আগে প্রণব রায়ের কথায়, শৈলেশ দত্ত গুপ্তের সুরে অনুপ ঘোষালের গাওয়া এই গানটি ছিল অত্যন্ত আবেগি ও মর্মস্পর্শী। যা এখনো উপমা হিসাবে অনেকে উল্লেখ করে থাকেন। প্রেয়সীকে উদ্দেশ্য করে এ গানের আবেদন হলেও আমাদের একজন প্রয়াত রাজনীতিবিদ এ গানটি তার এলাকার জনগনের উদ্ধেশ্যে তুলে ধরেছিলেন। এর পরবর্তী লাইনগুলি হলো- চিরদিন যারে তুমি দিয়েছো হেলা/ হৃদয় লয়ে শুধু খেলেছো খেলা/ বিরহে তারি আজি বলো গো কেন/ শূন্য লাগে এই ধরণী বিপুল। আমি তো ছিলাম প্রিয় তোমারই কাছে/ সেই বকুল তলে সেই চাঁদিনী রাতে/ সেদিন কেন দিলে না তো হায়/ যে মালাখানি ছিল তোমারই হাতে। মোর যত পেম, মোর যত গান/চাইনি তো কভু কোনো প্রতিদান/চিরতরে হায় যবে নিলাম বিদায়, (আমি) তুমি বুঝিলে কিগো তব হৃদয়ের ভুল।।

বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রি এম সাইফুর রহমান কখনও কখনও অপ্রিয় সত্য কথাগুলি অকপটে বলে ফেলতেন। অন্য দলের নেতানেত্রীদের সম্বন্ধে যাই হোক, নিজ দলের অনেকের বিভিন্ন কার্যক্রম সরাসরি ও সামনা-সামনি বলতেও দ্বিধা করতেন না। এ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা, হাস্য-কৌতুক পর্যন্ত হতো। তবে তার বক্তব্যে এ সমস্ত উপমা সিলেটি ভাষায় দিতেন বলে তা অনেকের কাছে ছিল আরো উপভোগ্য।
অনেকেই হয়তো জানেন যে, প্রথম রাজনীতিতে আসার পর সাইফুর রহমান যখন প্রথমবার তার এলাকায় এমপি নির্বাচনে দাঁড়ান তখন কৃতকার্য্য হতে পারেন নি। এর কারণ যাই হোক, এ নির্বাচনের পর তিনি অনেকটা লজ্জায়, অভিমানে ও ক্ষোভে অনেকদিন নিজ এলাকায় যান নি। অবশেষে যখন টেকনোক্রেট কোঠায় মন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন ভোটে জয়লাভ না করেও। তখন অনেক চেষ্টার পর তাঁকে নিজ এলাকায় নিয়ে আসা হলো এবং একটি সংবর্ধনার ব্যবস্থা করা হলো। এ সংবর্ধনা সভায় অনেক বক্তা তাঁর তোষামোদি করতে গিয়ে তাঁকে সে এলাকার কৃতিসন্তান হিসাবে আখ্যায়িত করাসহ উচ্চস্বরে বিভিন্ন শ্লোগান দিয়ে তাঁকে উৎফুল্ল করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি এতে খুশি না হয়ে বরং বিরক্তিই অনুভব করছিলেন। এক সময় তিনি তা বারণ করার জন্যও বলে ফেলেন। এর পর তিনি বক্তৃতা দিতে শুরু করলে গানের এল্লখিত এ লাইনগুলি বলতে থাকেন। এবং বলেন, “আজ আমি মন্ত্রি তাই আমাকে বিভিন্ন জনের বক্তৃতা বা শ্লোগান দিয়ে তোষামোদি করা হচ্ছে, আমাকে এ এলাকার কৃতি সন্তান বলা হচ্ছে-। কিন্তু এ সব এখন আর দরকার নাই। কারণ আপনারা ভোট দিয়ে এমপি না করলেও আজ আমি মন্ত্রি। তাই যখন দরকার ছিল (এমপি নির্বাচনের সময়) তখন দেয়া হয়নি বা ভোট দেয়া হয়নি। এ সময় তাঁর কথা শুনে সমবেত অনেক প্রবিণ মুরব্বী মাথা নিচু করে তা হজম করছিলেন আর শ্লোগানধারীদের মধ্যে তখন চলে আসে পিন পতন নিরবতা।

যাই হোক, বরেণ্য এ রাজনীতিবিদ ও অর্থনৈতিক সংস্কারক সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ২০০৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পবিত্র রমজান মাসে মৌলভীবাজার থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রতিভাবান এই মানুষটির জন্ম ১৯৩২ সালের ৬ অক্টোবর মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাহারমর্দন গ্রামে। ১৯৪৯ সালে মৌলভীবাজার সরকারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৫১ সালে এমসি কলেজ থেকে আইএসসি ও ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। তিনি ১৯৫৮ সালে লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট থেকে কৃতিত্বের সাথে ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৬২ সালে দেশে ফিরে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রহমান, রেহমান অ্যান্ড হক’ নামে একটি নিরীক্ষা ফার্ম। এই ফার্ম আজো চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সাইফুর রহমানের কৃতিত্বের স্মারক হয়ে আছে। তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যে অভিজ্ঞ অ্যাকাউনট্যান্ট হিসেবে তেল, গ্যাস, কেমিক্যাল, ট্রান্সপোর্ট, ইন্স্যুরেন্স, ব্যাংকিং ইত্যাদি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় পরামর্শক হিসেবে দেশে-বিদেশে প্রভূত সুনাম অর্জন করেন। ১৯৭৬ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যোগ দেন রাজনীতিতে।
প্রথমে জিয়া সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা এবং ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রথমে শহীদ জিয়াউর রহমান ও পরে মরহুম বিচারপতি আবদুস সাত্তার সরকারের অর্থ ও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। সাইফুর রহমান ছিলেন সাহসী, দেশপ্রেমিক ও স্পষ্টভাষী। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একজন অনুসারী হিসেবে আদর্শ এই মানুষটির অনেক স্মৃতি রয়েছে।

১৯৯৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সিলেটে আসার কথা। আলিয়া মাদরাসা মাঠে তার জনসভার আয়োজন চলছে। সাইফুর রহমান এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে নাকি বলেছিলেন, ‘যদি এই জনসভা থেকে সিলেটকে দেশের নতুন বিভাগ হিসেবে ঘোষণা না দেন, তাহলে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করবেন।’ অবশ্য তার পদত্যাগ করতে হয়নি। সে সভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিশাল জনসভায় সিলেটকে নতুন বিভাগ ঘোষণা দেন।
১৯৯৭ সালের কথা। আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায়। তিনি ঢাকা থেকে সকালের ‘পারাবত’ ট্রেনে শ্রীমঙ্গল যাওয়ার পথে আখাউড়া স্টেশনে এসে থামলে লোকজনের চিৎকারে তিনি বেশ রেগে বললেন, এই একটি স্টপেজে প্রতিটি যাত্রীর ক্ষতি হয় এক ঘণ্টা আর লাভ হয় চোরাকারবারিদের। অথচ এখানে মাত্র অর্ধ-কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করতে পারলে ট্রেন সোজা সিলেট চলে যেতে পারে। ইঞ্জিন ঘোরানোর জন্য এখানে থামতে হতো না। “আল্লাহ যদি কখনো আমাকে আবার সুযোগ দেন, এখানে ইঞ্জিন ঘোরানোর আর কোনো দরকার হবে না”। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি আবারো ক্ষমতায় এলে, সাইফুর রহমান অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হন এবং আখাউড়ায় সিলেটের মানুষের সুবিধার্থে এক কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করেন। ঢাকা থেকে সিলেট এবং সিলেট থেকে ঢাকাগামী সব ট্রেনের স্টপেজ আখাউড়া থেকে উঠিয়ে দেয়া হলো, যা আজো বহাল আছে।

১৯৯১ সালে রাজনগরে রাগীব আলীর চা-বাগানে দুপুরের লাঞ্চ করে রওনা হলেন ফতেহপুর বাজারে। ফতেহপুর সিলেট এবং মৌলভীবাজারের বর্ডার। বিশাল গাড়ির বহর নিয়ে যখন ফতেহপুর যাওয়ার পথে কাঁচা রাস্তার অবস্থা দেখে এবং জনসভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় জনগণের দাবির মুখে ওই রাস্তা করে দেয়ার প্রতিশ্রæতির দিয়েছিলেন। তিনি তখন ছিলেন টেকনোক্রেট মন্ত্রী। এ ঘোষনার পর সংশ্লিস্ট মন্ত্রনালযের কর্মকর্তাদের আদেশ দিয়েছিলেন যে তা যেন খুব শিঘ্রই মেরামত করা ব্যবস্থা করা হয়। এর ঠিক এক বছর পর তিনি আবারো ফতেহপুর গেলেন এবং সে রাস্তা মেরামতের পর তা পরিদর্শন করলেন।
তিনি ছিলেন একজন দেশদরদি মানুষ। বিশেষত সিলেট বিভাগে যত অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, তার বেশির ভাগ কৃতিত্বের অধিকারী সাইফুর রহমান। তিনি তার কর্মের জন্য মানুষের অন্তরে বেঁচে থাকবেন অন্তকাল। (চলবে)।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com