প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-৩০

  |  ১৪:০৮, জুলাই ০১, ২০২০
www.adarshabarta.com

জোবায়দা রহমানের প্রতি কেন এখনো মানুষের ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রকাশ পায়

:: মোঃ রহমত আলী ::

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রবাহমান ধারায় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় সব সময় বইতে থাকে। সেই ঝড়ের তীব্রতায় এ অঙ্গনে যারা বিচরণ করছেন তারাসহ তাদের অনুসারি অনেকেই কমবেশী বিতর্কের মধ্যে পর্যবসিত হন। তবে তাদের মধ্যে যার উপর দিয়ে সেই ঝড়ের বাতাস কিছুটা কম প্রবাহিত হয় তার নাম জুবায়দা রহমান। আমার এ ধারনার ব্যাপারে হয়তো অনেকেই আমার সাথে একমত হতে পারেন, আবার নাও হতে পারেন। শুধু একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্মগ্রহণকারী হিসাবে নয়, বিদেশে অবস্থানের কারণেও হয়তো এ ঝড় প্রবাহের তীব্রতা কিছু কম হয়। দেশে থাকলে এতদিনে অবশ্যই ঝড়ে আক্রান্ত হয়ে এতদিনে ডানাভাঙ্গা পাখির মত অবস্থা হয়ে যেত তার।

সে যাই হোক, বিগত এক যুগ থেকে তিনি যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। ২০০৮ সালে অসুস্থ স্বামীর সাথে এক প্রতিকূল অবস্থায় একমাত্র মেয়ে জাইমাকে নিয়ে তিনি যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। এরপর স্বামীর সেবা, মেয়ের লেখাপড়া সর্বোপরি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাদের সংসার চলতে থাকে। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এখন হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু যেকোনো সময় আবারও হঠাৎ পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। কারণ রাজনৈতিক পরিবারের মানুষের যেভাবে জোয়ার আসে সেভাবে ভাটার টানও আসে। তবে অনাগত ভবিস্যতই বলে দেবে তা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে।

যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালীন তিনি কিভাবে সময় কাটাচ্ছেন বা কি করছেন সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে প্রাসঙ্গিক ছাড়া কারো কিছু লেখা বা জানার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করিনা। তবে যেহেতু তিনি রাজনৈতিক পরিবারে অবস্থান করছেন, তাই এ ব্যাপারে এখন তার রাজনৈতিক অবস্থান কেমন, আগামী পরিকল্পনা কি হতে পারে, সে ব্যাপারে আলোচনা করা বুদ হয় অসঙ্গত হবে না। অবশ্য ইতিমধ্যেই তিনি রাজনীতিতে পদার্পণ করছেন দলের শেষ কান্ডারী হিসেবে এরকম অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো আলামত এখনও পরিলক্ষিত হয়নি। আর তা পরিলক্ষিত হওয়ার ক্ষেত্র হচ্ছে, আনুষ্ঠানিকভাবে দলের কর্মকান্ডে যোগদান, নতুবা কোন রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া অথবা নির্বাচনে দাঁড়ানো প্রভৃতি। তবে তার কোনটি এখনও পরিলক্ষিত হয়নি।

তবে সেটা দৃষ্টিগোচর না হলেও প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে তাকে রাজনীতিতে সক্রিয় করার। আর সে ধরনের একটি ঘটনা আমার কাছে প্রতিয়মান হয়েছে, ২০১৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার।
সেদিন পূর্ব লন্ডনের ফেয়ারলোপ ওয়াটার কান্ট্রি পার্কে যুক্তরাজ্য বিএনপির পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানের নামে একটি ঈদ পুনর্মিলনী সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে সে সময় যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত জোবায়দা রহমানের শাশুড়ি বেগম খালেদা জিয়া, স্বামী তারেক রহমানের সাথে তিনি সে অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন। আমিও সেখানে অন্যান্য সাংবাদিকদের সাথে আমন্ত্রিত হয়ে যাই। আমার জানা মতে এটি যুক্তরাজ্যে সেদিনই একটি রাজনৈতিক সমাবেশে তার সরাসরি যোগদানের প্রথম ঘটনা । কারণ এতদিন যাবৎ শুধু পারিবারিক ও ঘরোয়া অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান করেননি। যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে।

সে অনুষ্ঠান শুরুর কিছুক্ষণ আগে তিনি ও তার স্বামী একসাথে সভাস্থলে হাজির হন এবং তারা আমাদের অত্যন্ত কাছাকাছি স্থান দিয়ে মঞ্চের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। সে সময় আমরা তাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার এখনো মনে আছে তাকে দেখামাত্র উপস্থিত নেতাকর্মীরা হুমড়ি খেয়ে যখন পড়েছিল তখন তিনি খুবই ভীত হয়ে পড়েছিলেন। এ সময় তার স্বামী বারবার জোবায়দাকে লক্ষ্য করে বলছিলেন, ‘ভয় করো না, আরেকটু অগ্রসর হও- সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তো সবাই আছি, তোমার চিন্তার কারণ নাই’, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ পরিস্থিতি দেখে আমার মনে হল তার স্বামী তাকে এমনভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, যেভাবে কোনো সন্তান যদি স্কুলে না যেতে চায় আর পিতামাতা তাকে আগলে নিয়ে সে স্কুলে পৌছে দেন- অনেকটা সেভাবে। অবশ্য সেখানে তেমন কোন বক্তৃতা পর্ব ছিল না, শুভেচ্ছা বিনিময়ই ছিল এ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য। তাই হয়তো মনে করা হয়েছিল যে, এখানে তাকে নিয়ে এসে যুক্তরাজ্যে তার রাজনৈতিক অভিষেক ঘটানো হবে। কিন্তু সেটা কতটুকু সফল হয়েছে তা তারাই বলতে পারবেন।

এরপর থেকে আমি কয়েকটি সমাবেশে তাকে যোগদান করতে দেখেছি। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, লন্ডন তার পিতা সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খানের ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে খতমে কোরআন, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে যোগদান। এটি পূর্ব লন্ডনের রয়্যাল রিজেন্সি হলে ‘রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খানস্মৃতি সংসদ যুক্তরাজ্য’ শাখার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে মরহুম এম এ খানের জামাতা ও জোবায়দা রহমানে স্বামী তারেক রহমানও উপস্থিত ছিলেন। কয়েকটি বিয়েসাদি বা সামাজিক অনুষ্ঠানেও তিনি যোগ দেন।

এদিকে, গত বছর (২০১৯ সালের) ২৫ জুন সাউদাম্পটনে রোজ বোল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ বনাম আফগানিস্থানের খেলা দেখতে সাউদাম্পটন স্টেডিয়ামের গ্যালারীতে উপস্থিত ছিলেন জোবায়দা রহমান। সুতরাং এভাবেই তিনি মাঝে মধ্যে বিনোদনের জন্য বের হন।

আমি জানিনা জোবায়দা রহমানের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক জীবন কিভাবে নির্ধারিত হবে। তবে এ ব্যাপারে আমি দলীয় কেউ না হলেও একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে একটি বিকল্প প্রস্তাব রাখবো। এটি বিবেচিত হতে পারে। আর সেটি হচ্ছে, যদি জোবায়দা রহমান নিতান্তই রাজনীতিতে না আসতে চান তবে তাকে রাজনীতির মাঠে না নিয়ে আমাই ভাল। কারণ এতে ‘হিতে বিপরিত’ হতে পারে। দেশের এ কর্দমাক্ত রাজনৈতিক পরিবেশের বেড়াজালে পড়ে এতে ‘আমের সাথে ছালাও চলে যেতে পারে’। অর্থাৎ বর্তমানে তাদের পরিবারে যেটুকু মর্যদা অবশিষ্ট আছে সেটুকুও শেষ পর্যন্ত চলে যেতে পারে। তাই যেহেতু তারা যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন এবং তাদের মেয়ে জাইমা রহমান এদেশে লেখাপড়া করছে, তাই তাদেরকে এদেশের রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহনের ব্যাপারে উৎসাহিত করা ভাল। তা হলে তাঁদের পারিবারিক ঐতিহ্য আরো বৃদ্ধি পাবে।

ইতোমধ্যেই এ দেশের পরিবেশ পরিস্থিতির সাথেও তারা পরিচিত হয়ে গেছেন। ডা. জুবাইদা রহমান নিজ মেধা ও কর্মদক্ষতার মাধ্যমে বিশ্বের ৫৫টি দেশের মধ্যে সেরা চিকিৎসকের স্বীকৃতি পেয়েছেন। স্থানীয় ইমপেরিয়াল কলেজ অব লন্ডন থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে মাস্টার্স অব কার্ডিওলজি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। চার বছরের মাস্টার্স অব কার্ডিওলজিতে (এমএসসি ইন কার্ডিওলজি) ডিস্টিংশনসহ শতকরা ৮৩ ভাগ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছেন জোবায়দা। যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথভুক্ত দেশ, নাইজেরিয়া, চীনসহ মোট ৫৫টি দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা এই কোর্সে অংশ নিয়েছিলেন।

এদেশে রাজনৈতিকভাবে ও মানবাধিকারের ব্যাপারে তাদের বংশের আরো অনেকেই কাজ করেছেন ও নানা খেতাব পেয়েছেন। তার মধ্যে আছেন মানবাধিকার সংগঠন এমোনেস্টি ইন্টারন্যাশন্যাল এর সাবেক সেক্রেটারী জেনারেল আইরন খানসহ আরো অনেকে।

জোবায়দা রহমানের দাদা আহমেদ আলী খান এদেশের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে এক সময় তিনটি বিষয়ে এমএ ডিগ্রি নেন। গজনফর আলী খান ১৯৩০ সালে ব্রিটিশদের থেকে অর্ডার অব এমপায়ার খেতাব পান। তাদের বংশের স্যার সৈয়দ আমীর আলী ছিলেন ইংল্যান্ডের রয়্যাল প্রভিন্সিয়্যাল কাউন্সিলের সদস্য। মুক্তিযুদ্ধর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী ছিলেন জোবায়দার পিতা এম এ খানের চাচাতো ভাই। তিনি ছিলেন, ব্রিটিশ আর্মির একজন সর্ব কনিস্ট মেজর।

পিতা মাহবুব আলী খান উচ্চতর শিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যের ডার্টমাউথে রয়্যাল নেভাল কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন। ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর রণতরী ট্রায়াম্পতে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে কৃতী অফিসার হিসেবে তিনি যুক্তরাজ্যে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কর্তৃক পুরস্কৃত হন।

সিলেটের বিরাহীমপুরে জন্মগ্রহনকারী জোবাইদার পিতা মাহবুব আলী খান ও মাতা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু। (চলবে)।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com