প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-২২

  |  ১২:৫৩, জুন ২৩, ২০২০
www.adarshabarta.com

মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধিন বাংলা বেতারের চরমপত্র খ্যাত মুকুলের কথা এখনও স্মরণ হয়

:: মোঃ রহমত আলী ::

যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বা সরাসরি দেখেছেন তাদের পক্ষে এম আর আখতার মুকুলের অবদানের কথা ভুলে যাওয়া সহজ নয়। তিনি ছিলেন, সাংবাদিক, লেখক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত সাড়া জাগানো অনুষ্ঠান ‘চরমপত্র’-এর কথক। সে সময় যুদ্ধের ময়দানে মুক্তিযোদ্ধাদের মনের জোর বাড়িয়ে দিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এ ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানটি। বিদ্রুপ ও শ্লেষাত্মক অনুষ্ঠানটি রচনা ও উপস্থাপন করতেন এই এম আর আখতার মুকুল। শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, দেশের মুক্তিকামী মানুষের জন্যও ছিল এক বিরাট অনুপ্রেরণার উৎস। এ চরম পত্র যুবকদেরকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রানিত করেছে। এ অনুষ্ঠানের ভবিষ্যত বানীতে জয় সুনিশ্চিত জেনে অনেক বিপথগামী যুবক রাজাকারের দলে নাম লিখা থেকে বিরত থেকেছে।

এ অনুষ্ঠানের একটি ডায়লগ ছিল এরকম, “আইজ ভেড়ামারার কাছে আমাগো বিচ্চু পোলাপাইনরা এমুন মাইর দিচে, কমসে কম তেরজন পাকি সৈন্য প্যাঁকের মধ্যে পইড়্যা কাঁতরাইতাছে”। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তিনি “বিচ্ছু” বলতেন। অন্য একটি পর্ব ছিল, “বর্ষা আগত। সারাদেশ জলমগ্ন হবে। পাকীরা সাঁতার জানেনা। বিচ্চুরা শুধু ওদের স্পীড বোট ফুটো করে দেবে। তারপরই কেল্লা ফতে। শত শত পাকসেনা ডুবে মারা পড়বে”। চরমপত্রের এরকম কাহিনী হতাশার মাঝে নিয়ে আসত সাহস আর আশার আলো। মনে হত যুদ্ধ জয়ের বুঝি আর দেরী নেই।

মুকুলের পুরো নাম মুস্তফা রওশন আখতার মুকুল। পিতা বিশিষ্ট সাহিত্যিক সাদত আলি আখন্দ, মাতা রাবেয়া খাতুন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন এবং এ কারণে তাঁকে একাধিকবার জেল খাটতে হয়েছে। ১৯৪৮-৪৯ সালে জেল থেকেই স্নাতক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তিনি সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়াার পর এম আর আক্তার মুকুলকে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক নিয়োগ করা হয়। ১৯৭২ সালে তিনি লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশনের প্রেস মিনিস্টার হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এ চাকরি হারিয়ে অনেক বছর তিনি লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন। ১৯৮৭ সালে দেশে ফিরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র সম্পাদনার দ্বিতীয় পর্যায়ে কিছুদিন কাজ করেছেন। পরে তিনি ঢাকায় সাগর পাবলিশার্স নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

চরমপত্র অনুষ্ঠানে তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অসংলগ্ন অবস্থানকে পুরনো ঢাকার আঞ্চলিক ভাষার সংলাপে তা তুলে ধরতেন। চরমপত্রের পরিকল্পনা করেন আবদুল মান্নান। এ অনুষ্ঠানটির নামকরণ করেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের কর্মী আশফাকুর রহমান খান। এটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হওয়ার দিন ২৫শে মে থেকে একটানা ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দিন পর্যন্ত প্রতিদিন প্রচারিত হত। মানসম্মত রেকর্ডিং স্টুডিওর অভাবে টেপ রেকর্ডারে ‘চরমপত্র’ রেকর্ডিং করা হতো এবং ৮-১০ মিনিটের এই টেপ নিয়মিতভাবে প্রচারিত হতো। আর এ জন্য এর প্রতিটি অনুষ্ঠানের রচনা ও ব্রডকাস্টিং-এর জন্য এম আর আখতার মুকুল এর পারিশ্রমিক নির্ধারিত ছিল ৭ টাকা ২৫ পয়সা।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আরো কিছু জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল বজ্রকণ্ঠ, জল্লাদের দরবার ইত্যাদি। জল্লাদের দরবার পরিচালনা করতেন কল্যাণ মিত্র। অনুষ্ঠানটিতে তিনি ইয়াহিয়া খানকে “কেল্লা ফতে খান” হিসেবে হাস্যরসাত্মকভাবে ফুটিয়ে তুলতেন। আর “বজ্র কণ্ঠ” অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের সম্প্রচার করা হত। যুদ্ধের সময়ে প্রতিদিন মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো এ কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার জন্য।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল সে সময়ে আমাদেরমুক্তিযুদ্ধের একমাত্র সম্প্রচার কেন্দ্র, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। আর দেশ স্বাধিন হওয়ার পর এর নাম রাখা হয়, “‌‌বাংলাদেশ বেতার”।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের পর মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ সরকার ও বেতারকেন্দ্রের কর্মীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ভারত সরকার একটি ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার প্রদান করে। প্রথম অধিবেশনের দিন ধার্য করা হয় ২৫ মে। কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ৫৭/৮ নং দোতলা বাড়িটিতে একটি কক্ষে উক্ত ট্রান্সমিটার দিয়ে সম্প্রচার শুরু হয়েছিল। এই কেন্দ্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠান বাংলাদেশের শত্রু কবলিত এলাকার জনগোষ্ঠী ও ভারতে অবস্থানরত বাঙ্গালী শরণার্থীদের মনোবল বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

তিনি ১৯৯৫ ইংরেজিতে লন্ডনে আসলে তাঁর সাথে আমার দেখা হয়, তখন তার কাছ থেকে সেই স্মৃতির কিছু আলোচনা রোমন্থন করি।
এ চরমপত্রের কিছু ডায়লগ এখানে উপস্থাপন করা হলো। “আঁতকা ঠাস ঠাস কইরা আওয়াজ হইল। ডরাইয়েন না, ডরাইয়েন না! মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী চুলে ভর্তি সিনা চাবড়াইতে শুরু করছে। ‘পদ্মা নদীর কূলে আমার নানা মরেছে, পদ্মা নদীর কূলে আমার নানি মরেছে—গাবুর বাড়ির চোটে আমার কাম সেরেছে।’ ব্যস, মওলবি রাও ফরমান আলী জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্টের কাছে খবর পাডাইল, ‘হে প্রভু, তোমার দিলে যদি আমাগো লাইগ্যা কোনো রকম মহব্বত থাইক্যা থাকে, তা হইলে তুরনদ আমাগো কইয়া দাও; কীভাবে বিচ্চু আর হিন্দুস্থানি ফোর্সের পা জাপটাইয়া ধরলে আমার লেডুলেড়া আর ধ্বজভঙ্গ মার্কা বাকি সোলজারগো জানডা বাঁচানো সম্ভব হইব।’

এই খবর না পাইয়া একদিকে জেনারেল পিঁয়াজি আর একদিকে সেনাপতি ইয়াহিয়া কী রাগ? সেনাপতি ইয়াহিয়া লগে লগে উথান্টের কাছে টেলিগ্রাম করাল, ‘ভাই উথান্ট, ফরমাইন্যার মাথা খারাপ হওনের গতিকেই এই রকম কারবার করছে। হের টেলিগ্রামটা চাপিশ কইর্যা ফালাও।’ এই দিকে আমি ছ্যার শাহ নেওয়াজ ভুট্টোর ‘ডাউটফুল’ পোলা, পোংটা সরদার জুলফিকার আলী ভুট্টোরে মিছা কথা কওনের ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করণের লাইগ্যা জাতিসংঘে পাডাইতাছি। পোলডারে একটুকু নজরে রাখবা। বেডার আবার সাদা চামড়ার কসবিগো লগে এথি-ওথি কারবার করণের খুবই খায়েশ রইছে।

ক্স সাবে কইছে কিসের ভাই, আহ্লাদের আর সীমা নাই। সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের হবু ফরিন মিনিস্টার জুলফিকার আলী ভুট্টো ব্র্যাকেটে শপথ লওনের টাইম হয় নাইক্যা ব্র্যাকেট শেষ জাতিসংঘে যাইয়া পয়লা রিপোর্টারগো লগে বেশ কায়দা কইর্যা লুকোচুরি খেলতে শুরু করল। তার-পর। জাতিসংঘের ডায়াসে আঁতকা কয়েক দফায় কান ধইর্যা ‘উঠ-বস’, ‘উঠ-বস’ কইর্যা ভুট্টো সাবে ছিল্লাইয়া কইল, ‘আর লাইফের এই রকম কাম করুম না। বঙ্গাল মুলুকে আমরা গেনজাম কইর্যা খুবই ভুল করছি। আমরা মাফ চাইতাছি, তোওবা করতাছি, কান ডলা খাইতাছি। আমাগো এইবারের মতো ক্ষেমা কইর্যা দেন।’
ক্স কিন্তু ভুট্টো সাব। বহুত, লেইট কইর্যা ফালাইছেন। এই সব ভোগাচ কথাবার্তায় আর কাম হইব না। আঁতকা ঠাস ঠাস কইর্যা আওয়াজ হইল। কী হইল? কী হইল? জাতিসংঘে ভেটো মাইর্যা সোভিয়েত রাশিয়া হগগল মিচকি শয়তানরে চিৎ কইর্যা ফালাইছে। কইছে, ফাইজলামির আর জায়গা পাও না? বাঙালি পোলাপান বিচ্চুরা যহন লাড়াইতে ধনা-ধন জিততাছে, তহন বুঝি লাড়াই বন্ধ করণের নানা কিসিমের ট্রিকস হইতাছে না?

এইদিকে সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের পরাণের পরাণ জানের জান চাচা নিকসন, কড়া কিসিমের ট্রিকস করণের লাইগ্যা সপ্তম নৌবহররে সিঙ্গাপুরে আনছে। লগে লগে ক্রেমলিন থাইক্যা হোয়াইট হাউসরে অ্যাডভাইসিং করছে একটুক হিসাব কইর্যা কাজ-কারবার কইরেন। প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি কইছে, ভারত উপমহাদেশে বাইরের কেউ নাক না গলালেই ভালো হয়। ব্য-স-স, আমেরিকার সপ্তম নৌবহর সিঙ্গাপুরে আইস্যা নিল-ডাউন হইয়া রইল।
অ্যাঁ অ্যাঁ! এই দিককার কারবার হুনছেন নি? হ্যারাধনের একটা ছেলে কান্দে ভেউ ভেউ, হেইডা গেল গাথার মাইদ্দে রইল না আর কেউ। জেনারেল পিঁয়াজি সাবে সরাবন তহুরা দিয়া গোসল কইর্যা ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের মাইদ্দে হান্দাইয়া এখনো চ্যাঁ চ্যাঁ করতাছে’ আমার ফোর্স ছেরাবেরা হইলে কী হইব, আমি পাইট করুম আমি পাইট করুম।’
আমাগো মেরহামত মিয়া আঁতকা চিল্লাইয়া উঠল। এইডা কী? এইডা কী? জেনারেল পিঁয়াজি সাবের ফুলপ্যান্টের দুই রকম রং দেখতাছি কীর লাইগ্যা? সামনের দিকে খাকি রং, পিছনের মুড়া বাসন্তি রংকেইসডা কী? অনেক দেমাক লাগাইলে এর মাজমাডা বোঝন যায়।
হেইর লাইগ্যা কইছিলাম। মেজিক কারবার। ঢাকায় অখন মেজিক কারবার চলতাছে। চাইরো মুড়ার থনে গাবুর বাড়ি আর কেচ্কা মাইর খাইয়া ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়া সোলজারগুলা তেজগাঁ-কুর্মিটোলায় আইস্যা-আ-আ-আ দম ফালাইতাছে।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com