প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-৯

  |  ১৭:৪৪, জুন ১০, ২০২০
www.adarshabarta.com

ম্যান্ডেলার ছবি যে কারণে আমাকে তুলতে দেওয়া হয়নি

:: মোঃ রহমত আলী ::

এক সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল দুনিয়া জুড়ে। আর সেই বিস্তৃতির অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্র সমন্বয়ে স্বেচ্ছাসেবী যে আন্তর্জাতিক সংগঠন রয়েছে তা-ই কমনওয়েলথ নামে পরিচিত। বর্তমানে বিশ্বের ৫৪টি স্বাধীন রাষ্ট্র এর অন্তর্ভুক্ত। আফ্রিকা থেকে ভারত, প্রশান্ত মহাসাগরের তীর থেকে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখন্ডে কমনওনওয়েলথের কমবেশি ১৬০ কোটি জনগোষ্ঠী রয়েছে যা হচ্ছে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ সকল সদস্য-রাষ্ট্রের পক্ষে কমনওয়েলথের প্রধান হিসেবে রয়েছেন। প্রতি দু‘বছর পর পর এর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৭ সালের সম্মেলন স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবার্গে ২৪, ২৫ ও ২৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয়। এতে আমার যোগদানের সৌভাগ্য হয়েছিল। তবে আমার যাওয়ার বিশেষ উদ্ধেশ্য ছিল এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের অভিজ্ঞতা অর্জন এবং সাথে সাথে কিছু ছবিও তুলে নেয়া। তাই তখন কর্মরত সাপ্তাহিক সুরমার পক্ষ থেকে একজন ফটোগ্রাফার হিসাবে পাস সংগ্রহ করি। কারণ পত্রিকার সিনিওর সাংবাদিকগন নিউজ কাভারেজ করেছিলেন। আর ফটোগ্রাফার হিসাবে পাস পাওয়ায় একটা বিশেষ সুবিধাও ছিল। এর ফলে বিভিন্ন দেশের রাস্ট্র ও সরকার প্রধানদের অনেকটা কাছাকাছি গিয়ে ছবি তোলার সূযোগ সৃস্টি হয়।

উক্ত সম্মেলনের প্রধান আকর্ষন ছিলেন, নেলসন ম্যান্ডেলা, যিনি তাঁর সম-বর্ণের স্বাধীনতা ও মহাবিপ্লবের প্রতীক হিসেবে আজও নক্ষত্রের মতো প্রজ্বলিত। আধুনিক পৃথিবীতে নেলসন ম্যান্ডেলাকে চেনে না এমন বিরল লোকের দেখা পাওয়া ভার। নেলসন ম্যান্ডেলাকে সবারই মন ভরে জানতে ইচ্ছে করে। কাছে পেলে ছবি তোলারও অভিলাস জাগে। কারণ নেলসন ম্যান্ডেলা পৃথিবীর অন্যতম এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। নেলসন ম্যান্ডেলার পুরো নাম ‘রনি লালা দালিভুংগা ম্যান্ডেলা’ বা নেলসন ম্যান্ডেলা। ‘রনি লালা’ শব্দের অর্থ ঝড়ঝঞ্ঝা।
১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের একটি ছোট্ট গ্রামে ম্যান্ডেলার জন্ম হয়েছিল। রাজনৈতিক কারণে ১৯৫৬ সালে প্রথমবার তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ আনা হয় এবং গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। এর এক বছর পর ১৯৫৭ সালে মুক্তি লাভ করলেও ১৯৬৪ সালে আবারও হঠাৎ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর এক সংক্ষিপ্ত সময়ের বিচারের মাধ্যমে একই সালে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করা হয়। তারপর অন্তরীণ করে রাখা হলো দক্ষিণ আফ্রিকার ঐতিহাসিক নির্জন রোবেন দ্বীপে। এরপর শৃঙ্খলিত অবস্থায় নির্যাতনের ভিতর দিয়ে কেটে যায় ১৮টি বছর। এরই মাঝে তার মমতাময়ী মা এবং স্নেহধন্য পুত্রের মৃত্যু হয়। মা এবং পুত্রের লাশটি পর্যন্তু দেখার সুযোগ দেয়া হয়নি তাঁকে। ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন শেতাঙ্গ সরকার রাজনৈতিকভাবে ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৯৪ সালে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচনে সে দেশের ৪০০টি আসনের মধ্যে ২৫২টি আসন পেয়ে তার দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তিনি প্রেসিডেন্টে হন। এরপর ১৯৯৯ সালে তিনি স্বেচ্ছায় প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। ফলে তিনি হয়ে যান বিশ্বের এক অবিসংবাদিত নেতা।

ম্যান্ডেলা তখন কারাগারে ছিলেন, তখন থেকে নানা স্বাস্থ্যসংক্রান্ত জটিলতায় ভুগছিলেন। এর মধ্যে তার চুঁেখর সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। কারণ রোবেন দ্বীপে নির্বাসনে থাকার সময় ম্যান্ডেলাকে নিজের হাতে পাথর ভাঙার কাজ করতে হতো। দিনের পর দিন পাথরের অতিক্ষদ্র কণা তাঁর চোঁখে ঢোকে। এতে তাঁর ভিষন সমস্যা দেখা দেয়। যে কারণে ১৯৯৪ সালে ম্যান্ডেলার চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়। এর পর তার ছবি তুলতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

এদিকে সেই সম্মেলনে উপস্থিত প্রায় সবার গভীর আগ্রহ ছিল ম্যান্ডেলাকে নিয়ে। তিনি কখন বক্তৃতা করবেন তার অপেক্ষায় ছিলেন সবাই। এক সময় তিনি মঞ্চে আসলেন। তখন অন্যান্য গ্যালারীর মত সাংবাদিকদের গ্যালারীতেও তিল ধারণের জায়গা ছিল না। ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দে মুখরিত হয়ে উঠে হলরুম। অনেকটা ধাক্কাধাক্ষির পর্যায়ে পরিস্থিতি দাঁড়ায়। কে কার আগে, কিভাবে ছবি তুলবে এটাই ছিল তখনকার একমাত্র কর্মযজ্ঞ। আমিও এগিয়ে গেলাম ছবি তোলার জন্য। কিন্তু আমাকে সিকিউরিটি আটকে দিল আরো কয়েকজনের মত। সাথে সাথে কোন কথা না বলে তার মুখের কাছে আঙ্গুল নিয়ে চুপ হয়ে বসে পড়ার জন্য বলে দিল সেই সিকিউরিটি। আমি নতুন ফটোগ্রাফার হওয়ায় সিকিউরিটির ইশারা বুঝলেও কি কারেণে সূযোগ দেয় হলো না তা প্রথমে বুঝতে পালাম না। তাই হতাশ হয়ে বসে পড়লাম। মনে মনে ভাবলাম এত কষ্ট করে আসলাম তাই অন্তত ছবিটা যদি তুলতে না পারি তা হলে তো ষোল আনাই মিছে। আমি তখন আমার পাশে থাকা আরেকজন ফটোগ্রাফারের কাছে এর কারণ জানতে চাইলাম। সে কিছু না বলে শুধু আমার ক্যামেরার দিকে ইশারা করলো আর কিছু বল্ল না। আমি তখনও কিছু বুঝলাম না। কারণ তার মত ক্যামেরা তো আমারটাও। আরো কিছুক্ষন চলে গেল। ম্যান্ডেলার বক্তৃতা প্রায় শেষ পর্যায়ে। আমার মধ্যে তখন হতাশা আরো বৃদ্ধি পেতে লাগলো। এভাবে একসময় ম্যান্ডেলার বক্তৃতা শেষ হয়ে গেল সিকিউরিটিও চলে গেল। আমরা কয়েকজনও বসে থাকাকালীন অন্যান্য সবাইও চলে গেল।

অবশেষে আমাদেরও চলে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তাই হতাশ বদনে সেখান থেকে বের হয়ে আসলাম। এরপর যখন হলের বাইরে চলে আসলাম তখন বিষয়টির আদ্যপান্ত জানতে পারলাম, কি কারণে আমাদের ছবি তুলতে দেয়া হলো না। আর যে কারণটি জানলাম সে কারণে আমরাও বিব্রত হলাম। ভাবলাম তা হলেতো সিকিউরিটি অন্যায় করেনি। আমাদেরই ছিল সেটা গলদ। আর সেটা একেবারে ক্যামেরায়। অর্থাৎ ক্যামেরার ফ্লাশ লাইট। অনুষ্ঠান শুরুর সময় নাকি জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, কেউ ফ্লাশযুক্ত ক্যামেরা ব্যবহার করতে পাবেন না। কারণ ম্যান্ডেলার চুখের সমস্যা থাকায় এটা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আমরা প্রথমে সেটা লক্ষ্য করিনি। এ জন্য শুধুমাত্র যাদের ক্যামেরায় ফ্লাশ ছিল না তারাই কেবলমাত্র ছবি তুলতে পেরেছে।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com