প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-৪

  |  ১৫:০৬, মে ৩০, ২০২০
www.adarshabarta.com

অন্য দেশের প্রেসিডেন্টের মেয়ের সাথে বাংলাদেশী ছেলের বিয়ে প্রসঙ্গ

:: মোঃ রহমত আলী ::

বাংলাদেশী নারী-পুরুষের সাথে ভীনদেশীদের বিয়ের সম্পর্কটি সাধারন পরিবারের মধ্যে অনেকটি থাকলেও অসাধারণ পরিবারের মধ্যে খুব কমই লক্ষ্য করা যায়। আমার জানামতে জর্ডানের রাজপরিবারে একজন বাংলাদেশী মহিলার অনুপ্রবেশ ঘটলেও তিনি মুকুটলাভ করতে পারেননি। আর মুকুট বিহীন শীর্ষ রাজনৈতিক পরিবারে যার নাম আমার জানা আছে তিনি হচ্ছেন, যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশী বংশোদ্ভ‚ত আইনজীবি শোয়াইব শাহ। তিনি পেশায় একজন ব্যারিস্টার। বিয়ে করেছেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মামুন আব্দুল গাইয়ুমের মেয়েকে। নাম দানিয়া মামুন। অবশ্য মামুন আব্দুল গাইয়ুম এখন সাবেক প্রেসিডেন্ট। তবে মেয়ে দানিয়া বিয়ের পর একসময় সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পাল করেছিলেন। বর্তমানে তিনিও সাবেক পররাস্ট্র মন্ত্রি।

ব্যারিস্টার শোয়াইব এর সাথে ১৯৯৫ সালে দানিয়া মামুনের বিয়ে হয়। সে সময় থেকেই তাঁরা বার্মিংহামে বসবাস করছেন। বিয়ের পূর্বে তাঁরা একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করতেন এবং সেখান থেকেই পরিচয় ও পরে প্রণয়। দানিয়া মামুনের বাবা মামুন আবদুল গাইয়ুম মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে উভয় পরিবারের সম্মতিতে তাঁদের বিয়ে হয়। বর্তমানে তাঁদের ঘরে ৩টি সন্তান রয়েছে। তারা হচ্ছে – রাফফান শাহ, ঈয়াদ শাহ ও সারাহ শাহ।

আমি তখন লন্ডনের সাপ্তাহিক সুরমা পত্রিকায় বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতাম। একদিন খবর পেলাম যে, একজন বাংলাদেশী পুরুষের সাথে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তারা বার্মিংহামে বসবাস করেন। এ সংবাদ পাওয়ার পর এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানার আগ্রহটা আমার বেড়ে গেল। সুরমা পত্রিকার প্রধান সম্পাদক বেলাল ভাই ও সম্পাদক এমাদ ভাইও এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেন। এদিকে এ খবরটা ইতিমধ্যেই আমাদের সুরমা পত্রিকার তৎকালীন ঢাকা প্রতিনিধি ও অধুনালুপ্ত বাংলা বাজার পত্রিকার সম্পাদক জনাব মতিউর রহমান চৌধুরীর (বর্তমানে দৈনিক মানব জমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক) সাথে আলোচনাক্রমে জানাজানি হয়ে যায়। তিনিও এ ব্যাপারে দারুন আগ্রহ দেখালেন এবং বল্লেন, যে কোনভাবে খুঁজে বের করে যেন একটা সাক্ষাৎকার নেই এবং সুরমায় প্রকাশের পর যাতে তা বাংলাবাজার পত্রিকায় পাঠাই। তিনি আরও বলে রাখলেন, বাংলাদেশে তাদের বাড়ি কোথায় সেটাও যেন তাকে জানাই।
এরপর খোঁজ নিতে শুরু করলাম এ দম্পতির সন্ধান লাভ করার জন্য। অনেক খোঁজাখুজির পর তাদের ঠিকানা সংগ্রহ করলাম। এরপর সূযোগ খুঁজতে লাগলাম সেখানে যাওয়ার জন্য। আমার যেহেতু গাড়ি ছিল না তাই ট্রেনে বা বাসে না গিয়ে অন্য কারো গাড়ীতে করে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম। কারণ লন্ডন থেকে বার্মিংহাম গিয়ে কাজটি সেরে আসতে বেশ কয়েক ঘন্টার প্রয়োজন। এমতাবস্থায় একদিন যুক্তরাজ্য গণদাবী পরিষদের তৎকালীন সভাপতি হুমায়ুন কবির (পরবর্তীতে ক্রয়ডন কাউন্সিলের মেয়র) বার্মিংহামে তাদের একটি সভায় যোগদানের আমন্ত্রন জানালেন। আমি তখন এ সূযোগ হাতছাড়া করলাম না। তবে তার সাথে শর্ত ছিল যে, আমি তাদের সভায় যোগদান করবো ঠিকই কিন্তু তিনি যাতে আমাকে এ সাক্ষাৎকার গ্রহনের ব্যাপারে সহযোগিতা করেন। তিনি তাতে রাজি হলেন। তাই আমি প্রস্তুতি নিলাম সেখানে যাওয়ার জন্যে।

দিনটি ছিল রবিবার, ১৯ নভেম্বর-১৯৯৫। আমরা তিনজন একসাথে বার্মিংহামের উদ্ধেশ্যে রওয়ানা দিলাম। আমাদের সাথে আরো ছিলেন যুক্তরাজ্য
গণদাবী পরিষদের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারী নুরুল ইসলাম পুতুল (পরে ক্যামডন কাউন্সিলের মেয়র)। প্রথমে গণদাবী পরিষদের সভায় যোগদান করলাম। কিন্তু সভা শেষ করতে গিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। তাই সন্ধ্যার পর পরই সেখানে পৌছলাম। ভাগ্য ভালই ছিল। কারণ সেখানে গিয়েই তাদেরকে নিজ ঘরে পেয়ে যাই। আমাদেরকে প্রথমে আন্তরিকতার সাথে স্বাগত জানালেন বর সোয়াইবের পিতা মাওলানা এম এ রহিম। তিনি তখন বার্মিংহাম ইসলামিক সেন্টারের পরিচালক ও স্থানীয় মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখতে পেলাম বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেও তার রেশ তখনও রয়ে গেছে। ঘরে বিয়ের সময়ের সাজসজ্জা অনেকটা তখনও বিদ্ধমান ছিল। ঘরের মেঝে অনেক দামি কার্পেট মোড়ানো, দেওয়ালে আধুনিক ও মূল্যবান কারোকার্য এবং সর্বোপরি অনেকটা রাজকীয় ধরনের আসবাবপত্র ইত্যাদি।

আমরা প্রথমেই বরের পিতার সাথে আলোচনা শুরু করলাম। তিনি জানালেন, বিয়েটি উভয় পরিবারের সকলের সম্মতির ভিত্তিতেই হয়েছে। বিয়ের সময় ও পরে মেয়ের পিতা তাদের ঘরে এসেছেন। এ আলোচনার একপর্যায়ে সুয়াইবও আমাদের সামনে হাজির হলেন। আমরা তখন তাদের উভয়ের সাথে কিছু আলাপ করবো বলে জানালে তাদের ঊভয়কেই সেখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হলো। আমরা তখন সরাসরি তাদের সাথে কথাবার্তা শুরু করি। তখন জানতে পারি দানিয়া মামুন নিজ দেশে লেখাপড়া শেষে ১৯৯২ সালে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে সোশ্যাল এন্ত্রপলিজিতে বিএ অনার্স ও ১৯৯৫ সালে বৃটেনের বিশ্বখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এলএসই থেকে পলিটিক্যাল সাইন্সে এমপিল ডিগ্রি লাভ করেন। আর সুয়াইব ব্যারিস্টারী লেখাপড়া করছেন। তাই এ লেখাপড়ার সূত্র ধরেই একজনের সাথে অন্যজনের পরিচয় এবং পরবর্তীতে প্রণয়।

আমরা তখন অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও ব্যক্তিগত নানা বিষয়ে জানার চেষ্ঠা করি। জানলাম, সুয়াইব এর জন্মেরর সাথে বাংলাদেশের জন্মের একটা বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ তার জন্ম তারিখ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এবং দানিয়ার জন্ম তারিখ ১৯৭২ সালের ২০ মার্চ। সে হিসাবে বর কণের চাইতে এক বছরের বড়। তাদের বিয়ে লন্ডনেই অনুষ্ঠিত হয়। এতে মেয়ের পিতা যোগদান করেছিলেন। উভয় পক্ষের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনও এতে যোগদান করেন।

উল্লেখ্য, বিয়ের পর দানিয়া মামুন একসময় নিজ দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন ও সে দেশে তিনি প্রথমে ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে শোয়াইব এর শশুড় মামুন আব্দুল গাইয়ুমু বিয়ের সময় বা পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন লন্ডনে মেয়ের বাড়িতে আসলেও কন্যা দানিয়া মামুন কখনও তাঁর শ্বশুর বাড়ি বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নে গিয়েছিলেন কিনা তা জানতে পারিনি।

তবে বেগম খালেদা জিয়া যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রি ছিলেন তখন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মামুন আব্দুল গাইয়ুমের সাথে জাতীসংঘের সাধারণ পরিষদে এক নৈশভোজের সময় সাক্ষাৎ হলে গাউয়ুম বেগম খালেদা জিয়াকে রসিকতা করে ‘বিয়াইন’ হিসাবে ইল্লেখ করলে তা মিডিয়ায় প্রকাশ পায়। (চলবে)।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com