প্রচ্ছদ

মরমী কবি শেখ ভানু শাহ

  |  ০৭:০৯, মে ১৮, ২০২০
www.adarshabarta.com

অকেয়া হক জেবু

“নিশীতে যাইও ফুল বনে রে ভ্রমরা,

নিশিতে যাইয় ফুল বনে ।”

ভাটিবাংলার মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয় এই গানের রচয়িতা মরমী সাধক, লেখক, কবি ও তত্ত্ব কথার উদ্ভাবক শেখ ভানুশাহ ১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দে, ১২৫৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে ৩ তারিখ হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলার বামৈ ইউনিয়নের ভাদিকারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম মুন্সি নাসির উদ্দিন । শেখ ভানুশাহ ছিলেন মা-বাবার একমাত্র সন্তান । তাঁর পিতা গ্রামের মক্তবে মুন্সিয়ানা করে সংসার চালাতেন । পিতার কাছে ভানু শাহের হাতেখড়ি । প্রাতিষ্টানিক শিক্ষা বা সনদ ছাড়াই আধ্যাত্বিক কবিতা, মরমী সংগীত, পুঁথি, বারমাসি, ত্রিপদী, পঞ্চপদী ইত্যাদি রচনা করে বাংলা সাহিত্যে অনন্য অবদান রেখেছেন ভানু শাহ ।

শাহজালালের উত্তরসূরী হয়ে যে সকল সূফী সাধকগণ পূণ্যভূমি সিলেটে প্রচার করে গেছেন, শেখ ভানু শাহ তাদের মধ্যে অন্যতম । মরমী এই কবি সিলেটের লোককবি ও মরমী সাধক ছিলেন । ১৯৩৩ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির উদ্যোগে কলকাতায় অনুষ্টিত সাহিত্য সম্মেলনের মধ্যে বাংলাদেশের মরমী কবিদের মধ্যে চারজনকে দার্শনিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । এই চারজন হলেন –

১। লালন শাহ

২। শেখ ভানু শাহ

৩। শেখ মদন শাহ

৪। হাসন রাজা

শেখ ভানু শাহ’র বয়স যখন দশ, তিনি বুঝতে পারলেন সংসার চালাতে তাঁর পিতার কষ্ট হচ্ছে । এমতাবস্থায় তিনি সংসারের হাল ধরার জন্য ব্যবসায়ী কাজে নিযুক্ত হন । এই অল্প বয়সেই তিনি স্থানীয় ও আশপাশের বাজার থেকে ফল-ফলাদি ক্রয় করে বামৈ বাজারে বিক্রি করতেন । পর্যায়ক্রমে সিলেট, ছাতক থেকে কমলা ক্রয় করে মাদনা, বামৈ এবং পরবর্তীতে ভৈরব বাজারে বিক্রি করতেন । তারপর কাচামালের ব্যবসা ছেড়ে ধানের ব্যবসা শুরু করেন । তাঁর ব্যবসায় লেনদেনের সততার পরিচয় পেয়ে অল্প দিনের মধ্যেই মহাজনের নিকট বিশ্বাসের পাত্র হিসেবে গণ্য হন এবং ভানু বেপারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন ।

কোন একদিন বড় একটি নৌকায় ধান বোঝাই করে নদী পথে ভৈরব বাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন ভানু বেপারী । মাঝিদের বৈঠার টানে নৌকা ভাটির দিকে বেশ দ্রুত এগুচ্ছে । বর্ষার মৌসুমে নদীর দু’কূল ভরে উঠেছে জল । বেপারী ভানু আপন মনে নৌকার ছৈয়ের উপর বসে নদী মাতৃক বাংলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখছেন । হঠাত চোখে পড়ল কয়েকটি কাক নদীতে একই স্থানে উড়াউড়ি করছে । তীরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দে কাক গুলোকে তাড়াতে চেষ্টা করছে । এ দেখে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো তাঁর দৃশ্যটির প্রতি । “কানলারবাগ” নামক একটি বাঁকে নৌকা কাছাকাছি আসলে দেখতে পান, একটি মৃত দেহ নদীর স্রোতে ভেসে যাচ্ছে । লাশের বুকের উপর কাক বসে চোখ টেনে টেনে খাচ্ছে, এইম দেখে ভানু কেঁদে উঠলেন । তখন তাঁর জীবনের উপর জিজ্ঞাসা এলো, সোনার বরণ দেহ কেন কাকে খায়? কেন মাছ-মাছালি টেনে খায় জলের মধ্যে? মনে ভাবান্তর হলো । গোমস্তাকে নৌকা ভিড়াতে নির্দেশ দিয়ে বললেন – নৌকার ধানের হিসাব তুমরা মহাজনকে বুঝিয়ে দিয়, আমার আর ব্যবসায়ে কাজ নেই । নৌকা কূলে ভিড়ালে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুধু করলেন ভানু । সাথীদের মধ্যে একজন তাঁর পিছু নেয় । সমস্ত পথ ভাবনায় কখনো কাঁদেন, কখনো হাসেন এমনি করে আপন মনে হেসে কেঁদে গান গেয়ে মতিচ্ছন্ন হয়ে বাড়িতে এসে পৌঁছেন । তখন থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন শেখ ভানু ।

একদিন সংবাদ এলো – গাউসুল আজম বড় পীর আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ) এর দরগাহের একজন খাদেম বেলায়েত প্রাপ্ত কামিল সাধক সৈয়দ নাসির উদ্দিন ওরফে মিরান শাহ স্থানীয় বামৈ বাজারের কাছে নোঙর ফেলে যাত্রা বিরতি করছেন ।

শেখ ভানু শাহ’র বন্ধুদের কাছে রুগীর হালত শুনে মিরান শাহ ছোট নৌকা যোগে ভানু শাহের বাড়িতে আসেন । সারারাত যিকির বয়ান করে কাটালেন, শেখ ভানু তাঁর প্রশ্নের উত্তর পেলেন । শেখ ভানু শাহ মিরান শাহের কাছে বয়াত হলেন এবং ধীরে ধীরে সুস্থ্য হয়ে উঠলেন । দুনিয়াদারী সবকিছু ফেলে আধ্যাত্বিক সাধনায় নিয়জিত হলেন ।

শেখ ভানুর আধ্যাত্নশক্তি, চিন্তাধারা ও জীবনদর্শন নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায়, তিনি মানবতাবাদি কবি ছিলেন । ধর্মান্ধের ক্ষুদ্র গন্ডিতে তিনি আবদ্ধ না থেকে মানবতা প্রচারে নিবেদিত ছিলেন । তিনি পথভুলা বেপথে চলা মানব গোষ্টিকে হেদায়াতের সুগম পথ দেখিয়েছেন । তিনি ঈমানদার হওয়ার কথা বলেছেন । তিনি বলেন –

“যাহার ঈমান নাই ধরের ভিতর,

বৃথা সে মনুষ্য হইলো দুনিয়ার উপর ।”

শেখ ভানু শাহের রচনাবলী সাহিত্য মূল্যায়নে দেখা যায়, তিনি ঊনবিংশ শতাব্দির কবি ছিলেন । শেখ ভানুকে কেউ কেউ দার্শনিক কবি, সূফি মরমী কবি, লোককবি স্বভাবিকরূপে পরিচিত করেছেন । তাঁর গান গুলো আধ্যাত্বিক গান, মারফতি গান, মুর্শিদি গান, মরমী গান, দেহতত্ত্ব গান, পল্লী গান, লোক সংগীত প্রভৃতিতে চিহ্নিত করা হয়েছে । শেখ ভানু সাহিত্য রচনার আরো একটি অন্যান্য বৈশিষ্ট হলো তিনি কেবল গান রচনা করেননি, তিনি একাদারে পুঁথি, কালাম, বারোমাসি, হামদ, না’ত, গজল, মোনাজাত প্রভৃতি রচনা করেছেন ।

শেখ ভানু শাহের পুঁথি নামে “কলিকাতা বটতলায়” মুদ্রিত হইতো –

“যাইতে হবে পিঞ্জিরা ছাড়িয়া প্রাণো শুয়ারে

যাইতে হবে পিঞ্জিরা ছাড়িয়া ।”

যখন শেখ ভানু শাহ’র বয়স প্রায় ৭০, বার্ধ্যক্যে ভুগছিলেন তিনি । এ অবস্থায় কোন পরিবর্তন হচ্ছে না । হঠাত ভানু শাহ বললেন – আমাকে উঠাও । তারপর তিনি ওযু করলেন, ফজরের আজানের বাকি আছে । ভানু বললেন – আমাকে মায়ের কবরের পাশে কবর দিও । হুজুর ক্বেবলা জানাজা পড়াবেন । তুমরা সকলে আমাকে মাফ করে দিও । সাথে সাথে কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে আধ্যাত্বিক ও মরমী কবি শেখ ভানু শাহ ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে, ১৩২৬ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের ৩ তারিখ রোজ শুক্রবার ইহকাল ত্যাগ করেন । তারপর মায়ের কবরের পূর্ব পাশে শেখ ভানুকে সমাহিত করা হয় । জানা যায় তাঁর জন্ম তারিখও কার্তিক মাসের ৩ তারিখই ছিল ।

লাখাই উপজেলার সদর থেকে প্রায় ১ কিঃমিঃ দূরে নিজ গ্রাম ভাদিকারায় শেখ ভানু শাহের মাজার অবস্থিত । বর্তমান সাল ২০১৯ তথা ভানু শাহের মৃত্যুর প্রায় ১০০ শত বছর পর স্বশরীরে গিয়ে দেখতে পাই – শেখ ভানু শাহের ব্যবহৃত জিনিসপত্র এখনো অক্ষত অবস্থায় বিদ্যমান আছে । রয়েছে শত বছরের পুরনো শেখ ভানু শাহের ব্যবহৃত লোহার সিন্ধুক, রয়েছে নিখুঁত কারুকাজের কাঠের পালং, কাঠের পাটাতন । ঘরের মধ্যে রয়েছে কাঠের সিঁড়ি, আরোও রয়েছে বিশাল আকারের তামার হাঁড়ি । তাছাড়া কয়েকটুকরো পাথরের সন্ধ্যানও মিলে শেখ ভানু শাহের আমলের ।

মাজারের পাশেই রয়েছে অতিথিশালা, বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে অতিথিদের জন্য । প্রতি বছর পৌষ মাসের ১৪ তারিখ ওরশ শরীফ ও মেলা অনুষ্টিত হয় এবং তাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাউল শিল্পী ও পর্যটকদের সমাবেশ ঘটে ।

অকেয়া হক জেবু
কবি, আইনজীবী ।