প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-৩১

  |  ১৪:১৯, জুলাই ০২, ২০২০
www.adarshabarta.com

প্রবাসীদের ভোটাধিকার কার্যক্রম ‘শুরু হয়েও হলো না শুরু’

:: মোঃ রহমত আলী ::

একসময় প্রবাসীদের বিদেশে অবস্থান করেও দেশের ভোটার তালিকায় নাম তালিকাভুক্তির সুযোগ ছিল। সে সময় যখন ভোটার তালিকায় নাম রেজিস্ট্রেশন করা হতো তখন দেশে থাকা তাদের আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে তারা নাম তালিকাভূক্তির সূযোগ পেতেন। এরপর তারা নির্বাচনের সময় দেশে থাকলে নিজ নিজ ভোট প্রদান সহ ভোটার সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করতে পারতেন। এরপর ১৯৮২ ও ১৯৮৪ সালে পর পর দু’টি সংশোধনীর মাধ্যমে সে ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হয়। আর এর পর থেকে বলা হয়, ভোটার তালিকায় নাম তুলতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রেজিষ্ট্রেশনের সময় সামনে উপস্থিত থাকতে হবে। আর এখন সেটা আরও ভিন্ন পর্যায়ে চলে গেছে। বলা হয়েছে, শুধু সামনে থাকলেই হবে না উপস্থিত সময় সরাসরি উপস্থিত থেকে সেই ব্যক্তির ছবি ও স্বাক্ষর প্রদান করতে হবে। আর এর ফলে কার্যত প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
এরই প্রেক্ষিতে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম এবং কূটনৈতিক তৎপরতার পর এ ব্যাপারে বর্তমান সরকার একটি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। যার ফলে দেশে অবস্থানরত লোকজনের মত বিদেশে বসেও প্রবাসীরা ভোটার তালিকায় তাদের নাম তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ লক্ষ্যে একটি পাইলট প্রকল্পের ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে কয়েকটি দেশের সাথে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের বর্তমান হাই কমশনার সাঈদা মুনা তাসনিম এর বিশেষ ভূমিকায় এ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় লন্ডন সহ যুক্তরাজ্যের অন্যান্য এলাকায় এ বছরের শুরুতে।

সে হিসাবে গত ১২ ফেব্রুয়ারী বুধবার সকাল ১১ টায় বাংলাদেশ হাই কমিশন লন্ডনে স্মার্ট কার্ড নিবন্ধনের কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধণ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। এ সময় ঢাকায় নির্বাচন কমিশন কার্যালয় থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ রেজিষ্ট্রেশন প্রক্রিয়ার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ হাইকমিশনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার পর সাথে সাথেই অনলাইনে প্রবাসীরা তালিকাভুক্ত হতে শুরু করেন।
এদিকে যুক্তরাজ্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রধান স্যার জন হোমস নির্বাচনে বাংলাদেশের ডিজিটালাইজড বায়ো-মেট্রিক ভোটার আইডি কার্ড এবং ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহারের প্রশংসা করেন। এটি উদ্বোধনের পর বাংলাদেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা সঙ্গে এক সাক্ষাৎকালে জন হোমস এই প্রশংসা করেন। এ সময় বৈঠকে যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডে বাংলাদেশের হাই কমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম বৈঠকে অংশ নেন।

সে যাই হউক, উদ্বোধনের পর আশা করা গিয়েছিল যে, প্রাথমিকভাবে এ কার্যক্রমে নানা জটিলতা থাকলেও পরবর্তীতে তা আরও সহজভাবে ভোটার হতে ইচ্ছুক প্রবাসীদের নাম তালিকাভুক্ত করা যাবে। কিন্তু প্রবাসীদের অতি প্রয়োজনীয় ও দীর্ঘ দিনের প্রতীক্ষিত এই সুযোগটি অঙ্কুরেই বাধাগ্রস্ত হলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া কভিড-১৯ এর কারণে। তবে এটা দেশের সার্বিক পরিস্থিতির একটি অংশ। চলমান পরিস্থিতিতে এমন কোনো বিষয় নেই যে, এর ফলে বাধাগ্রস্ত হয় নি। তাই মানুষকে এ অবস্থায় প্রতিক্ষার প্রহর গুনা ছাড়া আর কোন উপায় নাই।
তবে আমরা আশা করব এক সময় নিশ্চয়ই এ পরিস্থিতির অবসান হয়ে আবার স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হবে। তখন যেন প্রবাসীদের এ মৌলিক অধিকারের বিষয়টি জরুরী ভিত্তিতে আগের মত বিবেচনায় নেয়া হয়।

কার্ডের ব্যাপারে জানা যায়, অত্যাধূনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে তৈরী ও দেশে বিতরণকৃত কৃত এ স্মার্ট কার্ডে ব্যক্তির নাম (বাংলা ও ইংরেজি), পিতা/মাতার নাম, জন্মতারিখ ও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন নম্বর দৃশ্যমান রয়েছে। কার্ডের পেছনে আছে ব্যক্তির ভোটার এলাকার ঠিকানা, রক্তের গ্রুপ ও জন্মস্থান। তবে সব মিলিয়ে স্মার্ট কার্ডের মধ্যে থাকা চিপ বা তথ্যভান্ডারে ৩২ ধরনের তথ্য থাকবে, যা মেশিনে পাঠযোগ্য। প্লাস্টিকের (পলিমার দিয়ে) তৈরি কার্ডটি মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী। কার্ডের মেয়াদ ১০ বছর। পূর্বের প্লাস্টিকের কার্ডে নারীদের ক্ষেত্রে শুধু স্বামীর নাম দৃশ্যমান ছিল। পিতার নাম ছিল না। অপরদিকে পুরুষের কার্ডে স্ত্রীর নাম উল্লেখ ছিল না। একে বৈষম্যমূলক বলে বলা হচ্ছিল। তাই নারীদের স্মার্ট কার্ডে স্বামীর নামের পাশাপাশি পিতার নামও থাকবে।

কার্ডের তথ্যভান্ডারে ব্যক্তির পেশা, স্থায়ী ঠিকানা, বর্তমান ঠিকানা, বয়স, বৈবাহিক অবস্থা, জন্মনিবন্ধন নম্বর, লিঙ্গ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, দৃশ্যমান শনাক্তকরণ চিহ্ন, ধর্ম, ড্রাইভিং লাইসেন্স নম্বর, পাসপোর্ট নম্বর, আয়কর সনদ নম্বর, টেলিফোন ও মোবাইল নম্বর, মা-বাবা ও স্বামী বা স্ত্রীর পরিচয়পত্র নম্বর, মা-বাবা বা স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যুসংক্রান্ত তথ্য, অসমর্থ বা প্রতিবন্ধীর তথ্য ইত্যাদি রয়েছে। এছাড়া স্মার্ট কার্ডের ডিজাইনে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় পাখি দোয়েল, জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও চা-পাতা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন ও বর্তমান জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্মার্ট কার্ড দেওয়ার এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ২০১১ সাল থেকে যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। প্রথমে এ কার্ডটি হস্তান্তর করা হয় বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব আব্দুল হামিদকে।

এ স্মার্ট কার্ডে তিন স্থরে মোট ২৫টি নিরাপত্তা-বৈশিষ্ট্য সংযোজিত রয়েছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে, খালি চোখে দৃশ্যমান হবে, নিরাপত্তা-বৈশিষ্ট্যগুলো দেখার জন্য যন্ত্রের প্রয়োজন হবে এবং এটির নিরাপত্তা-বৈশিষ্ট্য দেখতে ল্যাবরেটরিতে ফরেনসিক টেস্টের প্রয়োজন হবে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির পরিচয়পত্রের তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে পারবে।
এ স্মাট কার্ড অন্ততঃ ২২ ধরনের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে। তার মধ্যে রয়েছে, আয়কর দাতা শনাক্তকরণ নম্বর পাওয়া, শেয়ার আবেদন ও বিও হিসাব খোলা, ড্রাইভিং লাইসেন্স করা ও নবায়ন, ট্রেড লাইসেন্স করা, পাসপোর্ট করা ও নবায়ন, যানবাহন রেজিস্ট্রেশন, চাকরির আবেদন, বিমা স্কিমে অংশগ্রহণ, স্থাবর সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়, বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রেশন, ব্যাংক হিসাব খোলা, নির্বাচনে ভোটার শনাক্তকরণ, ব্যাংকঋণ, গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের সংযোগ, সরকারি বিভিন্ন ভাতা উত্তোলন, টেলিফোন ও মোবাইলের সংযোগ, সরকারি ভূর্তকি, সাহায্য ও সহায়তা, ই-টিকেটিং, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, আসামি ও অপরাধী শনাক্তকরণ, বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর পাওয়া ও সিকিউরড ওয়েব লগে ইন করার ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর লাগবে।

পূর্বেই বলা হয়েছে প্রবাসীদের এ ভোটাধিকারের জন্য অনেককিছু করতে হয়েছে। তার মধ্যে আমার একটি প্রচেষ্ঠার কথা এখানে তুলে ধরছি। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ডঃ কামাল হোসেন জেনেভা কনভেনশনে যোগদান শেষে দেশে যাওয়ার পথে যুক্তরাজ্য গণফোরামের উদ্যোগে ইস্টলন্ডনের কবি নজরুল সেন্টারে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। এসময় সাপ্তাহিক সুরমা পত্রিকার তৎকালীন নিউজ এডিটর হিসাবে আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে এ ব্যাপারে ভোটাধিকার প্রাপ্তিতে তাঁর আইনগত সহযোগিতা কামনা করি। এসময় তিনি প্রবাসীদের কেউ পিটিশনার হলে এ মর্মে আদালতে রীট পিটিশন করবেন বলে আশ্বাস প্রদান করেন।
এরপর পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য গণফোরামের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান (বিশ্বনাথ-ওসমানী নগর আসনের) এমপি জনাব মোকাব্বির খানের বিশেষ তৎপরতায় ও আরেক গণফোরাম নেতা আলী রেজা খান ভোটাধিকার প্রাপ্তীর লক্ষ্যে রীট মামলা দায়ের করা হয়। এ রিট মামলায় প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রাপ্তির পক্ষে রায় হয়।
১৯৯৮ সালে এ রায় কার্যকরী করার লক্ষ্যে আবারও আদালতের স্মরণাপন্ন হতে হয় আর তার জন্য আবারো উদ্যোগি হন মোকাব্বির খান। তখন তা কার্যকরের জন্য আদালত কর্তৃক রায় ঘোষিত হয়।

তারপর দীর্ঘ দশ বছরেও প্রবাসীরে ভোটাধিকার প্রক্রিয়া শুরু না হলে ২০০৮ সালে তৎকালীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাাবধায়ক সরকারের আমলে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হলেও প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয় নাই।
একই সালে এটি এম শামসুল হুদা কমিশন প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে উদ্যোগী হন ও তৎকালীন দুইজন নির্বাচন কমিশনার যথাক্রমে জনাব সহুল হোসাইন ও এম শাখাওয়াত হোসেইন এ ব্যাপারে সম্ভাব্যতা যাচাই এর জন্য প্রায় দুই সপ্তাহ যুক্তরাজ্য সফর করেন। এরপরেও নানা জটিলতার অজুহাত দেখিয়ে তা আলোর মূখ দেখেনি।

২০১৪ সালেও তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে নিয়োজিত রকিব উদ্দিন কমিশনও উদ্যোগি হয়। কিন্তু সে সময় এ প্রক্রিয়া বেশীদূর এগুতে পারেনি। ২০১৭ সালে নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা কমিশন এ ব্যাপারে উদ্যোগি হয়ে বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়ামসহ নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করে সদিচ্ছার পরিচয় দেন।
এ প্রক্রিয়া চলাকালীন এক পর্যায়ে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসে। তখন সময় সল্পতার কারণে সে তালিকাভূক্তির কাজ স্থগিত রেখে শুধুমাত্র যারা দেশে গিয়ে ভোটার রেজিষ্ট্রেশন করেছেন তাদেরকে পোস্টাল ভোটার প্রদানের সূযোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

অবশেষে বর্তমান সরকার এ প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগি হয় এবং নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার সময়ে সেটি উদ্বোধন হয়। আর এ শুরুর পিছনে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম বিশেষ ভূমিকা রাখেন।(চলবে)।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com