প্রচ্ছদ

জীবন বড় বৈচিত্রময়, পর্ব-৭

  |  ১০:০১, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২০
www.adarshabarta.com

:: মিজানুর রহমান মিজান ::

এখানে বলতে হয় বা না বললে অশ্রদ্ধার, স্মরণের ক্ষেত্রে হয়ে যাবে কার্পণ্যতা।বলছিলাম পিয়ন কাম চৌকিদার তাহির আলীর কথা।তিনির প্রকৃত নাম খাতা-কলমে ব্যবহার হলেও ছাত্র শিক্ষকের নিকট পরিচিত ছিলেন “বেয়াই” নামে।উপনামটি ডেকে দিয়েছিল প্রকৃত নামকে তিনির সম্পূর্ণরুপে। অনেকেই প্রকৃত নাম হিসেবে উপনামটিকে গুরুত্ব দিতেন এবং জানতেন।বেয়াই’র আচার-আচরণ, কথা-বার্তা, ছিল সহজ সরল অতীব সাধারণ পর্যায়ভুক্ত।তিনির অন্তরে কোন দিন হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ-লালসা ছিল বলে প্রতীয়মান হয়নি কখনও। ছাত্র শিক্ষক সবার সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণতা বজায় রেখে চলার একটা দৃঢ় প্রত্যয় ছিল বহমান। স্কুলেই ছিল তিনির থাকার নির্ধারিত স্থান।নিজে রান্নাবান্নাসহ সকল কাজ একাই করতেন সমাধান।লেখাপড়া মোটেই ছিল না।নোটিশ বা অন্য কোন কাজ দেখিয়ে দিলে সমাধান করতেন অনুস্মরণ বা দেখানো পদ্ধতিনুসারে। আমার শিক্ষকতাকালীন সময়েও তিনি ছিলেন কর্মরত। ছিলেন তিনি নোয়া গাঁও গ্রামের অধিবাসী। দীর্ঘদিন হল তিনি হয়েছেন মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারের যাত্রী।আল্লাহ তিনিকে জান্নাতবাসী করুন এ মোর হৃদয়জ আর্তি।

প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে যে সকল শিক্ষকবৃন্দ ছিলেন তাঁদের মধ্যে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করেছেন যাঁরা তাঁদের নাম বলা অত্যাবশ্যক।মরহুম আখতার হোসেন,মরহুম আলতাফুর রহমান, রাধিকা রঞ্জন দাস, মরহুম নওরোজ আলী, মরহুম উকিল আলী, কমর উদ্দিন খান, মাওলানা মো: আব্দুল্লা, মরহুম কামাল উদ্দিন ও জামাল উদ্দিন প্রমুখ।স্কুলের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে শিক্ষকবৃন্দ অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টা রেখে ছিলেন অব্যাহত,শিক্ষার আলো বিতরণ, আলো ছড়াতে ধান সংগ্রহ অভিযান, বাঁশ সংগ্রহে গিয়ে অনেক সময় নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন পরিবহনার্থে। তাঁদের অবদান উত্তর বিশ্বনাথ স্কুল কি করে ভুলবে?তা কি সম্ভব!তাঁদের পাঠদান পদ্ধতি, আন্তরিকতা সহযোগিতার নিকট আমি কৃতজ্ঞ ও সশ্রদ্ধ চিত্তে স্বীকার করি এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে।যাঁরা আজো জীবিত আছেন তাঁদের দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি নিরন্তর এবং যাঁরা হয়েছেন প্রয়াত আল্লাহ তাঁদেরকে জান্নাতবাসী করুন সতত মোর প্রার্থনা। উত্তর বিশ্বনাথ স্কুলের সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আমি ছাত্র হিসেবে পঠিত থাকাবস্তায় শিক্ষক, অভিভাবক ও এলাকাবাসী সকলের একটি মন্তব্য ছিল, আমি যেন দ্রুত উচ্চ শিক্ষা লাভ করে শিক্ষক হিসেবে স্কুলে যোগ দেই এবং হয়েছিলও তাই।এ ব্যাপারে আমি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি এবং সশ্রদ্ধ চিত্তে তাদের আশ্বাস বাণীর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করি।

১৯৭৫ সালে উত্তর বিশ্বনাথ স্কুলের প্রথম ব্যাচ এস.এস.সি পরিক্ষায় অংশ গ্রহণ করে এবং তিনজন পরিক্ষার্থীর মধ্যে হয়েছিলেন দু’জন উত্তীর্ণ।প্রথম অংশ গ্রহণকারী ছাত্ররা ছিলেন বাবু সুজিত কুমার দাস লালার গাঁও, আব্দুল হক রহিম পুর ও আক্কাছ আলী দোহালিয়া নিবাসী। তাঁদের মধ্যে বাবু সুজিত কুমার দাস ও আব্দুল হক হয়েছিলেন উত্তীর্ণ। ১৯৭৬ সালে ছিল এস.এস.সিতে অংশ গ্রহণকারী দ্বিতীয় ব্যাচ।সে ব্যাচে ছিলেন বাবু সুব্রত মোহন কর চন্দ গ্রাম, সমর কুমার দাস ফুলচন্ডি, সায়েস্তা হোসেন মোহাম্মদ পুর, সিরাজ উদ্দিন গবিন্দ নগর, আলতাব আলী দ্বীপবন্ধ, আলফাজ উদ্দিন দোহালিয়া, মরহুম আব্দুল মালিক(বশির) তেলিকুনা গং প্রমুখ। তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র ছিলাম আমি। ১৯৭৭ সালে আমি অংশ গ্রহণ করি এস.এস.সি পরিক্ষায়।

প্রথম ব্যাচ থেকে তৃতীয় ব্যাচ পর্যন্ত পরিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রত্যেক ব্যাচে একজন করে প্রতি বৎসর দ্বিতীয় বিভাগে হয়েছেন উত্তীর্ণ। প্রথম ব্যাচে বাবু সুজিত কুমার দাস দ্বিতীয় বিভাগ, দ্বিতীয় ব্যাচে বাবু সুব্রত মোহন কর ও তৃতীয় ব্যাচে আমি দ্বিতীয় বিভাগে হই উত্তীর্ণ।প্রথম ব্যাচে তিনজন পরিক্ষায় অংশ গ্রহণ করে উত্তীর্ণ হন দুইজন, দ্বিতীয় ব্যাচে সাত জনে পাঁচ জন ও তৃতীয় ব্যাচে চৌদ্দজনে সাতজন উত্তীর্ণ হই। আলতাব আলী ও সিরাজ উদ্দিন আমার এক বৎসরের সিনিয়র হলেও শেষ পর্যন্ত উনারা হয়ে যান আমার ক্লাসমিট। অর্থ্যাৎ ১৯৭৭ সালে একই সাথে এস.এস.সি পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হই।এদিকে আকিল পুরের মর্তুজ আলী ও আখলাক হোসেন আমার সহপাঠি হলেও অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে ওরা চলে যায় উত্তর বিশ্বনাথ ছেড়ে গবিন্দগঞ্জ ও দৌলত পুর স্কুলে।

আমি বরাবর ক্লাসে প্রথম হবার পেছনে যে নিগুঢ় রহস্য ছিল বিদ্যমান তা আজকে প্রকাশ করতে চাই নি:শঙ্ক চিত্তে।আমার পড়ার সময় এবং পাঠ গ্রহণের পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হবার প্রচেষ্টা অনেকে গোপনে জানার চেষ্টা করেছেন।আমি সত্য ও সঠিক তথ্য প্রদানে কার্পণ্য বা মিথ্যর আশ্রয় না নিলেও অনেকে অবিশ্বাসের দোলায় দোলতে দেখেছি, অনুধাবিত হয়েছে। আমার লেখাপড়া যেন বিষ্ময়কর বা অলৌকিকতার স্পর্শ ছোয়া বস্তু বলে মনে হতো। যাহোক খোদার অপার মহিমা ও করুনাশ্রয়ে থেকে বলছি, যেখানে সত্যের বিন্দু মাত্র অপলাপ নেই। বরং পুরো সত্যের উপাদান সংমিশ্রিত। কোন দিন সকাল বিকাল পড়ায় বসিনি। এ সুযোগ ও আমার ভাগ্যে ছিল না।তাই বলে অযথা আড্ডা ইয়ার্কিতে ও সময় ব্যয় হতো না। একটা অবহেলাজনিত অভ্যাস কাজ করত বলে ধারণাবোধ ছিল আমার। এ সময় আমি যতই পড়ি না কেন বিন্দু পরিমাণ স্মরণ রাখা সম্ভব হতো না। কিন্তু রাত বারোটার পর যত দীর্ঘ প্রশ্ন হোক না কেন, আমি তিনবার পাঠ করলেই হুবহু মুখস্ত হয়ে যেত।এক্ষেত্রে আমি প্রশ্নটি পাঠ করে সর্বাত্মক চেষ্টা করতাম তার অন্তর্নিহিত বিষয় বস্তু উদঘাটন করতে। জিজ্ঞাসানুযায়ী প্রশ্নের উত্তর খুজে বের করে প্রথমবার পুরো বিষয়টি একবার ধীর স্থির ভাবে পড়ে নিতাম। অল্প বিরতি দিয়ে অন্তর্নিহিত মর্মার্থ উদ্ধার পূর্বক দ্রুত দু’বার পড়ে নিতাম। বস উত্তরটি আমার আয়ত্বাধীন।কখনও মধ্যখান থেকে অংশ বিশেষের বিচ্যুতি ঘটলে স্মৃতিপট হাতড়িয়ে সারমর্ম ঠিক রেখে নিজ থেকে তা সাজিয়ে লিখে নিতাম।সাথে ছিল আরেকটি বিষয় সম্পৃক্ত। যা অনেকের নিকট অবিশ্বাস্য বা ধারণা বহির্ভুত বিবেচিত হবার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া মুশকিল।আমি মুখে পান-সুপারি ও সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে পড়তে বসলে একবার পাঠেই তা হয়ে যেতো আত্মস্থ। এ পদ্ধতিতে আমার পুরো লেখাপড়ার জীবন ব্যয়িত এবং রাত কখনও ঘন্টা বা দু’ঘন্টার উপরে পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে পারিনি।আজকের সৃজনশীল পদ্ধতির বা ঠিক মার্কের চেয়ে দীর্ঘ উত্তর যুক্ত পর্ব ছিল বহাল।

স্কুলের আঙ্গিনায় শিক্ষকগণ গাছের চারা এনে রোপন করেন সবুজ বনায়ন কর্মসুচির অধীন। প্রত্যেক শিক্ষক ও ছাত্রের একেকটি করে চারা করেছিলেন রোপন এবং তার তালিকাও পৃথক রেজিস্টার খাতার মাধ্যমে ছিল স্কুলে রক্ষিত। কিন্তু আমরা স্কুলে থাকাকালীন সময়েই চুরি হয়ে যায়।স্কুলের উন্নয়নের নিমিত্তে প্রিয় শিক্ষকবৃন্দ ’৭৭ সালে সার্কাস প্রদর্শনী চালু করেন খাজাঞ্চি গাঁওয়ের দক্ষিণের মাঠে।তা থেকে উপার্জিত বা আয়কৃত টাকা স্কুলের উন্নয়নমুলক কাজে ব্যয়িত হয়। (চলবে)

লেখক: সাবেক সভাপতি বিশ্বনাথ প্রেসক্লাব, বিশ্বনাথ, সিলেট।