প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব- ৩০

  |  ১৫:৩৯, জুলাই ১১, ২০২০
www.adarshabarta.com

সমাজ সেবা ও দান খয়রাত করলে মানুষের আয়ু বাড়ে!

:: মো. রহমত আলী ::

প্রত্যেক মানুষই সুস্থ সবল থাকার জন্য এবং বিশেষ করে আয়ূ বাড়ানোর জন্য নানাবিধ প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকেন। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে কেউ ব্যায়াম করেন, কেউ পুষ্টিকর খাবারের সাথে তরতাজা ফলমূল খান আবার অনেকে ইউনানী-আয়ুর্বেদী বা এলোপেথিক ঔষধের উপর নির্ভর করেন। তবে অতি সম্প্রতি এর সাথে আরো একটি বিষয় যোগ করেছেন ইংল্যান্ডের এক গবেষক। তিনি বলেছেন, পরোপকারে মানুষের আয়ু বাড়ে। তিনি বলেছেন যে, যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে ক্ষুধার্তকে খাদ্য দেন, পীড়িতদের সেবা করেন তারা শারীরিক ও মানষিকভাবে খুবই উপকৃত হন। আত্মকেন্দ্রীক স্বভাবের বদলে পরোপকারে মানুষের আয়ু বাড়িয়ে দিতে পারে।
গবেষক এ প্রসঙ্গে আরো দাবী করেছেন যে, পরোপকার মানুষের বিষন্নতা থেকে মুক্তি দিয়ে জীবনের ভালো দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। মানুষের উপকার করলে মানসিক শান্তির পাশাপাশি সামাজিকতা ও বন্ধুত্ব বাড়ে। মূলত মানষিক প্রশান্তিই মানুষকে দীর্ঘজীবি হতে সাহায্য করে। তাই দীর্ঘজীবি হতে কে না চায়? অন্যান্যের বেলায় যা হউক, যুক্তরাজ্যে আমাদের কমিউনিটিতে এ গবেষকের মূল বক্তব্যের আলোকে বিশ্লেষন করলে এর অনেকটাই মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আর এগুলি হচ্ছে বিভিন্ন রকমের সমাজ সেবা ও দান খয়রাতের মাধ্যমে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এগুলি নিয়ে আমাদের কমিউনিটিতে যারা সংশ্লিষ্ট আছেন তাদের আয়ু প্রকৃতপক্ষে বাড়ছে না এ থেকে সৃষ্ট নানা জটিলতায় তাদের আয়ু কমছে।
দেশের কথা যেমন হোক, অন্তত বৃটেনে যারা বসবাস করছেন, তারা নিশ্চয়ই এ সমাজ সেবা ও দান খয়রাত সম্পর্কে ভালভাবেই অবগত আছেন। সমাজসেবামূলক সংগঠন, খয়রাতী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ অনেক মাধ্যম রয়েছে যার সাথে অসংখ্য মানুষ রাতদিন কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের সমাজ সেবার পরিধি দেশ-থেকে দেশান্তরে বিস্তৃত। সব সময় এ কাজেই নিয়োজিত থেকে নিজের পরিবার পরিজনের খোঁজখবর পর্যন্ত অনেক সময় নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তারা চান জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত এ সমস্ত কাজে নিয়োজিত থাকতে। মানুষের উপকার করতে।
পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে এ সমস্ত সমাজসেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া অনেক সহজ। এমন এক সময় ছিল যখন এ সমস্ত সমাজসেবামূলক কাজকর্ম করার জন্য ফান্ড রেইজিং করতে গিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো বা দীর্ঘ পথ পাড়ী দিতে হতো। এতে সময় ও মানসিক অবস্থার অনেক ব্যাঘাত সৃষ্টি হতো। কিন্তু আজকাল আর সে চিন্তা করতে হয় না। যুক্তরাজ্যে টেলিভিশন বা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের বদৌলতে তা খুবই সহজ হয়ে গেছে। মানুষের দান খয়রাতের পরিমানও অন্যান্য যে কোন সময়ের তুলনায় অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলা যায়। তা ছাড়া রেজিষ্টার্ট চ্যারিটি সংগঠনগুলো সরকারীভাবেও অনেক ফান্ড সংগ্রহ করে এ সমস্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, গৃহনির্মাণ, এতিম ও ছিন্নমূলল মানুষদের ক্ষেত্রেই এগুলি পরিচালিত হচ্ছে। কোথাও কোথাও এ সমস্ত কার্যক্রম এতই ব্যাপক যে, তা দেখে কল্পনাই করা যায় না যে এ গুলি খয়রাতি কাজ। শুধু ঈদে পর্বে বা বিশেষ কোন সময়ে নয়, বলতে গেলে সারা বছরই তার কার্যক্রম চলছে এবং হতদরিদ্র মানুষগুলো এ থেকে উপকৃত হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যে আমাদের কমিউনিটির লোকজন বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে এ সমস্ত কার্যক্রম চালানোর পরও ক্ষান্ত নন। তারা অনেক সময়ে নিজেদের লোকজনদের নিয়ে পারিবারিক ট্রাস্ট বা সংগঠন গড়ে তুলেছেন। এর মাধ্যমে তারা বড় ধরণের কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন না বটে তবে নিজেদের অন্যান্য গরীব আত্মীয় স্বজনসহ এলাকার গরীব লোকজন বা ধর্মীয়, শিক্ষা, সামাজিক বা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম সহযোগিতা করে থাকেন। সহায় সম্বলহীন লোকদের সন্তানদের বিয়েসাদী, বয়স্কদের দেখাশুনা যা হাতপাতালে চিকিৎসাদানে সহযোগিতা করেও অনেকে তা পরিচালিত করেন। সময়ের পরিক্রমায় হয়তো এগুলি দীর্ঘায়িত হয়না কিন্তু সমসাময়িক কালে তা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। পারিবারিক সংগঠনগুলো অনেক সময় যিনি তা শুরু করেন পরবর্তিতে তা হয়তো তার যোগ্য উত্তরসুরী না হলে বন্ধ হয়ে যায়। তাই এ ক্ষেত্রে যারা সচেতন তারা এর দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন ফলে তা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায় না। তবে এমনও হয়েছে যে, কোন চলমান প্রজেক্ট মূল উদ্যোক্তাদের অনুপস্থিতিতে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। অবশেষে তা বন্ধ হয়ে গিয়ে সমস্যার সৃস্টিরণ হয়ে হিতে বিপরিত হয়ে গেছে।
পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাই সেটি হল, কমিউনিটি সংগঠন, চ্যারিটি সংগঠন এমনকী পারিবারিক সংগঠনের পক্ষ থেকে এ সমস্ত দান-খয়রাত করে যে তৃপ্তি বা আনন্দ পাওয়া যায় তার চাইতে বোধ হয় নিজের পকেট থেকে সামান্য পরিমান সাহায্য করলেও অনেক বেশি তৃপ্তি পাওয়া যায়। একজনকে একবেলা খাবার দিয়ে, একজনকে একটি শীতের কাপড় দিয়ে অথবা কোন গরীব অসহায়কে পাঁচশত বা এক হাজার টাকা দান করে সাথে সাথে যে তৃপ্তি লাভ করা যায় তার অনূভূতিটাই আলাদা। একজন রিক্সাওয়ালা বা একজন দিনমজুরকে যদি তার প্রাপ্য থেকে একটু বেশী দেয়া যায় তবে বোধ হয় রাত্রে সে ব্যক্তি ঘুমের বেলায় যে প্রশান্তি পান তা অন্য কোনভাবে সম্ভব নয়। এভাবে পরোপকারের আরো অনেক তৃপ্তি রয়েছে যা বড় বড় দান-খয়রাতের চেয়েও দাতা ও গ্রহীতাদের মধ্যে অত্যন্ত নিগুড় সম্পর্ক সৃষ্টি করে দেয়। আর তা শুধু এক রাত্রি বা কিছুক্ষণের জন্য নয় পরবর্তী সারা জীবনের জন্য জাগরুক হয়ে থাকে। আর এর ফলে দাতা যে প্রশান্তি পান তা তার জীবনী শক্তিকে উজ্জীবিত করে দেয়। আর এটাই বোধ হয় সেই গবেষকের কথার মূলমন্ত্র। সুতরাং এভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানকে গুরুত্ব দিলে এর ফলাফল আরো সুদুর প্রসারী হতে পারে বলে ধারণা করা যায়।
পবিত্র ইসলামের দৃষ্টিতেও পরোপকার একটি মহৎ গুণ। এই গুণ সবার মধ্যে থাকে না। এটিকে ইসলাম ধর্মে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে। পরোপকার হচ্ছে অন্যের উপকার করা। এর মধ্যে ভাই, বোন, আত্বীয়,স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবাই অন্তর্ভুক্ত। মুমিনগণ পরষ্পরের ভাই ভাই। বিপদে আপদে চলাফেরায় একে অপরের উপকার করবে। অন্যের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে এটাই ঈমানের অপরিহার্য্য অঙ্গ। পরোপকার হলো আল্লাহর সাথে বান্দার এমন এক সম্পর্ক হয় যাতে কোন লোকসানের আশংকা নেই। পরোপকার দ্বারা সহজেই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (সঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মানুষের সঙ্গে সদয় ব্যবহার ও দয়া না করে, আল্লাহ তায়ালা ও তার সঙ্গে সদয় ব্যবহার এবং দয়া দেখাবেন না”। পরোপকার মূর্ত প্রতিভা ছিলেন মহানবী (সঃ)। মানুষের উপকার করতে পারলে তিনি আনন্দিত হতেন বেশি। অপরের দুঃখে তিনি দুঃখিত হতেন। কারো চোঁখে পানি দেখলে তিনি কেঁদে দিতেন। সাহাবীরা (রাঃ) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করলেন তখন মদিনার আনসারেরা তাদের অর্থ, সম্পদ, জায়গা, জমি, বাড়ী-ঘর সব ধরণের উপকরণ দ্বারা সাহায্য করে পরোপকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। মুসলমান মুসলমানের ভাই। কেউ কারো উপর জুলুম করতে পারবে না, কাউকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারবে না। যে ব্যক্তি ভাইয়ের অভাবে সাহায্য করবে আল্লাহ তায়ালা তার অভাবে সাহায্য করবেন। যে ব্যক্তি কারো দুঃখ, কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার বিপদগুলোর কোন একটি বিপদ দূর করে দিবেন।
তাই আসুন, আমরা কভিড-১৯ এর এই দুঃস্বময়ে সমস্যাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াই এবং সাহায্য করে নিজের আযূ বাড়াই। সাথে সাথে মহান আল্লাহতায়ালা যখন আমাদেরকে সে সূযোগ করে দিয়েছেন তখন এটাকে কাজে লাগাই। আমিন
(চলবে)।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com