প্রচ্ছদ

জীবন কথা, পর্ব-২৫

  |  ১৪:০৪, জুন ২৬, ২০২০
www.adarshabarta.com

রাশেদ সোহরাওয়ার্দীকে দেখে মনে হতো তিনি একজন ইংরেজ সাদা লোক

:: মোঃ রহমত আলী ::

রাশেদ সোহরাওয়ার্দীকে অনেকে না চিনলেও তাঁর পিতাকে অবশ্যই সবাই জানেন। তিনি হচ্ছেন, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এর সমন্বয়ে গঠিত ‘পাকিস্তান’ নামক রাষ্ট্রের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। নাম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সোহরাওয়ার্দী সম্পর্কে আমি ইতিহাসে অনেক পড়েছি ও বইয়ের পাতায় অনেক ছবি দেখেছি। কিন্তু তাঁর ছেলে রাশেদ সোহরাওয়ার্দীকে আমি লন্ডনে স্বচক্ষে কয়েকবার দেখেছি এবং তাঁর সাথে আমি সরাসরি ছবিও তুলেছি। তবে যে অনুষ্ঠানে আমার দেখা হয়েছিল সেখানে যদি আমি তাঁকে না দেখে অন্য কোথাও দেখতাম, তবে তাঁকে বাঙালি বলে মনে করতাম না। তাঁর চেহারার উজ্জ্বলতা, শারীরিক গঠন, আকার-আকৃতির সবকিছুই যেন ইংরেজদের হার মানার মত বিষয় বলে আমার মনে হয়েছে। তিনি পেশাগতভাবে ছিলেন ইংলিশ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির লোক। তাঁর অনেক ছবিও রয়েছে যেগুলোতে তিনি অভিনয় করেছেন, নয়তোবা পরিচালনা করেছেন।

তাঁর সাথে আমার প্রথম দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল লন্ডনের একটি অনুষ্ঠানে। দিন ছিল শনিবার, তারিখ ছিল ২৯ জুলাই ১৯৯৫। স্থান পূর্ব লন্ডনের টয়েনবি হল। অনুষ্ঠান ছিল তাঁর পিতার জীবনীভিত্তিক একটি বইয়ের প্রকাশনা নিয়ে। লেখক ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক যুক্তরাজ্য প্রবাসী বিশিষ্ট লেখক জনাব আব্দুল মতিন। সে অনুষ্ঠানে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর ইংরেজি বক্তৃতায় পিতার জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন ও তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যারা তাঁর পিতার সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাদের প্রসঙ্গও তুলে ধরেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সহ আরো অনেকে। সাথে সাথে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের কথা গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। অনুষ্ঠানে লেখক ছাড়াও অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, লেখক- সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী, ডক্টর মো. সেলিমসহ যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ।
যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাঁদের দুঃসময়ে অবস্থান করেছেন এবং কোনো কোনো সময় তাঁদের ছেলেমেয়েরাও এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। স্থায়িভাবেও অনেকে বসবাস করে আসছেন। এটা দীর্ঘ কাল থেকে চলে আসছে। রাশেদ মোশাররফ ছাড়াও আমার জানামতে এখানে মৌলানা ভাসানি, বাংলাদেশের অস্থায়ি রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে প্রয়াত সৈয়দ আশরাফ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর ছেলে ডক্টর মোহাম্মদ সেলিম এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা ও অনেকদিন এখানে বসবাস করেছেন। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা দেশে চলে গেলেও শেখ রেহানা স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন এবং বর্তমানে তাঁর মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক একজন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানও পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে অবস্থান করছেন। হয়তো আগামীতে খালেদা জিয়াও এখানে আসতে পারেন বসবাসের জন্য। শুধু তাই নয়, অনেকে চিকিৎসার জন্যও বিভিন্ন সময় এখানে এসে দীর্ঘদিন অবস্থান করে থাকেন।
সে যাই হউক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর পিতার মৃত্যুর পর যুক্তরাজ্যে চলে আসেন ও এখানে স্থায়িভাবে বসবাস করতে থাকেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রথম স্ত্রী নিয়াজ ফাতেমা ১৯২২ সালে ইন্তেকাল করেন। তাঁর এক পুত্র ও এক কন্যা আকতার জাহান ও শাহাব সোহরাওয়ার্দী। শাহাব সোহরাওয়ার্দী ছাত্র থাকাকালে ১৯৪০ সালে লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর সোহরাওয়ার্দী রাশিয়ান অভিনেত্রী ভেরা অ্যালেক্সান ড্রভনা টিসেস্কোকে বিয়ে করেন। ১৯৪৬ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে ভেরা শিশুপুত্র রাশেদকে নিয়ে লন্ডনে বসবাস শুরু করেন। এরপর ভেরা অ্যালেক্সান ড্রভনা টিসেস্কো ১৯৮৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বড় ভাই শাহেদ সোহরাওয়ার্দী মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। তিনি মস্কো থিয়েটারে কাজ করতেন। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার বিপ্ল¬বের সময় শাহেদ সোহরাওয়ার্দী ও ভেরা উদ্বাস্তুুদের সঙ্গে মস্কো ত্যাগ করেন। ১৯৩০ সালে তারা ভারতে চলে যান। ভেরা কলকাতায় বাস করতেন।
অন্য দিকে ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পাকিস্তানের এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করেন। পিতার মুক্তির জন্য ১৯৬২ সালের আগস্ট মাসে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী এবং সোহরাওয়ার্দীর কন্যা আকতার জাহান আইয়ুব খানের সিনিয়র মন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে করাচিতে তার বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। তারা বিনা শর্তে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তি দাবি করেন। ৬ মাস কারাভোগের পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুক্তি লাভ করেন। এ সময় রাশেদ সোহরাওয়ার্দী লন্ডনে স্কুলের ছাত্র ছিলেন।
লেখাপড়ার ক্ষেত্রে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী চার্টার হাউস অক্সফোর্ড এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রয়েল একাডেমি অব ড্রামাটিক আর্ট থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে অভিনয় পেশায় যোগ দেন। তিনি রয়েল শেক্সপিয়র কোম্পানিতে কয়েক বছর ছিলেন।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ইচ্ছা ছিল পুত্র আইনে ডিগ্রি নিয়ে রাজনীতিতে যোগ দেবেন। পিতার বাসনা পূরণ হয়নি। রাশেদ সোহরাওয়ার্দী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতা হয়েছেন। তিনি ১৯৬৩ সালে ডক্টর হু, ১৯৯৮ সালে জিন্নাহ, ২০১৫ সালে লিজেন্ড চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন। জিন্নাহ চলচ্চিত্রে তিনি নেহরুর ভূমিকায় অপূর্ব অভিনয় করেন। তিনি একজন বিশ্বখ্যাত লেখকও বটে। লেখক হিসেবে তিনি রবার্ট অ্যাশবি নামে পরিচিত।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জন্ম ১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বৈরুত গমন করেন। তারপর লন্ডনে হ্যাম্প স্ট্রিট গার্ডেনে পুত্রের সঙ্গে ৬ মাস বসবাস করেন। এ সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ স্মৃতিকথা লেখেন। রাশেদ সোহরাওয়ার্দীর উদ্যোগে ১৯৮৭ সালে স্মৃততিকথা গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বৈরুতে একটি হোটেলে মৃত্যুবরণ করেন। এ মৃত্যুর খবরে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী বৈরুত গমন করেন। তিনি ৮ ডিসেম্বর পিতার লাশ নিয়ে ঢাকায় যান। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে রেসকোর্স ময়দানে জানাজার পর হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়। এ সময় রাশেদ সোহরাওয়ার্দী লন্ডনে স্নাতক শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। ছাত্রজীবনে তিনি পিতার গ্রেফতার, মুক্তি আন্দোলন দেখেছেন এবং পিতার লাশ বহন করেছেন।
তিনি বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন ৬ দফা ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণার পর শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। আওয়ামী লীগের এ সংকটকালে দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া লন্ডন থেকে রাশেদ সোহরাওয়ার্দীকে ঢাকায় নিয়ে যান। পল্টন ময়দানে ৬ দফা ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের আসনটি শূন্য রেখে সভা চলছিল। প্রধান অতিথি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পুত্র রাশেদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি ৬ দফা বাস্তবায়ন ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের মুক্তি দাবি করেন। তার ভাষণ ৬ দফা আন্দোলনকে বেগবান করে।
১৯৯৯ সালের ৬-১৪ জুলাই যুক্তরাজ্য সফরের সময় তৎকালীন বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন। ৯ জুলাই যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের উদ্যোগে লন্ডনের টয়েনবি হলে বক্তৃতা-৯৮ অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ছিলেন, শেখ হাসিনা, আলোচক ছিলেন রাশেদ সোহরাওয়ার্দী। ভাষণের এক পর্যায়ে লন্ডন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা রাশেদ সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন, I consider Sheikh Hasina & Sheikh Rehana as my own sisters. I request her, to remaining Prime Minister as long as she lives.. তার এ ভাষণ সত্যিই প্রমাণিত। শেখ হাসিনা রাজনীতিতে আছেন এবং চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। সে অনুষ্ঠানে একজন সাংবাদিক হিসাবে আমিও উপস্থিত ছিলাম। আমি তখন প্রবাসীদের ভোটাধিার সম্পর্কে একটি প্রশ্নও করেছিলাম।
রাশেদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টির জন্য নেতৃত্ব দেন। পিতার মতো তার মেধা ও দক্ষতাও ছিল। রাশেদ সোহরাওয়ার্দি ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। (চলবে)।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com