প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-১৪

  |  ১৫:৪০, জুন ১৫, ২০২০
www.adarshabarta.com

রাজনৈতিক নেতাদের অমূল্য বচন

:: মোঃ রহমত আলী ::

রাজনীতিতে যিনি যতবেশী বাকপটুতায় পারদর্শী তিনি ততবেশী সফলতা অর্জন করে থাকেন। যা বিভিন্ন সময় প্রমানিত হয়েছে। আর বাস্তবে বাকপটু না হয়েও উপায় নেই। কারণ দেশের চলমান পরিস্থিতি সব সময়তো আর অনুকুল থাকে না। তাই বৈরী পরিবেশেও দেশের ও নিজের মান ইজ্জত বজায় রাখার খাতিরে বাস্তবতা এড়িয়ে ভিন্নভাবে নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। আর তা অনেকটা জেনে শুনেই। তবে ক্ষমতাহীন হলে যাই হোক, যদি ক্ষমতসীন থেকে কোন অপ্রিয় সত্য কথা ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা মূখ ফঁসকে কেউ বলে ফেলেন তবে তার জন্য সমালোচনার পাত্র হতে হয় তাকে। যা সাম্প্রতিক সময়ে অনেকের হয়েছে। তাই নীচে কয়েকজন সতর্ক রাজনীতিকের কিছু ঘটনা উল্লেখ করা হলো, “রাজনৈতিক নেতাদের অমূল্য বচন” হিসাবে।

জেগে থাকবেন বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী

বৃটেনের ১৯৯৭ সালের সাধারণ নির্বাচন ১মে শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনের শেষ পর্যায়ের কথা। একদিকে দীর্ঘ ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা লেবার পার্টির ক্ষমতায় আসার তীব্র লড়াই অন্যদিকে কনজারভেটিব ক্ষমতায় টিকে থাকার মরিয়া প্রচেষ্টা। অন্যান্য দলগুলিরও অস্তি¡ত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। এরই মধ্যে সে সময় জনমত জরিপেও প্রধান দুই দলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতার পুর্বাবাস দেয়া হচ্ছিল। তাই সব মিলিয়ে সে নির্বাচন নিয়ে দারুণ উত্তেজনা ছিল সবার মধ্যে। এমতাবস্থায় দলগুলির নেতাকর্মীদের প্রচারণা ছিল বিরামহীন। পার্টির নেতারাও জনগণকে তাদের পক্ষে ধরে রাখার শেষ প্রচেষ্টা হিসাবে নানা বাকযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় ২৯ এপ্রিল ১৯৯৭ সালের মঙ্গলবার উভয়দলের নেতাদের দু’টি মন্তব্য ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি‘ হয়ে যায়।

লেবার পার্টির নেতা টনি ব্লেয়ার কনজারভেটিভ দলের নেতা ও ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রী জন মেজরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘নির্বাচনের পরদিন সকালে আমি আপনাকে টেলিফোন করে যখন ঘুম থেকে জাগাবো তখন আপনি দেখতে পাবেন বৃটেনে একটি নতুন সরকার অর্থাৎ লেবার পার্টির সরকার ক্ষমতায় এসে গেছে। এর উত্তরে জন মেজর বলেন, “টেলিফোন করতে পারেন, তবে আমি তো রাত্রে ঘুমাবো না, তাই ঘুম থেকে জেগে উঠার প্রশ্নই আসেনা। আমি জেগেই থাকবো এবং ক্ষমতায় আছি এবং আগামীতেও থাকবো। এতে কোন সন্দেহ নাই।

অবশ্য শেষ পর্যন্ত জন মেজর জেগে থেকেও ক্ষমতা পাহারা দিয়ে রাখতে পারেননি। তাঁকে বিদায় নিতে হয়। তাই ক্ষমতা এমন একটি ব্যাপার যা খুবই ক্ষনস্থায়ি এবং এটাকে অনেকটা জোয়ার-ভাটার সাথে তুলনা করা যায়। তাইতো বাংলাদেশের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী কাজি জাফর আহমদ ক্ষমতা ছাড়ার পর ক্ষমতাসীন অন্য পক্ষকে উদ্ধেশ্য করে বলেছিলেন, “ক্ষমতার জোয়ার দেখেছো-ভাটার টান দেখ নাই”।

মহিলা ছাড়া মধুচন্দ্রিমা হয় না

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তার দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পর ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ মধ্যবর্তী সময় জনতা দলের নেতৃত্বে জাতীয় ফ্রন্ট নামক এলায়েন্স ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজি দেশাই। তখন অনেকের ধারণা ছিল এ ফ্রন্ট বেশীদিন ঠিকবে না। এমতাবস্থায় নির্বাচনের কিছুদিন পর যুক্তরাজ্য সফরে আসেন দেশাই। তখন এক মহিলা সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করে বসেন, জাতীয় ফ্রন্টের সাথে তাদের দলের হানিমুন (মধুচন্দ্রিমা) কতদিন ঠিকবে। দেশাই তখন পাল্টা প্রশ্ন জুড়ে দেন এই বলে যে, “হানিমুন হতে হলে তো পুরুষের সাথে মহিলার দরকার হয়। কিন্তু আমাদের এখানেতো সবাই পুরুষ। তাই এ প্রশ্ন অবান্তর। তবে তুমি (প্রশ্নকর্তা সাংবাদিক মহিলা) যদি রাজি থাকো তবে না হয় একটা হানিমুনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে”। তখন আর কোন উত্তর মিলেনি। তাই একজন সাংবাদিক হিসাবে অন্য সাংবাদিকদের কাছে আমার পরামর্শ থাকবে, স্থান, কাল, পাত্রভেদে প্রশ্ন করা উচিৎ। নিজের জন্য বিব্রতকর প্রশ্ন না করাই ভাল।

গো-মূত্রের ঔষধি গুনাবলী

প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই নানা রোগ নিরাময়ের জন্য নাকি নিয়মিত গরুর মূত্র পান করতেন। সাথে সাথে অন্যকেও তা পান করার পরামর্শ দিতেন। তার মতে গরুর মূত্রের ঔষধি গুণাবলি, বিশেষ করে ক্যান্সার রোধে এর কার্যকারিতা খুবই বেশী। তাই তার দেশের অনেকে সকাল-বিকাল গোমূত্র পান করে থাকেন। এমন কি বৃটেনের এক এলাকায় নাকি ভারত থেকে গোমূত্র আমদানি করে এখানে বিক্রি করা হয়ে থাকে। অনেকের মত আমার কাছেও বিষয়টি খুবই বিচিত্র মনে হয়। তাই এটা শুনার পর আমার স্মৃতিতে এটা ভেসে উঠে মাঝে মধ্যে।

আশি ভাগ ছাড়া সবাই শিক্ষিত

পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান এক সময় এউনেস্কুর একটি সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। এ সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে জনগনের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে থাকে। সে সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের শিক্ষার হার নিয়ে সংশ্লিস্ট দেশের সরকার প্রধানগন বক্তব্য রাখছিলেন। এমতাবস্থায় উন্নত দেশের শিক্ষার হার শতকরা সত্তর, আশি এমন কি নব্বই বলে উল্লেখ করা হচ্ছিল। কিন্তু সে সময় পাকিস্তানে শিক্ষার হার ছিল মাত্র বিশ থেকে পঁিচশ ভাগ। তাই আইয়ুব খান এ সংখ্যাটি উল্লেখ করতে অনেকটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। তখন তিনি একটু চালাকির আশ্রয় নেন। তিনি অন্যান্যদের শতকরা সংখ্যার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বলেন, আমার দেশের “Every one is educated except 80 percent” অর্থাৎ শতকরা আশিভাগ ছাড়া আর সবাই শিক্ষিত। এ ভাবেই তিনি তখন তার ইজ্জত রক্ষা করেন। আমরাও তখন পাকিস্তানের নাগরিক হিসাবে তার বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রীত হয়েছিলাম।

জাতির পিতা শালা হয়ে যাবেন তাই

পাকিস্তাানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর তার বড় বোন হচ্ছেন মিস ফাতেমা জিন্নাহ। কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সমগ্র পাকিস্তানের জাতির পিতা হিসাবে তার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে বোন ফাতেমা জিন্নাহ খুবই তৎপর ছিলেন। আর তার অংশ হিসেবে তিনি নিজের জীবনে দ্বিতীয় কাউকে গ্রহণ করেননি। অর্থাৎ তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি। এর কারণ হলো তিনি যদি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তখন তার ছোট ভাই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে তার স্বামী ‘শালা’ হিসেবে সম্বোধন করবেন। যা জিন্নার জন্য একটি বিব্রতকর অধ্যায় হিসাবে বিবেচিত হবে। ছোট ভাইকে এটা থেকে রক্ষা করতে তিনি সারা জীবনই বিবাহ ছাড়া একাকী জীবন কাটিয়েছেন বলে জানা যায়।

মুহম্মদ আলী জিন্নাহ এবং ফাতেমা জিন্নাহ, পাকিস্তানের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। জিন্নাহকে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং তিনি স্বাধীনতার পরে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অন্যদিকে ফাতেমা জিন্নাহ পাকিস্তান আন্দোলনের সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং পাকিস্তানের ‘প্রতিষ্ঠাতা জননী’ হিসাবে অভিহিত হয়েছিলেন। উভয়ে তাদের মৃত্যুর পর থেকেও পাকিস্তানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্মানিত ব্যক্তিত্ব হিসাবে মর্যদা পেয়ে যাচ্ছেন।

আড়াইশত বেশী না বারো কোটি বেশী

আলহাজ্ব হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতাসীন থাকাকালীন ও পরবর্তিতে বিভিন্ন সময় বৃটেন সফর করেছেন। শুনেছি একবার ক্ষমতাসীন থাকাকালীন তিনি যখন যুক্তরাজ্য সফরে আসেন তখন কিছু লোক তার বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে তাঁর পদত্যাগ দাবী করে। এক ইংরেজ সাংবাদিক এ সময় তাঁকে প্রশ্ন করে বসে যে, এ লোকগুলি তোমার পদত্যাগ দাবী করছে তাই তুমি গদি ছাড়ছো না কেন? এরশাদ তখন সেই সাংবাদিককে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন যে, এখানে কত লোক আছে? বড়জোর দুই-আড়াইশত হবে। কিন্তু আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ কোটি। (সে সময়ের হিসাবে) যারা তাঁকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। তাই তিনি কাদের কথা রাখবেন।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com