প্রচ্ছদ

ওসমান সরওয়ার আলম চৌধূরী: একজন কিংবদন্তির বর্ণাঢ্য জীবন

  |  ১০:৫৬, আগস্ট ২৯, ২০২০
www.adarshabarta.com

:: তানজিলা সারওয়ার আলম চৌধূরী ::

রামু,কক্সবাজার ,১৯৬৯ সালের শেষের দিকে বা ১৯৭০ সালের প্রথমার্ধে। স্থান:রামুর রাবার বাগান রেষ্টহাউজ। সামনে বাঙালী জাতির বহুল প্রত্যাশিত নির্বাচন। কক্সবাজারের জনসভা শেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কিছুক্ষণ যাত্রাবিরতি।সাথে আছেন তৎকালীন কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের সদ্য প্রতিষ্ঠিত আওয়ামীলীগের সব ডাক সাইটে নেতারা। পাইপ হাতে একটি চেয়ারে বসে আছেন বঙ্গবন্ধু! সামান্য চিন্তিত দেখাচ্ছে তাঁকে! চারিদিক উচ্চস্বরে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছে নেতারা।এমন সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ কক্সবাজার,উখিয়া,টেকনাফ (তখন একটি আসন ছিল) থেকে আওয়ামীলীগের নমিনেশন পাওয়া বত্রিশ বছরের সুদর্শন তরুন ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী দুইজন আনসার কমান্ডার সহ মোট পাঁচজনকে নিয়ে প্রবেশ করলে মুহূর্তে দৃশ্যপট পাল্টে যায়! বঙ্গবন্ধু, ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী এবং তাঁর সাথে আগত পাঁচজনকে সাথে নিয়ে ভেতরের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। বদ্ধ রুমে সবার মাথার উপর হাত রেখে বলেন, “নির্বাচনে জিতি বা না জিতি, স্বাধীনতার জন্যে তোমাদের প্রস্তুতি অব্যাহত রাখতে হবে। ওসমান তোমাদের সাথে আমার পক্ষে কাজ করে যাবে।” এই ঐতিহাসিক বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে এটি অবশ্যই দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অংশ ছিলো।পাঁচজনের মধ্যে একজন ছিলেন আমার চাচা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা রামু, রাজাকুলের সাবেক আনসার কমান্ডার জনাব আব্দুল হক সিকদার, যিনি এখনো জীবিত।সাংবাদিক ও ঐতিহাসিক বা ইতিহাসের ছাত্রদের তথ্যসূত্র কালেকশনের জন্য খূবই দরকারী নয় কি? তাছাড়াও কক্সবাজারের ইতিহাসের ছাত্রগন কিংবা জাতীয় যাদুঘরের সাথে সংশিষ্ট সকলেই বিষয়টিকে আমলে নিয়ে যতদ্রুত সম্ভব জীবিত আবদুল হক সিকদারের জবানবন্দী রেকর্ড করে নিলে আগামী জমানার সন্তানগনের বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা আন্দোলনের লক্ষ্যে পরিচালিত এসব গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো জানা আবশ্যক নয় কি?

যাহোকপরবর্তীতে নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয় ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী তথা আওয়ামীলীগ। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে ভাষণের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। এ সময় ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী কক্সবাজার জেলার অন্যতম ও রামু সংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহন করেন।মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়মাস এই পাঁচজন দূর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত প্রত্যেকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেন তিনি! ২৬শে মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ঐতিহাসিক অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলার প্রধান আসামী ছিলেন ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী! সবার দেখার সুবিধার্থে সেই মামলার এফ আই আর কপির লিংক নিচে দেওয়া হল।

এই হলো আমার কিংবদন্তি পিতা জনাব ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী।আজ আমার বাবা সাবেক সাংসদ ও সাবেক রাষ্ট্রদূত জনাব ওসমান সরওয়ার চৌধুরীর ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী! তিনি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলেও তাঁর আসল পরিচয় তিনি কক্সবাজার জেলার শ্রেষ্ঠ সমাজসেবক।বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে ছিল তাঁর অপরিসীম অবদান।পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ৫১টি প্রাইমারী স্কুল, ৭টি হাই স্কুল, ৩টি কলেজ, ২টি মন্দির ও ১৩টি মাদ্রাসা স্থাপন করে গেছেন।এছাড়াও তিনি টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০টির ও অধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে গেছেন। একজন মানুষ এতগুলো প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা!!! সত্যিই বিরল!!!

যদিও তিনি একটি রাজনৈতিক দলের নিবেদিত সাংসদ ছিলেন, কিন্তু তাঁর মাঝে কোন রকম বিরোধী পক্ষের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ছিল না। অত্যন্ত পরোপকারী,নির্ভীক,সৎ, নিরহংকারী,বিনয়ী মানুষটির মাঝে কোন ধনী দরিদ্র, উঁচু নিচু জাতভেদ কিংবা মানসিক দৈন্যতা ছিল না। সকল ধর্মের মানুষকে তিনি একই চোখে দেখতেন।

সামাজিক কর্মকান্ডে তিনি ছিলেন সবার আগে।প্রাকৃতিক দূর্যোগে তিনি সবার আগে ত্রান নিয়ে হাজির হতেন।কারো ঘর আগুনে দগ্ধ হলে,কোথাও রাস্তা ভেঙ্গে গেলে,কেউ বিপদে পড়লে এককথায় সব ক্ষেত্রে তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।ধর্মপ্রান সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম হলেও তিনি ধর্মান্ধ ছিলেন না।ভারতে বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা হলে তার প্রতিশোধ নিতে কক্সবাজার জেলার কিছু এলাকায় হিন্দুদের কিছু ঘরবাডি আর মন্দির পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।কিন্তু তিনি অন্যান্য সবাইকে সাথে নিয়ে হিন্দুদের দুটি মন্দির আর ঘরবাডি পুন:নির্মান করে দিয়েছিলেন।

স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ও তাঁর অবদান ছিল অসামান্য! রামু, উখিয়া ও টেকনাফ থানার বেশির ভাগ স্বাস্হ্য কমপ্লেক্স গুলো তাঁরই উদ্যোগে নির্মিত হয়।তাঁর লেখার হাতও ছিল অসাধারণ! তাঁর লেখা ‘জীবন থেকে নেওয়া’ প্রবন্ধটির পাঁচ হাজার কপি ছাত্রছাত্রী দের মাঝে বিতরণ করা হয়েছিল।যদিও তাঁর কোন স্থাপত্য শিল্পের উপর লেখা পড়া ছিল না, কিন্তু তাঁর নক্সায় তৈরী হয়েছে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মসজিদ।যা আজো অনেকের দৃষ্টি কাড়ে।

তিনি ছিলেন নিবেদিত একজন ক্রীড়ামোদী ও ক্রীডা সংগঠক।তিনি কক্সবাজার জেলায় ফুটবল, হাডুডু, বলিখেলা, নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন ভাল ব্যাডমিন্টন খেলতেন।এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬১ সালে কেরাম প্রতিযোগিতায় রাণার্স আপ হয়েছিলেন।

রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ব্যতিত তাঁর আরেকটি পরিচয় ছিলো।তিনি কক্সবাজার জেলার অন্যতম সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব! তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার,নাট্যকার, অভিনেতা, আবৃত্তিকার! তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘রামু দূর্বার শিল্পীগোষ্ঠী’ সংগঠনের মাধ্যমে তিনি নিজে গান, নাটক লিখে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ,ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মন্চস্থ করেছিলেন।এমন কি তাঁর লেখা গীতিনৃত্যনাট্য ‘ দূর্জয় বাংলা’ ঢাকায় ‘লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন’ অনুষ্ঠানে মন্চস্থ হয়েছিল।সেই নাটকে তিনি সহ আমরা সব ভাইবোন অভিনয় করেছিলাম।ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন দুর্দান্ত আবৃত্তিকার! একজন মানুষের মাঝে এত গুণের সমাহার সত্যিই অসাধারণ।

আমার বাবা-আমার গর্ব।তিনি ২০১০ সালের ২৭শে আগষ্ট, ১৬ই রমজান,শুক্রবার ভোরে আমাদের সকলকে শোকসাগরে ভাসিয়ে তিনি না ফেরার দেশে গমন করেন।আমার বাবার জন্য সকলের দোয়া কামনা করি।

লেখক: বোষ্টন, ম্যাসাচুচেটস ইউএসএ বসবাস করেন।