প্রচ্ছদ

আব্দুল হক হাবিব ভাইয়ের জানাজা-দাফন : সে এক অন্যরকম অনুভূতি

  |  ২২:০৩, জুলাই ২৯, ২০২৪
www.adarshabarta.com

Manual6 Ad Code

তাইসির মাহমুদ:

Manual4 Ad Code

গার্ডেন অব পিস গোরস্থানে শেষ বিদায় জানালাম প্রিয় হাবিব ভাইকে। ইতিপুর্বে যে ক’দিন কারো দাফনে গিয়েছি, দিনগুলোতে ছিলো গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। আবহাওয়া ছিলো প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। বেশিক্ষন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভবই ছিলোনা। দ্রুত দাফন-কাফন শেষ করে কবরস্থান ত্যাগ করতে হয়েছে।

কিন্তু আজকের দিনের অনুভূতি ছিলো সম্পুর্ণ ভিন্ন। দিনটি ছিলো রৌদ্রোজ্জ্বল। আবহাওয়া ছিলো নাতিশীতোষ্ণ। তাই দীর্ঘক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে দাফন-কাফনে অংশগ্রহণ করলাম। মনের মধ্যে খুব ভালো একটি অনুভূতি নিয়ে ফিরলাম। জানাজা দাফনে এতো মানুষ এসেছেন। সকলের মুখে কথা একটিই- “একজন ভালো মানুষকে হারালাম’। এমন মানুষ কমিউনিটিতে বিরল। বিনয়ী, অমায়িক আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক ছিলেন আব্দুল হক হাবিব।”

জানাজা ও দাফনে প্রায় অর্ধদিন অতিবাহিত হলেও যেন কারো বাড়ি ফেরার তাড়া ছিলো না। আব্দুল হক হাবিব যেন মৃত্যূর পরও মানুষকে ভালোবাসায় আগলে রেখেছিলেন।

এর আগে জোহরের জামাত শেষে ইস্ট লন্ডন মসজিদে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার আগে সকাল ১১টা থেকে পৌনে ১টা পর্যন্ত আব্দুল হক হাবিবের লাশবাহী কফিন রাখা হয় ইস্ট লন্ডন মসজিদের বেইসমেমেন্ট। তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে ছুটে এসেছিলেন কমিউনিটির বিভিন্নস্তরের মানুষ।

কফিনে শুয়ে থাকা চিরচেনা হাবিব ভাইর নির্বাক নিস্প্রাণ মুখখানি দেখে মনে হলো, একজন মানুষ যেন পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন। চেহারায় ঔজ্জ্বল্য। মনে হলো একজন জান্নাতি মানুষের প্রতিচ্ছবি দেখছি।

Manual4 Ad Code

জানাজা পড়ালেন শরীয়াহ কাউন্সিল ইউকের চেয়ারম্যান মাওলানা হাফিজ আবু সাঈদ। নামাজ শেষে মারিয়াম সেন্টারের সামনে বেরিয়ে দেখি তাঁর কফিন ঘিরে শতশত মানুষ। কমিউনিটির বিভিন্ন শ্রেনীপেশার মানুষ ছুটে এসেছেন। প্রত্যেকের মুখেই একই আক্ষেপ। “আব্দুল হক হাবিব এত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। সাথে নিজেদের মৃত্যূকেও স্মরণ। আর ক’দিন বাঁচবো।”

আসলে জানাজা ও দাফনে অংশগ্রহণ না করলে বুঝতে পারতামনা, হাবিব ভাই এতো জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি এভাবে মানুষকে ভালোবাসায় মুগ্ধ করেছিলেন।

Manual6 Ad Code

হাবিব ভাইর সাথে পরিচয় প্রায় দুই দশকের। যুক্তরাজ্যে আসার পর থেকেই। চ্যারিটি সংস্থা ‘ইক্বরা ইন্টান্যাশনাল’ এর চেয়ারম্যান ছিলেন। ছিলেন লন্ডন ট্রেনিং সেন্টারের ডাইরেক্টর। সম্ভবত ২০১০ সালে সিলেটে ক্যান্সার আক্রান্ত একজন যুবকের চিকিৎসা সহায়তার জন্য ফান্ডরেইজ করতে গিয়ে তাঁর সাথে ঘনিষ্টতা। ইক্বরা ইন্টারন্যাশনাল ও চ্যানেল এস-এর মাধ্যমে প্রায় ১০ হাজার পাউন্ড ফাউন্ডরেইজ করে দিতে পেরেছিলাম।

Manual5 Ad Code

দীর্ঘ চলার পথে তাঁকে কোনোদিন অপ্রয়োজনীয় বাক্য বলতে শুনিনি। বলার চেয়ে শুনতেন বেশি। উত্তর দিতেন মেপে-ঝোঁকে। ভালো কাজে কখনো ‘না’ বলতে পারতেন না। কোনো একটি বিষয় তাঁর পছন্দ নয়, কিন্তু ‘না’ বললে কেউ অখুশি হবে- এমন বিষয়গুলো কৌশলে এড়িয়ে যেতেন। যেকোনো চ্যারিটি কাজে সহযোগিতার চেষ্টা করতেন।

গত বছরের শেষের দিকে কমিউনিটিতে তাঁর অনুপস্থিতি উপলব্ধি করি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, তিনি দূরারোগ্য এমএনডি (মটর নিউরন ডিজিজ) রোগে আক্রান্ত। বাঁচার সম্ভাবনা নেই। একদিন সহকর্মী সাংবাদিক তারেক চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর নিউহ্যামের বাসায় দেখতে যাই। এটাই ছিলো তাঁর সাথে ফেস-টু-ফেস শেষ সাক্ষাৎ।

ঘন্টা খানেক তিনি ও তাঁর পরিবারের সাথে কাটাই। তিনি তখন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। ইশারা ইংগিতেই আমাদের সাথে কথা বললেন। ফেরার সময় বলেছিলেন, আমাদের সঙ্গ পেয়ে তাঁর খুব ভালো লেগেছে এবং তিনি কৃতজ্ঞ।

তিনি মৃত্যূ পথযাত্রী সেটা জানতাম। যে কোনো সময় মৃত্যূ সংবাদ আসবে-তাও জানতাম। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি ডাক পড়বে ভাবিনি। কারণ বিশ্বখ্যাত বৃটিশ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এমএনডি নিয়েই বেঁচেছিলেন প্রায় ৩০ বছর। তাই আমার আশা ছিলো, হাবিব ভাই কমপক্ষে বছর পাঁচেক আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। মাঝে মধ্যে তাঁর বাসায় গিয়ে দেখে আসবো। কিন্ত আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ভালোবেসে আগে ভাগেই নিয়ে গেলেন।

সোমবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত দিনের অর্ধেক সময়ই হাবিব ভাইর জানাজা ও দাফনে কেটে গেলো। জোহরের নামাজের আগে গেলাম ইস্ট লন্ডন মসজিদে। সেখানে লাশ দেখা, জানাজা পড়া এবং পরবর্তীতে গার্ডেন্স অব পিসে গিয়ে দাফনে অংশগ্রহণ করা। অফিসে অনেক কাজ পড়েছিলো। কিন্তু আমার মধ্যে অফিসে ফেরার কোনো তাড়া ছিলো না। আমি মনের মধ্যে দারুণ এক প্রশান্তি অনুভব করলাম। আজকের দিনটি বছরের সেরা একটি দিন ছিলো। আমার শুধু মনে হচ্ছিলো, একজন জান্নাতি মানুষের সংস্পর্শে এসে জান্নাতেরই আবহ পাচ্ছি।

হাবিব ভাই জন্য একান্ত প্রার্থনা, আমার সেই অনুভুতিটুকুই যেন সত্য হয়। তিনি যেন জান্নাতে সমাসীন হোন। আমরা যেন তাঁর জীবনের ভালো গুণগুলো নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করতে পারি। আমরা মারা গেলেও যে মানুষ সাক্ষ্য দিতে পারে “ওমুক একজন ভালো মানুষ ছিলেন”। মানুষ যেন আমাদের জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। জানাজা শেষে যেন তাড়া করে ঘরে না ফিরেন। গোরস্থান পর্যন্ত গিয়ে যেন শেষ বিদায় জানান। আমরা যেন মানুষের সেই ভালোবাসা অর্জন করতে পারি। আমিন।

সোমবার, ২২ জুলাই ২০২৪। লন্ডন, যুক্তরাজ্য।

তাইসির মাহমুদ: সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ এবং সাধারণ সম্পাদক, লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব।

 

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code