প্রচ্ছদ

অপরাধ নিয়ন্ত্রিত সমাজ গড়ে তুলতে খুব দীর্ঘ সময়ের দরকার নেই

  |  ০৭:০৫, জুলাই ৩১, ২০২০
www.adarshabarta.com

:: আনসার উদ্দিন খান পাঠান ::

১৯৯৩ সনে রুডি জুলিয়ানি যখন নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচি হন তখন শহরটিতে প্রতি এক লক্ষ লোকের হিসেবে অপরাধ হত প্রায় দশ হাজারটি। তা ছিল পুরো আমেরিকায় গড়পড়তা সংঘটিত অপরাধের দ্বিগুন। অপরাধের মাত্রাধিক্যে জনজীবন হয়ে পড়েছিল অতিষ্ঠ। গণদাবি অনুযায়ী তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির এক নম্বরে ছিল শহরটির অপরাধ নিয়ন্ত্রণ। তিনি আশাতীতভাবে সে কাজে সফল হন। তাঁর মেয়াদকালের প্রথম বছর থেকে শুরু করে পরবর্তী দশ বছর ধরে ক্রমাগত কমে সে অপরাধের সংখ্যা দাঁড়ায় এক লক্ষ জনসংখ্যার জন্য মাত্র দুই হাজারটিতে। তা তিনি কিভাবে সেটা সম্ভব করেছিলেন?

পুলিশ কমিশনার হিসেবে জুলিয়ানি বেছে নিয়েছিলেন একজন উপযুক্ত কর্মকর্তা। তাঁর নাম উইলিয়াম যে ব্রাটন। এর আগে মিঃ ব্রাটন ছিলেন নিউ ইয়র্ক ট্রানজিট পুলিশ প্রধান। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সাবওয়েতে টিকিট ফাঁকি, সরকারি সম্পদ নষ্ট, সাবওয়েতে অপরাধ এবং ট্রেনে ষ্টেশনে অননুমোদিত আজেবাজে দেয়াললিখন ( গ্রাফিতি) ইত্যাদি অপরাধ তিনি সফলভাবে দমন করেন। এই সাফল্যের কথা জুলিয়ানি শুনেছিলেন আগেই। তাঁকেই ডেকে এনে বসালেন অপরাধ জর্জরিত শহরের শৃংখলারক্ষার মত চ্যালেঞ্জিং কাজে।

সফল পুলিশ কমিশনার মিঃ ব্রাটন দুনিয়ার রাজধানী খ্যাত নিউ ইয়র্ক শহরের অপরাধ দমনে ঈর্ষনীয় সাফল্যের মন্ত্র কী ছিল? মেয়র জুলিয়ানির অকুন্ঠ সাপোর্ট ছাড়াও তাঁর ছিল সমাজ বিজ্ঞান এবং অপরাধ বিজ্ঞানের পাঠ। তথ্য আর তত্বের এক্সপেরিমেন্ট করা ছিল তাঁর নেশা। ১৯৮২ সনে সমাজ বিজ্ঞানী জেমস উইলসন আর জর্জ কেলিং মিলে নাগরিক জীবনে অপরাধ নিয়ে লিখলেন এক বিখ্যাত প্রবন্ধ। তারই শিরোনাম হলো Broken Window Theory ( ভাংগা জানালা তত্ব )৷ তাঁরা বললেন শহুরে জীবনে চোখের সামনে অহরহ কিছু তুচ্ছ অপরাধ ঘটতে থাকে যেগুলোর দিকে আমরা তেমন মনযোগ দেই না৷ যেমন, নোংরা দেয়াল লিখন , যত্রতত্র রাস্তা পার হওয়া, রাস্তা ব্যবহারের নিয়ম ভংগ করা, পাবলিক সম্পদ নষ্ট করা, রাস্তার মোড়ে অনাবশ্যক আড্ডা দেয়া, যত্রতত্র মূত্রত্যাগ, যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা, পরিবহনে ভাড়া ফাঁকি দেয়া, নেশা করা বা নেশাগ্রস্থ অবস্থায় চলাচল করা ইত্যাদি। নগর জীবনের এসব অনিবার্য অনুষংগের নিয়ন্ত্রণহীনতার সংস্কৃতি অন্তরালে আবডালে বড় বড় অপরাধকে উস্কে দেয়। বড় অপরাধ ঠেকাতে হলে আপাত নিরীহ অপরাধেরও গলা টিপে ধরতে হবে। এ জাতীয় ছোতখাট নিয়মভংগ অনেকটা ছোঁয়াচে। কেউ একজন ফুটপাতের পাশে ময়লা ফেলে গেলেন, সেটা সাথে সাথে পরিষ্কার না করলে সে ময়লা দেখে আরও একজন তার পাশেই ময়লা ফেলে দিলেন। একই ভাবনা আরও অনেককেই পেয়ে বসবে৷ একসময় সবাই ভাববে এটা একটা অস্থায়ী ডাস্টবিন। দুর্গব্ধ ছড়াবে দ্রুতই। তারা আরও বললেন কোন মাস্তান যদি ঢিল ছুড়ে কোন ভবনের জানলা ভেংগে দেয় এবং তা যদি দ্রুত মেরামত না করা হয় অচিরেই দেখা যাবে ভবনের অন্যসব জানালাও ভাংগা। মাস্তানরা ভাববে এটি রক্ষায় কারো দায় নেই, কারো সজাগ দৃষ্টি নেই, কেউ বাধা দেয়ারও নেই৷ সুতরাং আরও একটি ভাংগা যেতে পারে। এভাবে সব জানলাই ভেংগে পড়বে৷ এ বয়ান থেকেই তাঁদের দেয়া থিউরির নাম হল ‘ভাংগা জানালা তত্ব’৷

এই তত্বের এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে পুলিশ কমিশনার ব্রাটন নিরুংকুশ ভোটে নির্বাচিত রিপাবলিকান মেয়র জুলিয়ানির সমর্থন পেলেন৷ শুরু করলেন ছোটখাট অপরাধ বন্ধে তাঁর বিশাল জেহাদ৷ সাবওয়ে আর পাবলিক পরিবহনে ভাড়া ফাঁকি, দেয়াল লিখন, প্রকাশ্যে মূত্রত্যাগ, প্রকাশ্যে মদ্যপান, ইচ্ছেমত রাস্তা পারাপার, অনাবশ্যক আড্ডা, ছিঁচকে চুরি, অননুমোদিত স্থানে নাচানাচির মত এমন অপরাধ তিনি কঠোরভআবে দমনে নামলেন। প্রথমে সবাই ভাবলো লোমহর্ষক সব অপরাধ ঘটছে চারদিকে, সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে পুলিশ এসব তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে মেতেছে কেন। বছর না ঘুরতেই নিউইয়র্ক বাসী তার সুফল পেলেন, পরিসংখ্যানে স্পষ্ট হয়ে উঠলো বড় বড় অপরাধ হ্রাসের বিষয়টি। কমিশনার ব্রাটন অপরাধ দমনে কমিউনিটি এবং অপরাপর সেবাদানকারী সংস্থাকেও সম্পৃক্ত করলেন। কোন রাস্তায় বা কম্যুনিটি ব্যবহার্য ফাকা জায়গায় রাতের বেলায় আলো নেই,এগিয়ে আসলো সংশ্লিষ্ট সংস্থা, কোন রেষ্টুরেন্টে পানের পারমিশন আছে, নাচের নেই, তা প্রয়োগে লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসলো, পুলিশী পদক্ষেপ নিয়ে জনসমর্থন দরকার, এগিয়ে আসলো স্থানীয় কম্যুনিটি নেতারা।

ভাংগা জানালা থিউরি আর কম্যুনিটি পুলিশের এই সফল প্রয়োগ ছাড়াও তিনি নিজস্ব সংগঠন পুলিশে কাজের মান বাড়ানো এবং সদস্যদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকল্পে তার ম্যানেজমেন্টেও আনলেন কিছু পরিবর্তন। এই উদ্যোগের নাম হল CompStat (Compare Statistics). এর মাধ্যমে বিশেষ অপরাধ বৃদ্ধির স্থান ও কারণ নির্ধান, ডাটা সংরক্ষণ, কম্পিউটার নির্ভর ক্রাইম ম্যাপ তৈরি এবং তার বিশ্লেষণ, অফিসারদের পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধির মত পদক্ষেপ নিলেন। এর আওতায় তিনি পুলিশ সদস্যদের অবশ্যপাঠ্য হিসেবে একটি সাপ্তাহিক নিউজ বুলেটিন বিতরণের ব্যবস্থা করলেন। তাতে থাকতো NYPD এর সকল ইউনিটে সংঘটিত সাপ্তাহিক অপরাধ, গ্রেফতার, সমন জারী, পেট্রোল, জনতার অভিযোগ, পুলিশী উদ্যোগ, সিনিয়র কর্মকর্তাদের মন্তব্য ও নির্দেশনা। সে বুলেটিনে পূর্ববর্তী সপ্তাহ এবং মাসের অপরাধ পরিস্থিতির বর্ননাও থাকতো। এ বুলেটিন সকল পুলিশ সদস্যের মধ্যে বিতরণ করা হত। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বসতো সকল ইউনিট কমান্ডারদের নিয়ে সাপ্তাহিক পর্যালোচনা বৈঠক। ব্যক্তিগতভাবে কমান্ডারদের সেখানে উপস্থিত হয়ে জবাবদিহী করতে হত। প্রথম দফায় মাত্র দুই বছর কমিশনার হিসেবে কাজ করেন ( ১৯৯৪-৯৬)। এ স্বল্প সময়েই মিঃ ব্রাটনের সফল কর্মকান্ডের সুনাম ছড়িয়ে পড়লো পুরো পাশ্চত্যে। পরবর্তীতে তিনি ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের এডভাইজার হিসেবেও দীর্ঘকাল কাজ করেন।

অবশ্য দুবছরের মাথাতেই মেয়র জুলিয়ানির সংগে বিরোধ বাধলো৷ অনেকেই বলেন মেয়রের শংকা হচ্ছিল ব্রাটন তাঁর জনপ্রিয়তাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছিল, তার পরিনতিতেই এই বিরোধ। মিঃ ব্রাটন পদত্যাগ করে চলে গেলেন কিন্তু তাঁর অনুসৃত নীতি রয়ে গেল৷ সে পথ ধরেই পরবর্তী দশ বছর ধরেই নিউইয়র্কের অপরাধ অধঃমুখী থাকলো। মিডিয়া তাঁর কর্মকান্ডকে তুলে ধরেছে, করেছে প্রশংসা, ছাপিয়েছে অপরাধ পরিস্থিতির ইতিবাচক ছবি আর পরিসংখ্যান৷

তাঁর কাজের কিছু সমালোচনাও ছিল। হিস্পানিক, কালো, গৃহহীন, ভিক্ষুক জনগোষ্ঠীর উপর খরগগ্রস্থ হওয়া, সামান্য অপরাধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে জনহয়রানি করা, অযথা তল্লাশী করা ইত্যাদি ছিল মূল অভিযোগ।

তিনি নিজে জিরো টলারেন্স এবং ব্রোকেন ইউন্ডোর বিষয়গুলো মিডিয়ার সামনে এসে পরিষ্কার করেছেন। এ দুটির পার্থক্য ব্যাখ্যা করেছেন । তিনি জিরো টলারেন্স নীতি সাপোর্ট করতেন না৷ তাঁর মতে জিরো টলারেন্সে পুলিশের জবাবদিহীতা থাকে না, অপরাধের মাত্রা নির্ধারণ করে শাস্তি কমবেশী করার সুযোগ থাকে না, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সব বিকল্প বাদ দিয়ে এটি প্রায় অনাবশ্যক একটি চূড়ান্ত ব্যবস্থা, সিভিল আইনী ব্যবস্থা বাদ দিয়ে সহজ সামরিক পথে সমাধানের পথ খোঁজা, জনসম্পৃক্ততার তোয়াক্কা না করা। তার মতে ভাংগা জানালা থিউরি সেরকম নয়৷ অপরাধের মাত্রামতে শাস্তি, সামাজিক সমস্যা সামাজিকভাবে মোকাবেলা, ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা, আইনের স্বচ্ছ প্রয়োগ, পুলিশ অফিসারদের জবাবদিহী করা ছিল তাঁর নীতির অন্যতম চর্চা। জিরো টলারেন্স নীতির সাথে এর মিল নেই।

সৃষ্টিশীল ভাবনা আর কর্মোদ্যোগ নিয়ে পুলিশ , তার সমর্থনে রাজনীতিক, সমাজবিজ্ঞানী , সংবাদমাধ্যম আর সচেতন জনগণ , এমন হলে অপরাধ নিয়ন্ত্রিত সমাজ গড়ে তুলতে খুব দীর্ঘ সময়ের দরকার নেই, নিউইয়র্ক তার প্রমাণ।