প্রচ্ছদ

বদলে যাওয়া পৃথিবী, পর্ব-২

  |  ২১:১৭, জুন ০৪, ২০২০
www.adarshabarta.com

:: অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান ::

কথিত চেক জালিয়াতির অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিসে জর্জ ফ্লয়েড নামক এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে পুলিশ কর্তৃক প্রকাশ্যে শ্বাসরোধ করে হত্যা এবং পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিক্ষোভ-দাঙ্গা-লুটপাট এবং বিক্ষোভ দমনে পুলিশের গুলিতে এ পর্যন্ত আরো ১৪ জন নিহত ও নয় হাজার গ্রেপ্তার হওয়া; অথবা লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের অতিসম্প্রতি ২৬ জন বাংলাদেশিকে হত্যা ; অথবা ভারতে একটি গর্ভবতী হাতিকে পিটিয়ে হত্যা; এর কোনোটাই করোনা পরবর্তী নতুন বিশ্বের ধনাত্মক কোনো আলামত নয়।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি বলেছেন, “…নিজেদের সুবিধার জন্য নয়া উদারবাদীরা যে ব্যবস্থাটা তৈরি করেছে, তারাই আরেকটি কঠোর সংস্করণ সামনে আনার জন্য সচেষ্ট।” ধনাত্মক বা ঋণাত্মক যাই হোক, পরিবর্তন হবেই। মানুষ চেষ্টা করেও আর আগের অবস্থাটা পুরোপুরি হুবহু ধরে রাখতে পারবে না। যেমনটি বলেছেন মহামারি বিশেষজ্ঞ রব ওয়ালেস, “…পুঁজিবাদের সংকট প্রকাশিত হয়েছে স্বাস্থ্য সংকটের রূপে এবং মানুষ আর আগের স্বাভাবিক রূপে ফিরতে পারবে না।” নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার কলামিস্ট টম ফ্রিয়েডম্যান (Tom Friedman) সম্প্রতি এক লেখায় বলেছেন, “চলতি প্রজন্ম কালনির্ধারণী দুটি এব্রিবিয়েশন শিখবে তা হচ্ছে, BC (Before Carona) এবং AC (After Corona)।” অর্থাৎ করোনা পরবর্তী পরিবর্তনটা খুবই সুস্পষ্ট হবে। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু’র পর এত বড় থমকে যাওয়ার ঘটনা বিশ্বে আর ঘটেনি। দুনিয়াজোড়া লকডাউনের ঘটনা তো একেবারেই বিরল। আমাদের এই অঞ্চলের লকডাউন একেবারেই অচেনা। ২৬ এপ্রিল ১৯৮৬ চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর ৩০ বর্গমাইলের মধ্যে থাকা ৯০০০০ মানুষকে অপসারণ করে এলাকাটি লকডাউন করে দেয়া হয়। ইউক্রেন এবং রাশিয়ায় এটাকে অনেকটা বিদেশি শক্তির বিপরীতে জয় হিসেবে দেখা হয়। ২০১৫ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী Svettana Alexievich তার বই, “Voice From Chernobyl: The Oral History of Nuclear Disaster”-এ ‘যুদ্ধ’ আর ‘দুর্যোগকে’ মিশিয়ে ফেলার বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছেন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (নাইন/ইলেভেন) টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসিতে সবাইকে বাড়িতে রেখেই কয়েকদিনের জন্য “লকডাউন” করা হয়। ১৩ নভেম্বর ২০১৫ তে আইএস জঙ্গিরা প্যারিসে হামলা করলে সবাইকে ঘরে রেখেই ব্রাসেলসে চারদিনের লকডাউন দেয়া হয়। করোনার শুরুতে কোভিড-১৯ এর উৎপত্তিস্থল চীনের উহানে সবাইকে ঘরে রেখে লকডাউন করা হয়। উহানে লকডাউনের সফলতার কারণ হলো চীনাদের ২০০৩ সালের সার্স ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা। বাদবাকি দুনিয়ায় বিচ্ছিন্নভাবে এক দুটি শহরে বা অঞ্চলে সফল হলেও লকডাউন সে অর্থে দুনিয়ার কোথাও পরিপূর্ণভাবে সফল হয়নি। বাংলাদেশ শুরুতে মিরপুরের টোলারবাগ এবং মাদারীপুরের শিবচরে যেভাবে কার্যকর করা গিয়েছিল পরবর্তীতে দেশব্যাপী সেটা কার্যকর করা যায়নি। আরো বেশি কার্যকর হলেও এ দিয়ে করোনার হাত থেকে পরিপূর্ণ মুক্তি পাওয়া সম্ভব ছিল কিনা বা কতটা ফলদায়ক হতো তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। করোনা মহামারি মোকাবিলার অভিজ্ঞতা বিশ্বে কারো ছিল না। বাংলাদেশের তো নয়ই। বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও ‘trial and error’ বেসিসে সবকিছু চলছে। শুরুতে বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানারের স্বল্পতা নিয়ে ব্যাপক শোরগোল হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যে স্ক্যানিং ব্যবস্থার উন্নয়ন হলো। থার্মাল স্ক্যানিং পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পর খবর আসলো জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিরা স্ক্যানারের সামনে আসার আগে নির্দিষ্ট সময় হিসেব করে প্যারাসিটামল খেয়ে শরীর ঠান্ডা করে স্ক্যানার অতিক্রম করেছে। একপর্যায়ে তো যাত্রীরা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি স্ক্যানার ভেঙেই ফেলল। এ নিয়ে অনেক হৈচৈ হলো। অনেকদিন পর এখন আবার দেখছি লঞ্চে, বাসে, ট্রেনে যাত্রী উঠানোর আগে দূর থেকেই জ্বর মাপা যায় এমন থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা মেপে যাত্রীদের পরিবহনে উঠানো হচ্ছে। । সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এখন বলা হচ্ছে করোনায় সংক্রমিত ২৫ শতাংশেরও বেশি লোকের ক্ষেত্রে কোনো উপসর্গ থাকে না। জ্বর কাশি কিছুই না। স্ক্যানিং এর ফলে জ্বর আছে (জ্বর মানুষের বিভিন্ন কারণেই হতে পারে) এমন নন-করোনা যাত্রী পরিবহনে উঠতে পারলো না। উপসর্গবিহীন কিন্তু নিশ্চিত করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি (টেস্টে পজেটিভ) পরিবহনে উঠে অনেককেই সংক্রমিত করতে পারে। আরেকটি প্রহসন চলছে, জীবাণুনাশক টানেলের নামে ইথানল, ব্লিসিং আর ক্লোরিনের মিশ্রণে পানি ছিটানোর ফলে গায়ে লেগে থাকা করোনার আরএনএ কতটা মরে এটা কোনো অনুজীববিজ্ঞানীকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে। কিছুদিন আগে সিটি কর্পোরেশনের গাড়িতে করে রাস্তায় পানি মিশ্রিত জীবাণুনাশক ছিটাতে দেখা গেছে। করোনা মোকাবিলায় এগুলো একেবারেই হাস্যকর পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ভাইরাস মারা তো দূরের কথা ত্বকের এবং চোখের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বিভিন্ন অপকর্ম করে অর্থ জালিয়াতি এবং লোক দেখানো কর্মকাণ্ড ছাড়া এগুলোর আর কোনো তাৎপর্য নাই। আসলে করোনা মোকাবিলার পদ্ধতি নিয়ে কারো কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রতিদিন নতুন নতুন সুপারিশ আসছে। আমি নিজে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেলকে বলতে শুনেছি, “মাস্ক পরে করোনার সংক্রমণ রোধ করা যাবে না। সকলের মাস্ক পরার দরকার নেই। ” একই ব্যক্তিকে আবার কয়েকদিন পরে সবাইকে মাস্ক পরার জন্য বলতে শুনেছি। পরিবহনে পাশের সিট খালি থাকলেও সামনের ও পিছনের সিটের দুরত্ব “স্বাস্থ্য বিধি” অনুযায়ী বজায় থাকছে কিনা সেটা দেখার বিষয়। স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হলে অতিরিক্ত ভাড়া দেয়ার কোনো যুক্তি নেই। হোম কোয়ারেন্টাইন আমাদের সংস্কৃতিতে প্রায় অসম্ভব একটি প্রপঞ্চ। আইসোলেশন আমাদের নৃতাত্ত্বিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যের বিপরীতে। ‘আটকে রাখা’ বা ‘ঘিরে রাখা’ (containment) এর সফলতা অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিকভাবে শনাক্ত করা, চিকিৎসা দেওয়া, আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের আলাদা করা এবং সংক্রমণের স্থান ও বস্তু ভাইরাস মুক্ত করা। ‘আইসোলেশন’ উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলোর বিকল্প নয়। একা থাকা সত্যিই কষ্টকর। ফরাসিরা বলে, ” isolation is nothing, but a bad solitude. ” কতদিন দূরে থাকবো, কত দূরে থাকবো, সে হিসাবে গরমিল দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যেই বিশেষজ্ঞরা বলছে ১৪ দিন যথেষ্ট না। তিন ফুট দূরত্ব খুব কম হয়, ছয় ফুট হলে ভালো হয়। এখন বলা হচ্ছে করোনার অতিক্ষুদ্র কণাগুলো পাখা না থাকলেও বাতাসে ভর করে অনেক দূর উড়তে পারে। অতএব আরো দূরে যাও। কাউকে গায়ের কাছে ঘেঁষতে দেয়া যাবে না। মাস্কের সাথে বর্ম হিসেবে ফেশশিল্ড ব্যবহার করতে পরামর্শ আসছে। মাস্ক না পরলে তো জেল-জরিমানা থাকছেই। পকেটে থাকতে হবে স্যানিটাইজার, ঘণ্টায় ঘণ্টায় হাতে মাখতে হবে। সবচেয়ে ভালো হচ্ছে কোনো কিছু স্পর্শ না করা, সবই fomite। হাত দুটো সবসময় প্যান্ট অথবা কোটের পকেটে রাখা গেলেই ভালো। হেডফোন ব্যবহার করা যাবে না। স্পিকার ব্যবহার করুন। জীবনে গোপনীয় আর কিছু থাকবে না। ভিড়ের মধ্যে পাবলিক পরিবহন পরিহার করুন। সাইকেল সবচেয়ে নিরাপদ। মার্চ মাসের পর থেকে আমেরিকায় সাইকেলের চাহিদা দ্বিগুণ বেড়েছে।

টাকা বা কয়েন হচ্ছে সবচেয়ে বিপদজনক। ‘ক্যাশলেস” হয়ে যাবে সমাজ। যেটা সুইজারল্যান্ড শুরু করেছে এক দশক আগে। বিভিন্ন অজুহাতে সফলতা শতভাগ আসেনি। করোনা এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে। কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকা শহরের রিকশাওয়ালারা জিজ্ঞেস করবে পেমেন্ট কীভাবে করবেন? বিকাশে করবেন তো? নগদ টাকা নেই না। জাল টাকার ঝামেলা, ভাঙতি টাকার ঝামেলা, অনেক কিছুই কমে যাবে। নগদ টাকা না থাকলে ঘুষ প্রদানও কমে যাবে। ঘড়ি, আংটি; জুয়েলারি অনেকেই পরবে না। উপহারও নেবে না। চাহিদা বাড়বে কলমের, সবাই কলম সাথে রাখবে। কারো কলম কেউ ব্যবহার করবে না। দরজার হ্যান্ডেল থাকবে না, রিমোট কন্ট্রোল দরজা চালু হবে। লিফটের বাটন থাকবে না, ভয়েস কমান্ডে লিফট চলবে। শিশুদের ডে-কেয়ার বন্ধ হয়ে যাবে হয়তো। কারণ শিশুরা খেলনা ভাগাভাগি করতে পারবে না। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে টিউশনি বন্ধ হয়ে যাবে। অভিভাবকরা বাইরের কাউকে বাড়িতে গ্রহণ করবে না। টিউশনিরও অনলাইন ভার্সন চালু হবে। বিদেশ গেলে প্রথম ১৪ দিন থাকতে হবে সেলফ আইসোলেশনে। ইমিগ্রেশনে পৌঁছার আগেই জানিয়ে দিতে হবে আপনার নতুন অবস্থানের ঠিকানা ও ফোন নম্বর। জায়গামতো পাওয়া না গেলে লক্ষ টাকা জরিমানা। ক্রেডিট কার্ড ও মানিব্যাগের ব্যবহার সীমিত হয়ে যাবে। মোবাইল ট্রান্সফার বেশি হবে। পাসপোর্ট হবে বায়োমেট্রিক| স্পর্শবিহীন ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন চলে আসবে। ইমিগ্রেশনে কাজ করবে ক্যামেরা, কেনো মানুষ থাকবে না। চোখের মনি স্ক্যান করে সঠিক ব্যক্তি শনাক্ত হলে গেট খুলে যাবে। পাবলিক কলের পানি খাওয়া যাবে না। সবাইকে সাথে পানি নিয়েই চলতে হবে। পানি কাউকে শেয়ার করা যাবে না। অনেক কাজ চলে গেলেও মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও ওয়ার্কশপের কাজ বাড়বে। কারণ আরো অন্তত দুই বছর স্থায়ী পণ্য ক্রয় বিলম্বিত করবে অনেকেই। অনেকেরই কাজের দক্ষতা বাড়বে প্রক্রিয়া সরলীকরণে মাধ্যমে। ব্যবসার খরচ কমিয়ে লাভবান হবে অনেকেই। দরিদ্ররাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে বিনোদন ও পর্যটন খাতের সংশ্লিষ্টদের অবস্থা বেশি খারাপ হবে। ‘বাড়ি থেকে কাজ করা যায়’ এমন পেশার লোকদের আয় কিছুটা কমলেও হয়তো বেকার হবে না। কিন্তু প্রত্যক্ষ সেবা প্রদানের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যেমন রেস্টুরেন্ট বয়, ট্যুর গাইড এদের কাজ থাকবে না। ভার্চুয়াল ট্যুরিজম অনেকটা প্রচলিত ট্যুরিজমের জায়গা দখল করে নেবে। যারা যত দ্রুত নতুন অবস্থার সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারবে তারাই টিকে যাবে। অদক্ষ লোকদের কাজ ও আয় কমে যাওয়ায় বৈষম্য আরো বাড়বে বৈ কমবে না। (চলবে)

লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।