প্রচ্ছদ

কালের সাক্ষী “কাজাঞ্চি রেলওয়ে ব্রীজ”

  |  ০৮:২৭, জুন ০১, ২০২০
www.adarshabarta.com

:: মিজানুর রহমান মিজান ::

বাংলাদেশ একটি নদী মাতৃক দেশ হিসেবে খ্যাত। আমরা যখন লেখাপড়া করি তখন বই পুস্তকে ও তা পড়েছি। তবে বর্তমান অবস্তা দৃষ্টে মনে হচেছ নদী মাতৃক দেশ থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সরে আসছে। কারন ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধ ও টিপাইমুখ বাঁধ তৈরীর ফলে বাংলাদেশের নদীগুলি মৃত প্রায়। হারিয়েছে তার জৌলুস, নাব্যতা এবং ভরাট হয়ে কমছে প্রশস্থতা ও গভীরতা।এক সময় নদী পথই ছিল বাংলাদেশের যোগাযোগের প্রধান ব্যবস্তা। অত:পর রেলপথ। সুতরাং সঙ্গত কারনেই সিলেট বিভাগের রেলপথের ইতিহাস জানা আবশ্যক।তবে নদী পথের গুরুত্বতা একটু নজর দিলেই বেরিয়ে আসবে অতি সহজে যে কারো। যেমন আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই পূর্বের শহর-বন্দর, হাটবাজারগুলি সহজ যোগাযোগের অবস্তা চিন্তা করেই আমাদের পূর্ব পুরুষরা স্থাপন করেছেন নদী তীরেই অধিকাংশ।তাই নদীমাতৃক দেশ বলে নামকরণের ক্ষেত্রে ও রয়েছে যথার্থতা। আর আজকাল নদী তীরের কথা কেহ চিন্তা করেন না কোন হাট-বাজার বা শহর গড়ে তোলতে। অন্য যে কোন সুযোগ সুবিধার কথা বিবেচনা করেই স্থাপনা গড়ে তোলতে ইচছুক বা আগ্রহ বেশি পরিলক্ষিত হয়।

যাক আসছি মুল প্রসঙ্গে। ১৮৯৬ সালে আসাম বেঙ্গল রেল লাইন কুলাউড়া হয়ে শিলচর পর্যন্ত যাতায়াত করত। ১৯২২-১৫ সালে চালু হয় কুলাউড়া সিলেট রেল লাইন। ১৯২৮ সালে চালু হয় শায়েস্তাগঞ্জ-হবিগঞ্জ এবং ১৯২৯ সালে শায়েস্তাগঞ্জ-বাল্লা ও ১৯৫৪ সালে সিলেট ছাতক রেল লাইন চালু হয়। সুতরাং ১৯৫৪ সাল থেকে খাজাঞ্চি নদীর পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে খাজাঞ্চি নদীর উপর নির্মিত রেলওয়ে ব্রীজটি। তবে একবার এ ব্রীজটি আংশিক ভেঙ্গে পড়ায় কিছুদিন সাময়িক অসুবিধার সৃষ্টি হয়।কবে, কেন এবং কিভাবে ব্রীজটি ভাঙ্গা হয়েছিল তা বর্তমান প্রজন্মকে অবহিত করণার্থে সে কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই।

আমি তখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে এক রাত অনুমান তিন বা চারটার দিকে বিকট শব্দে ভু-কম্পনের মতো ঘরদোর কেঁপে উঠে। কান তালাবদ্ধ হবার উপক্রম। গ্রামের মানুষজন ভয়ার্ত চিত্তে শুধু আল্লাহকে স্মরণ করছেন। বয়স্করা এবাড়ি ওবাড়ি যাতায়াত করছেন নির্জন, নি:শব্দে।আলোহীন অন্ধকারে চলছেন সকলেই। ঘটনার আদ্যোপান্ত জানার আগ্রহ সবার। কি ভয়াল ও শংকিত প্রতিটি মানুষের হৃদয় মন। এই বুঝি পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ করল। গ্রাম ছেড়ে যাব কোথায়? আর না গিয়েই বা কি হবে? বাঁচতে তো হবে। বয়স্কদের চুপি চুপি কথাবার্তা শুনে তখন আমার কচি প্রাণ শুকিয়ে গিয়েছিল। যাই হোক আর কোন সাড়া শব্দ নেই। এক সময় মসজিদে ধ্বনিত হয় ফজরের নামাজের আযান।তখন কিন্তু মসজিদে মাইক ব্যবহারের প্রচলন ছিল না গ্রামে। আযান ফুকারতেন মুয়াজ্জিন টিনের তৈরী এক প্রকার বিশেষ কায়দায় তৈরীকৃত চোঙ্গার মাধ্যমে। যার শব্দ ছিল ক্ষীনতর। কাজ কর্ম সকলেই ছেড়ে দিয়েছেন। একটাই লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য রাতের বেলা সংঘটিত শব্দের উৎস খোজে বের করা বা কোথায় কি হয়েছে তা অবগত হওয়া। সকাল অনুমানিক ৭/৮ ঘটিকার মধ্যে অবহিত হলাম খাজাঞ্চি নদীর উপর নির্মিত রেলওয়ে ব্রীজটি ভাঙ্গার খবর। ব্রীজের পশ্চিম তীরের সম্পূর্ণ পিলারটি ভেঙ্গে ঐ স্থানে একটি মিনি পুকুরের মত হয়ে যায়। এ ভাঙ্গনে সম্পৃক্ত আছেন বাংলার দামাল ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা।অর্থ্যাৎ পাকসেনাদের যোগাযোগ বিচিছন্ন করতে মুক্তিযোদ্ধারা ব্রীজটি ভাঙ্গেন।বিষয়টি জানার পর মানুষ অনেকটা আশ্বস্থ হন, একটু আলোর ঝিলিক ফুটে উঠে মন মননে। বাংলার দামাল ছেলেরা আসছে এগিয়ে। তারপর ও একদম নিশ্চিত নন। কখন কি ঘটে বলা যায় না। সর্বদা মানুষের মনে আতংক, শংকা ও উদ্বিগ্নতা অহরহ।কারন এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে একদিন খাজাঞ্চি ইউনিয়নের বিশিষ্ট মুরব্বিয়ান, গুণীজন, সম্মানিত ব্যক্তিদের ডাকে আনে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে শান্তি কমিটি করার কথা বলে। তখন প্রত্যেক মা-বাবারা এগিয়ে আসতেন। তরুণ ও উঠতি বয়স্ক যুবকদের না দিয়ে অভিভাবকরা ডাকে সাড়া দিতেন এ বলে যে, “যা হবার আমাদের হবে , আমার সন্তান বাঁচুক এ অনুধায় সিক্ত হয়ে”।সকল মুরব্বিয়ানদের একত্রিত করে পাক সেনারা সেদিন বলেছিল, “ তোমাদের সন্তানরা কে, কোথায় বা কেন আসেনি”।মুরব্বিয়ানরা ইত:স্ততবোধ বা সঠিক জবাব দিতে না পারায় তাদের দৃষ্টিতে সেদিন সবচেয়ে বয়স্ক মুরব্বিয়ানদের বলেছিল উত্থাল তরঙ্গায়িত পানি ভরাট প্রবল স্রোতের মধ্যে নদী সাঁতরিয়ে এপার থেকে ওপারে যেতে। অনেক মুরব্বিয়ানরা সেদিন হয়েছিলেন কাবু। বয়সের ভারে ন্যুজ ব্যক্তিরা পারছিলেন না নদী সাঁতরিয়ে সেপারে যেতে। খাচিছলেন হাবু ডুবু, মরার উপক্রম। তখন একটি পাকসেনা বলছিল উঠে আসতে ডাঙ্গায়। তীরে উঠার পর বিভিন্ন প্রকার শাস্তি দিয়ে বিদায় দিয়েছিল।রাজাকারদের ব্যাংকার ছিল ব্রীজের উভয় পারে। আমার মামার বাড়ি নদীর ওপারে থাকায় যেতে আসতে দেখতাম তাদেরকে। অনেক সময় অনেক কিছু জিঞ্জেস ও করত। মিথ্যা কথা বলে এই সেই বলে চলে আসতাম।নদীতে তখন থাকতো খেয়া নৌকা নদী পারাপারের নিমিত্তে। এর কয়েকদিন পর আশপাশের গ্রামের প্রত্যেক পরিবারের উপর আদেশ হল প্রত্যেকে একটি করে বাঁশ প্রদান করতে। দেয়া ও হয়েছিল। আস্ত বাশঁ নদীর উভয় তীরে পুতে বেড়া দেয়া হয়েছিল রেলগাড়ী যাবার পথ রেখে। যাতে মুক্তি সেনারা আসতে না পারেন।অনেক সময় রাজাকাররা রাজাগঞ্জ বাজারে বা গ্রামে গিয়ে বলত তাদেরকে মোরগ দিতে খাবারের জন্য।না দিয়ে উপায় ছিল না। তাছাড়া প্রত্যেক পরিবার থেকে নদী রাজাকারদের সহিত পালাক্রমে পাহারার ও ব্যবস্তা ছিল। রাজাকাররা নাক ডেকে ঘুমাত সাধারণ মানুষকে পাহারায় রেখে। তবে এক দু‘জন তাদের দেখভালের জন্য অর্থ্যাৎ পাহারা দিচেছন কিনা তদারকিতে থাকতো।আমাদের রাজাগঞ্জ বাজার এর হাটবার ছিল সপ্তাহের প্রতি রবি ও বৃহস্পতিবার। হাটে মানুষ আসতেন ভয়ার্ত চিত্ত নিয়ে। সবার একটি শংকা ছিল সর্বক্ষণ কখন এসে হানা দেবে রাজাকাররা বা পাকসেনারা। মানুষ আতংকিত ও ভয়ার্ত মন নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সওদা করে চলে যেতেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে জুন মাসের এক হাঠবারে রাজা গঞ্জ বাজারে লঞ্চ যোগে এসেছিলেন এডভোকেট শহিদ আলী পাক সেনাদের সাথে। উদ্দেশ্য মিটিং করা।এলাকার সকল তরুণরা এদিন চলে গিয়েছিলেন আত্মগোপনে। কি জানি কি হয়।ওরা এসে দু’টি মাইক সেট করে আর সম্মুখে একটি টেবিল বসিয়ে বেশ কয়েকজন বক্তব্য রেখেছিলেন। তাদের বক্তব্যে ফুটে উঠেছিল আবার নির্বাচন হবার। এলাকার কয়েকজন বয়স্ক মুরব্বি ছিলেন শ্রোতা। আমরা ছোট শিশুরা আড়াল আবড়াল থেকে তা শুনেছিলাম। ঐ আসরে একজন বয়স্ক হালকা পাতলা ছিপছিপে ক্ষীণ দেহাঙ্গী লোক একটি গান ও পরিবেশন করেছিল। যার কলি ছিল, “ পাকিস্তানী ভাইওরে, ভুল করনি চাইওরে, দফার কোম্পানী আইরা ভোটের বাজারে”।যাক অনেক দীর্ঘ হয়ে যাচেছ তাই সংক্ষিপ্ত করছি। আপনাদের ধৈর্য়চ্যুতি হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা হেতু। বলবো সময় করে একদিন, “এখানে নয় অন্য কোথাও , অন্য খানে”।

বড়দের মুখ থেকে শুনতে পেলাম ব্রীজ ভেঙ্গে লোহার স্লিপার প্রায় এক কিলোমিটার দুরে কান্দি গ্রামে এসে পড়েছে। দেশ স্বাধীন হবার পর ব্রীজের নিকট স্কুল প্রতিষ্ঠিত হবার ফলে সেখানে যাতায়াত কালে স্বচক্ষে দেখেছি এর ভীবৎসতা।দীর্ঘ সম্পূর্ণ স্লিপারটি বেঁকে গিয়ে এতোদুর এসে পড়েছে। শক্তিশালী বোমা ছিল বলে আমরা অনেক সময় বলাবলি করতাম সকল ক্লাসমিট মিলে। ভাঙ্গনের পর বেশ কিছুদিন ছাতক-সিলেট ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ ছিল। বোমার আঘাতে সৃষ্ট অত্যন্ত গভীর গর্ত ভরাট করে স্বাধীনতার পর রেললাইনের নীচে যে কাঠের খন্ড থাকে তা একটির উপর একটি কৌশল খাটিয়ে পিলার বানিয়ে অনেক দিন ট্রেন যোগাযোগ চলে। সর্বশেষ ১৯৭৬ সালে পুন:নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করে অদ্যাবধি ছাতক সিলেট ট্রেন চলাচল অব্যাহত আছে। খাজাঞ্চি নদীর উপর নির্মিত রেলওয়ে ব্রীজ দিয়ে। তাই কালের সাক্ষী হয়ে আছে এই ব্রীজটি।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক চাঁন মিয়া স্মৃতি পাঠাগার, সাবেক সভাপতি বিশ্বনাথ প্রেসক্লাব।