প্রচ্ছদ

মরমি কবি ইবরাহীম তশ্না, পর্ব-২

  |  ১৩:৩৫, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২১
www.adarshabarta.com

:: নন্দলাল শর্মা ::
ইবরাহীম তশ্না মাহবুবের দিদার লাভের আশায় উদাসীন জীবনযাপন করেন। এ সময় তাঁর অন্তর থেকে উৎসারিত হয় মরমি গান। এই গান তাঁর সাধনার ফসল। তাঁর গানে ধ্বনিত হয়েছে মানবহৃদয়ের গভীর ভালোবাসা ও এলাহি প্রেমের আধ্যাত্মিক বাণী। তাঁর করুণ আর্তনাদ ও আহাজারি আল্লাহর উদ্দেশে, আল্লাহর করুণা লাভই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। সুফি সাধকগণ দীর্ঘকাল ধরেই মরমি সংগীত রচনার ধারাকে সঞ্জীবিত রেখেছেন। বিশ্বসাহিত্যে মরমি সাহিত্য বা সুফি সাহিত্য বিশেষ অবদান রেখেছে। সুফি সাহিত্যের আদি কবি বাবা তাহির উরিয়ান হম্দনী। তিনি আরবি ও ফারসিতে কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর কবিতায় দেখা যায় আল্লাহপাক ও মানুষের মৌলিক ঐক্য; এবং এর বিভিন্নতার জন্যই আল্লাহর সান্নিধ্য থেকে মানুষের বিচ্যুতি ও পৃথিবীতে নানা রকম দুঃখকষ্ট ও সাংসারিক অশান্তি। এই বিভিন্নতার মধ্য দিয়েই প্রেম বিস্তার দ্বারা আবার মানুষ তাঁর সঙ্গে মিলিত হয় এবং যে পর্যন্ত না- মানুষ সেই স্থানে পৌঁছে বিরহের কান্না তাঁর জীবনে সকল সময় ধ্বনিত হতে থাকে। (পাল ১৩৬০ বাং ৫৩) ।
ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে সুফি প্রভাব পড়তে থাকে। (হক; ২০০৬: ২০) মরমি সাধকদের সাধনার রহস্য জনসাধারণের জন্য উম্মুক্ত নয়। এগুলো গুরু থেকে শিষ্য প্রশিষ্যে প্রবাহিত হয়। তাঁদের ভাব ভাষায় সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয় না। হৃদয়ের কথা হৃদয় দিয়ে বুঝতে হয়, মস্তিষ্ক বা বুদ্ধি দিয়ে নয়। তাঁদের “অবান্তর ও অনির্ববনীয় অনুভূতিগুলোই সুরলোকের বাসিন্দা হয়ে মরমি কবিগণ ব্যক্ত করেন। জীবন-জগৎ ; দেহ-রূহ এবং মানবজীবনের সৃষ্টি রহস্য ও পরিণতিকে কেন্দ্র করেই তাঁদের ভাব ও ভাবনা পেখম মেলে”। (কামাল-১৯৯৮:১০) ।
সিলেটের ভৌগোলিক অবস্থান ও নৈসর্গিক রূপ সুষমা মানবমনকে বিবাগী করে তোলে। নদ-নদী, হাওর-বাওড় ও পাহাড়-টিলা এখানকার মানুষকে ভাবের জগতে নিয়ে যায়। সিলেটের মাটি অত্যন্ত পবিত্র। এ মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ওলিকুল শিরোমণি হজরত শাহজালাল (রহ.) এবং তাঁর সহচর ওলি-আউলিয়া। এই মাটি শ্রীচৈতন্যদেবের পিতৃভূমি ও মাতৃভূমি। মরমি কবি, বৈষ্ণব কবি ও সুফি সাধকের দেশ সিলেট। এলাকার মাটি, প্রকৃতি ও আবহাওয়া এখানকার অধিবাসীদের স্রষ্টার সৃষ্টি বৈচিত্র্যের রহস্য পর্যবেক্ষণে রত রেখেছে। এখানকার মরমি কবি ও সাধকদের মরমি বাণী ও সুরলহরি, বউল ও বৈষ্ণবদের মরমি সংগীত বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। (শর্মা ২০:৭ : ১৫-১৬) ।
ইবরাহীম তশ্না একজন যথার্থ সুফি ছিলেন। তিনি ছিলেন শরিয়তপন্থি। তিনি ইসলামের অনুশাসন কঠোরভাবে মেনে চলেছেন। তাঁর গানে এর প্রমাণ মেলে। তাঁর গীতিগুচ্ছকে বিষয় বস্তু অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে:
১. আল্লাহ স্মরণ ২. নবী স্মরণ ৩. ওলি স্মরণ ৪. মুর্শিদ স্মরণ ৫. ভক্তিমূলক ৬. ফকিরি তত্ত্ব ৭. নিগূঢ় তত্ত্ব ৮. মনঃশিক্ষা ৯. দেহতত্ত্ব ১০. কামতত্ত্ব ১১. বিচ্ছেদ ইত্যাদি। (চলবে)
লেখক: নন্দলাল শর্মা অধ্যাপক ও গবেষক
তথ্যপঞ্জি
আশরাফ সিদ্দিকী: লোক সাহিত্য হয় খ-, ঢাকা ১৯৯৫
গুরুসদয় দত্ত ও নির্মলেন্দু ভৌমিক সম্পাদিত : শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত, কলিকাতা ১৯৬৬
নন্দলাল শর্মা সম্পাদিত : বাঁশির সুরে অঙ্গ জ্বলে, সিলেট ২০০৭, : মরমী কবি শিতালং শাহ, ঢাকা ২০০৫
মুহম্মদ এনামুল হক : —– সূফী প্রভাব, ঢাকা ২০০৬
সৈয়দ মোস্তফা কামাল : সিলেটের মরমী সাহিত্য, লন্ডন ১৯৯৮
হরেন্দ্র চন্দ্র পাল : পারস্য সাহিত্যের ইতিহাস, কলিকাতা ১৩৬০