প্রচ্ছদ

স্ট্রেস, অসহিষ্ণুতা, দুর্নীতি, লোভ ও অস্থিরতা কেন?

  |  ০৮:৫০, ডিসেম্বর ০৭, ২০২০
www.adarshabarta.com

Manual2 Ad Code

:: শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ::

মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, মানুষের প্রয়োজন সীমিত কিন্তু তার লোভের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। পুঁজিবাদ ও ভোগবাদ যেমন নানা কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করছে, তেমনি বাড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের লোভ। এত স্ট্রেস কেন? কারণ আমরা ছুটছি। কখনও জীবনের প্রয়োজনে ছুটছি, কখনও লোভের পিছনে ছুটছি, কখনও বা মরীচিকার পেছনে। বেঁচে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন, সে প্রয়োজনগুলো আগেও ছিল। কিন্তু এখন সে প্রয়োজনের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও বিস্তার বেড়েছে; তৈরি হয়েছে নানা কৃত্রিম চাহিদা। পুঁজিবাদ ও ভোগবাদ তার প্রসারের জন্য, মুনাফার জন্য তৈরি করেছে কৃত্রিম চাহিদা – কোকা-কোলা, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি (সম্প্রতি এটির নাম গ্লো অ্যান্ড লাভলি করা হয়েছে), আইফোন, ফেসওয়াশ, বার্গার, হটডগ।

Manual4 Ad Code

মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, মানুষের প্রয়োজন সীমিত কিন্তু তার লোভের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। পুঁজিবাদ ও ভোগবাদ যেমন নানা কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করছে, তেমনি বাড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের লোভ।

কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশের যে কোনো গ্রামে গেলে দেখা যেত, একজন কৃষকের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন তিনবেলা খাবার, লজ্জা নিবারণের জন্য বছরে দু-চারখানা লুঙ্গি, বাজারে যেতে বা সামাজিক উৎসবে অংশ নিতে একটি বা দুটি জামা বা ফতুয়া। অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য কবিরাজ বা ডাক্তার আর অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য কয়েক বিঘা জমি, লাঙ্গল, গবাদি পশু ও লাঙ্গল-টানা কয়েকটি গরু। কৃষকের স্ত্রীর প্রয়োজন নিবারণের জন্যও ছিল ওই একই দেশজ ব্যবস্থাপত্র। শুধু শরীর আবৃত করার জন্য তার প্রয়োজন হতো অনাড়ম্বর, আয়তক্ষেত্রাকার ও সেলাইবিহীন একটি পোশাক, যার নাম শাড়ি। আর বিয়ে-শাদি ও উৎসবে রূপ রাঙাবার জন্য স্নো-পাউডার, চুলের ফিতা ও আলতা। গুহাবাসী মানুষের কথা বলি, প্রস্তর যুগ ও তাম্রযুগের মানুষের কথা বলি, কৃষিযুগ ও সামন্তযুগ অতিক্রম করে মানুষ যে নগরায়ন ও শিল্পায়নের যুগে উপনীত হয়েছে – সব যুগেই মানুষের মৌলিক চাহিদা একই ছিল, এখনও চাহিদাগুলো একই রকম আছে। এ চাহিদাগুলো হচ্ছে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, যৌনতা, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রজনন ও সুস্থ বিনোদন। মানুষ তার ইতিহাসের হাজার হাজার বছর কোকা-কোলা, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি, আইফোন, ফেসওয়াশ, বার্গার, হটডগ, মিল্ক শেক ছাড়াই পার করে এসেছে। আরও হাজার বছর মানুষ এগুলো ছাড়াই বাঁচতে পারবে। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বারবার বিজ্ঞাপন দিয়ে এমন অবস্থা তৈরি করছে যে মনে হয় পেপসিকোলা পান না করলে তৃষ্ণা নিবৃত্ত হবার কোনো উপায় নেই, ফর্সা হওয়ার একমাত্র মহৌষধ হচ্ছে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি। এবং একটি আইফোন বা আইপ্যাডের মালিক হতে না পারলে মানব জীবন ব্যর্থ!

মনে পড়ছে সেই চীনা বালকের কথা যে ২০১২ সালে একটি আইফোন ও আইপ্যাড কেনার জন্য তার কিডনি বিক্রি করে দিয়েছিল। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে চীনা পুলিশ সংশ্লিষ্ট দালাল ও ডাক্তারদের গ্রেফতার করে এবং কারাদণ্ড হয় সাত জনের। এর চেয়েও ভয়াবহ ঘটনা ঘটে পরের বছর, ২০১৩ সালে। এ বছর চীনের এক দম্পতির বিরুদ্ধে আইফোন ও বিলাসী পণ্য কিনতে তাদের কন্যাশিশুকে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। চীনের গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ডেইলি মেইল জানিয়েছিল, দেশটির সরকারি কৌঁসুলিরা অভিযোগ করেছেন, ঝাং ও তেং দম্পতি প্রায় ছয় লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের কন্যাশিশুকে বিক্রির জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। ইন্টারনেট, আইফোন ও অন্যান্য বিলাসী পণ্য কিনতে তারা এই টাকার সিংহভাগ খরচ করেছেন। ওই দম্পতির ব্যাংক হিসাব ও ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনেও এর প্রমাণ ছিল।

যদিও শিশু বিক্রির বিনিময়ে অর্থ গ্রহণের অভিযোগ অস্বীকার করেন ওই বেকার দম্পতি। তাদের দাবি, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যই শিশুটিকে অন্যের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন তারা। মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের কথা বলছিলাম। সেই হাজার বছর আগে যখন প্রথম সূর্য পুব আকাশে উদিত হয়েছিল, সেদিনও মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, যৌনতা ও চিকিৎসার প্রয়োজন হতো, এখনও হয়। কিন্তু পুঁজিবাদ ও ভোগবাদের জন্য মানুষের প্রয়োজনের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও ব্যাসার্ধ যেভাবে বিস্তৃত হয়েছে, তাতে মানুষের লোভ গেছে বেড়ে, জীবন হয়েছে জটিল ও স্ট্রেসফুল। ঢাকা শহরের একটি বিবাহিতা নারীর আজ বছরে কম করে হলেও ১০ থেকে ১৫টি শাড়ি প্রয়োজন– কোনোটি সুতির, কোনোটি তাঁতের, কোনোটি সিল্ক বা হাফ সিল্কের, কোনোটি মসলিন, কোনোটি কাতান, কোনোটি বাটিক, কোনোটি আবার জামদানি, বালুচরী অথবা সম্বলপুরী।

শুধু শাড়িতে মেয়েদের এখন বস্ত্র সংস্থান হচ্ছে না; কারণ, মেয়েরা এখন চলাফেরার সুবিধার জন্য সালোয়ার কামিজ পরেন। ফলে বছরে তার প্রয়োজন হয় আট থেকে ১০টি সালোয়ার কামিজ। একটু সৌন্দর্যপ্রিয় হলে একটি লেহেঙ্গা, একটি ঘাগরা, একটি স্কার্ট আর দেশবিদেশে ভ্রমণের সময়ে জিন্স-টি শার্ট ও ওড়না। এখন আবার অনেক মেয়ের মধ্যে হিজাবের চল হয়েছে। আর কত বাহারি ডিজাইনের যে হিজাব! কখনও কখনও মনে হয়, হিজাব পরিধান করে, না হিজাব প্রদর্শন করে? এই হিজাব সংস্কৃতির বিকাশের সাথে সাথে ব্যবসায়ীদের কপালে ভর করেছে বাণিজ্যলক্ষ্মী। প্রতি বছর হিজাবের বেচা-বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এদিকে বিজ্ঞাপন ও টিভি সিরিয়ালের সুবাদে পোশাক-আশাকের বাহারি নকশার প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনেও। সেবার ঈদে তো এক কিশোরী ‘পাখি ড্রেস’ না পেয়ে আত্মহত্যাই করে বসল।

শুধু নারীদের পোশাকের কথাই বা কেন বলছি? যে পুরুষের সারা বছর চারটি লুঙ্গি ও দুটি ফতুয়াতে চলে যেত, তারও কি চাহিদা বাড়েনি? বছরে কম করে হলেও পাঁচটা প্যান্ট পাঁচটা শার্ট, দুটি পাজামা পাঞ্জাবি, একটি স্যুট-কোট, একটি ব্লেজার, চারটা টি-শার্ট, একটি ফতুয়া, দুটি ট্রাউজার ও দুটি থ্রি কোয়ার্টার। এতদিন বিউটি পার্লারে গিয়ে মেয়েরা সাজ-গোজ করত। কিন্তু এখন ছেলেদেরও ‍কৃত্রিম চাহিদা এতটা বেড়েছে যে, তারা পার্লারে গিয়ে ফেসিয়াল করছে, চুল কালার করছে, দাড়ি ট্রিম করছে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, নারী ও পুরুষের ন্যূনতম যে প্রয়োজন, তার চেয়ে চাহিদা বেড়েছে অনেক গুণ বেশি। শুধু পোশাক-আশাক নয়, খাবার-দাবার, আসবাবপত্র, বাড়ির ফিটিংস, মোবাইল ফোন, গাড়ি, টেলিভিশন, ফ্রিজ, এসি, ল্যাপটপ, আইপ্যাড, অ্যাপার্টমেন্ট- সব কিছুতেই এখন নানা বৈচিত্র্য, নকশা, নখরামি ও বিলাসিতা।

Manual7 Ad Code

আগে প্রাচুর্য, অপব্যয়, ও বিলাসিতা ছিল রাজা-রানি ও জমিদারদের একচ্ছত্র এখতিয়ার। এখন পুঁজিবাদ ও ভোগবাদের কল্যাণে প্রাচুর্য, অপব্যয় ও বিলাসিতা ব্রাত্যজনের অধিকারে এসে গেছে। ফলে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ হয়েছে এবং হচ্ছে। পরিবেশ দূষণ ও তার সূত্র ধরে আবহাওয়া পরিবর্তন হচ্ছে, সেটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতির প্রতিশোধ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে করোনাভাইরাসের মতো মহামারি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের গতি কমানো না গেলে অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মানুষের প্রয়োজন মেটাতে বন-জঙ্গল যেভাবে উজাড় হচ্ছে, তাতে বন্য জন্তু ও পশু-পাখি বেশি বেশি করে মানুষের সংস্পর্শে এসে ঘন ঘন করোনার মতো মহামারি সৃষ্টি হবে।

এদিকে নগরায়ন, শিল্পায়ন, ও বিশ্বায়নের কারণে মানুষের জীবন হয়েছে আরামদায়ক কিন্তু যান্ত্রিক; প্রযুক্তিময় কিন্তু একাকী; গতিময় কিন্তু ব্যস্ত ও স্ট্রেসফুল। মানুষের কোনো অবসর নেই। মানুষ শুধু ছুটছে। বাড়ি ও ফ্ল্যাটের জন্য ছুটছে; অত্যাধুনিক মডেলের গাড়ির জন্য ছুটছে; সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার জন্য ছুটছে; তার চাই সর্বশেষ মডেলের মোবাইল ফোন, আইপ্যাড ও ল্যাপটপ; উইকএন্ডে তার প্রয়োজন আউটিং ও ভোগের সরঞ্জাম; তার চাই নিত্যনতুন পোশাক ও ভোগের সামগ্রী; কানাডার ‘বেগমপাড়া’য় তার সেকেন্ড হোম চাই।

এই এত চাই আর চাই, লোভ ও কৃত্রিম চাহিদার কারণে দুর্নীতি বেড়েছে, অপরাধ বাড়ছে, মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে, ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণ বাড়ছে, সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। মানুষকে প্রতিনিয়ত নিতে হচ্ছে নতুন নতুন স্ট্রেস বা চাপ, ফলে মানুষ অস্থির ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। নগরায়ন, শিল্পায়ন ও ভোগবাদের হাত ধরে যে আরাম ও জীবন সহজীকরণ ব্যবস্থা এসেছে, তার বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে এসেছে ডায়াবেটিস, ডিপ্রেশন ও ওবেসিটি। সঙ্গে আছে খাদ্যে ভেজাল ও পরিবেশ দূষণের কারণে ঊর্ধ্বমুখী কর্কট রোগ, পেট ও ফুসফুসের ব্যাধি। এ থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য দাওয়াই হচ্ছে লোভ ও কৃত্রিম চাহিদার পেছনে না দৌড়ানো; শিক্ষা ও সংস্কৃতির আলোতে উচ্চকিত কিন্তু সরল জীবন; প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস; পারিবারিক, সামাজিক ও বৈশ্বিক যুক্ততা এবং সর্বাপরি ভোক্তা হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে বাঁচতে শেখা।

Manual7 Ad Code

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Manual6 Ad Code

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code