প্রচ্ছদ

হাসনাত মুহ. আনোয়ার এর ঈদের বিশেষ রচনা

  |  ০৪:১৮, জুলাই ১০, ২০২২
www.adarshabarta.com

 

ঈদের বিশেষ রচনা:
[শুনুন বলি নতুন করে পুরান ঘটনা, ১৫ মে ২০১৮]

ইস্তাম্বুল সফর ও ক্ষনিকের সুলতান
— হাসনাত মুহ. আনোয়ার —

আমি তো প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম !
এতদুরের এই বিদেশ বিভুঁই তুরষ্কের ইস্তাম্বুলে এসে কী বিপদেই না পড়লাম ! কোন অপরাধ ছাড়াই এরা কী আমাকে নজরবন্দী করবে নাকি ? এদের মতলবটা কী ?
এ কেমন কথা !

বাংলার কোন এক পল্লী থেকে এই সুদুর বিলাত হয়ে সুলতানাতে তুর্কী ! তুর্কীর মুল্লুক। গিয়েছি তোপকাপি প্রাসাদ মিউজিয়াম দেখতে। সাথে রয়েছেন সফরসঙ্গী দুই বন্ধু। অটোমন সম্রাটের অর্থাৎ সুলতানদের শাহী প্রাসাদ- তোপকাপি প্যালেস । আবার কেউ কেউ বলেন-টপকাপি প্যালেস ।
এই সুলতানদের জগত জোড়া সুনাম যেমন আছে, দুর্নামেরও কমতি নেই। তাদের শাহী হারেমে নাকি দুনিয়ার তাবৎ বিজিত দেশ সমূহ থেকে সেরা সুন্দরীদের ধরে এনে বন্দী করে রাখতো সুলতানের মনোরঞ্জনের জন্যে। শুধু তাই নয়, হারেমে রাখা এই সেরা সুন্দরীদের সংখ্যাও নাকি হাজার খানেক। হেরেমেই প্রশিক্ষণ চলতো কিভাবে রাজকীয় ‘এটিকেট’ বা আদব কায়দা মেনে চলতে হয়, কিভাবে সুলতান ও বিদেশী ডিপ্লোমেটদের সামনে কথা বলতে হয়। সত্যমিথ্যা মিলিয়ে কত কথা অটোমন সুলতান ও তাদের রাজপ্রাসাদ টপকাপি/ তোপকাপি প্যালেস নিয়ে। হারেম বন্দী করে রাখা সুন্দরী ললনাদের উপর যাতে অন্য কারো নজর না পড়ে সেজন্য ও নিখুঁত ব্যবস্থা। কী সেই ব্যবস্থা ? এ আরও ভয়ঙ্কর ! আফ্রিকান এবং অন্যান্য দেশ থেকে সুন্দর ও সুঠামদেহী তরুণদের ধরে এনে খোজা অর্থাৎ নপুংসক বানিয়ে তবেই শাহী প্রাসাদে প্রহরী হিসেবে নিযুক্ত করা হতো। পুরুষত্বহীন করে দেয়ার ফলে শাহী মহলের সুন্দরীরা নিরাপদ বলে মনে করা হতো।এই খোজা বানিয়ে সুদুর ভারত বাংলাদেশ থেকেও খোজা বিক্রি করা হতো। তরুণ যুবকদের ধরে নিয়ে খোজা বানিয়ে যারা বিক্রী করতো এদেরকে বলা হতো খোজকর, সিলেটের স্থানীয় উচ্চারণে এরাই ‘কুসকর’ নামে আজো আতঙ্কজনক শব্দ। সিলেটে খোজারখলাসহ এ রকম খোজা যুক্ত স্থানের নামগুলো আজো সেই সাক্ষ্য বহন করছে বলে অনেকে মনে করেন।সে অনেক কথা, এখন থাক। অটোমন সুলতান ও তাঁর শাহী প্রাসাদ তোপকাপি নিয়ে এসব গল্পগুজবের সত্যতা যে ষোল আনা নয়, তার চেয়ে অনেক কম, এতে সন্দেহ নেই। তো শুরুতে যা বলেছিলাম:
শাহী প্রাসাদের মূল গেইট পেরুতে ‘মেটাল ডিটেক্টর’ দিয়ে যেতে হয়। মোবাইল, ক্যামেরা, সাথে থাকা হ্যান্ডব্যাগ সব মেশিনে পরীক্ষা করে তবেই ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা ! গেইট দিয়ে ঢোকার পরই দেখি আরও দর্শনার্থীদের কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে পার হতে হচ্ছে ! আমার সাথে থাকা ব্যাগে ছিল এক বোতল মিনারেল ওয়াটার ও কিছু সর্দি-হাঁচি ( হে ফিভার) নিরোধক ট্যাবলেট। ভাবলাম, যদি পানির বোতল বা ঔষধ জমা রেখে দেয়, তবে ঘন্টাখানেক ‘পানি বিহনে’ এই গরমে কিভাবে কাটাবো ? আজকাল বিমান বন্দর বা চেকিং পোষ্ট গুলোতে পানিও সন্দেহের তালিকায় ! কে জানে এ পানি যদি কোন কেমিক্যাল বা এসিড হয় ! তাই সফর সঙ্গী দুজনকে বললাম: আপনারা দুজন ভেতরে যান, আমি একটু পানি পান করে, আবার গেইটে ফিরে আসছি। ইতোমধ্যে আপনারা টিকেটের লাইনে দাঁড়িয়ে যাবেন। আমি লাইনে এসেই শামিল হবো। প্রায় দশ মিনিট পর আমি ফিরে আসলাম। তেমন সমস্যা হলোনা। আমার ব্যাগ বা পানির বোতল কিছুই আটকালোনা। ভেতরে গিয়ে লাইনে অবস্থানরত সঙ্গীদের সাথে মিলিত হলাম। ইতোমধ্যে হঠাৎ করে বেশ ক’জন সিকিউরিটি গার্ডের মতো পোষাক পরা লোক এসে আমাকেই হাত ইশারায় ডাক দিয়ে লাইন থেকে বেরিয়ে যেতে ‘আদেশ’ দিলো। আমিতো ভয় পেয়ে গেলাম !
টিকেট কাটার লম্বা লাইন থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলাম: কী সমস্যা ? তারা জবাব দিলো, আপনাকে আধঘন্টার জন্য আমাদের হেফাজতে নেয়া হলো ! এই আধঘন্টার জন্য একটি ফটো সেশনে অটোমন সুলতানের পোশাক পরে পোজ দিতে হবে। ফটোগুলোর কপি অবশ্য আপনাকে দেয়া হবে। আপনি আধঘন্টার অটোমন সুলতান ! আপনি চাইলে শুধু আপনার ছবি তুলতে পারবেন। আবার যদি চান তবে আপনার সাথে দুজন ‘হারেমবাসিনী’ সুন্দরীও ছবির পোজ দেবে আপনার ডানে ও বামে বসে। আমাদের হাতে সময় বেশী নেই, আপনার সিদ্ধান্ত অতি শীঘ্র আমাদের জানান। আপনার না বলার অধিকার নেই। তবে ‘হারেম সুন্দরী’ সহ অথবা এদের ছাড়া শুধু আপনার নিজের ছবি ‘সুলতানী’ পোষাকসহ তোলার … এই দুটির মধ্যে একটি বেছে নেয়ার অধিকার রয়েছে।
কীংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। আমার দুই সফর সঙ্গীর মধ্যে একজন তখনো টিকেট কেনার লাইনেই দাঁড়িয়ে আছেন। একজন আমার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাদের মধ্যে কোন দুশ্চিতা আছে বলে মনে হলো না। একজন বললেন, কী আর করবেন, প্রস্তাবটা তো মন্দ না! রাজী হয়ে যান। আধঘন্টার জন্য ফটো সেশনের তুর্কী সুলতান, মন্দ কী ? আমি ভয়ে ভয়ে ওদেরকে বললাম, দেখুন: যদি সম্ভব হয়, তাহলে আমাকে যেতে দিন। সিকিউরিটির মতো পোষাক পরা একজন বললো: আপনাকেই এ কাজের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে, ছেড়ে দেয়ার প্রশ্নই আসেনা। যতশিঘ্র রাজী হবেন, ততশিঘ্র ছাড়া পাবেন। আপনার একটা সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি, হারেমসুন্দরী সহ ফটো উঠাবেন, নাকি এদের ছাড়া ? উপায়ন্তর না দেখে আমি জবাব দিলাম, আমি হারেম সুন্দরী চাইনা। আমাকে যদি ছবি ওঠাতেই হয়, তবে তা হবে শুধু আমার নিজের। লক্ষ্য করলাম, তাদের মূখে হাসি ফোটে উঠলো। তারা বললো: তবে তা ই হোক। দেরী না করে শীঘ্র চলুন। আমাকে নিয়ে পাশের একটি শাহী মহলে প্রবেশ করলো। এটি অনেকটা বিদেশী মেহমানদের সাক্ষাৎদানের জন্য সুলতানের নির্ধারিত কামরার মতো সাজানো। আমরা অর্থাৎ পাঁচ ছয়জন সিকিউরিটি গার্ড এবং আমার সফর সঙ্গী ইবনে বতুতা যখন ঐ মহলে প্রবেশ করলাম, মহলে অবস্থানরত আরও তিনজন মহিলা এবং চারজন পুরুষ নাটকীয় কায়দায় সারিবেঁধে দাঁড়িয়ে ‘মেরহাবা, মেরহাবা’ ( মারহাবা নয়, ওরা মেরহাবা ই বলে) বলে অভ্যর্থনা জানালো। একজন ঐতিহ্যবাহী কায়দায় সারা হলরুম জুড়ে গোলাপপানি ছিটিয়ে আনন্দধ্বনী দিলো। সুঘ্রানে সারা হলরুম মোহিত হয়ে উঠলো।
প্রথমে যে কামরায় প্রবেশ করলাম সে কামরাটি বেশ প্রশস্ত। অত্যন্ত জাকজমকপুর্ণ সাজসজ্জা কামরাটিতে। এর পাশেই আরেকটি ছোট কামরা। একজন হারেম সুন্দরী আমার সামনে এসে বললো: ‘প্লিজ ফলো মি, টু চ্যুজ ইয়ুর এট্যায়ার’। অর্থাৎ ‘আমার সাথে পাশের কামরায় আসুন, আপনার পোষাক পছন্দ করবেন।’ আমার সফরসঙ্গী ঝানু পর্যটক ইবনে বতুতার দিকে তাকালাম। তিনি মাথা কাত করে ইশারায় আমাকে যেতে বললেন। পাশের কামরায় গিয়ে দেখি এক বিশাল ওয়ার্ডরোব ‘সুলতানী’ পোশাকে টইটুম্বুর। শুধু তাই নয়, আরও কয়েকজন ‘হারেমসুন্দরী’ হাতে নানা রঙের পোষাক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ! আমি একটা লম্বা আলখাল্লা জাতীয় পোষাক ও একটা শিরস্ত্রাণ বা মাথার মুকুট পছন্দ করলাম। দুজন হারেমসুন্দরী আমার পরনের স্বাভাবিক পোষাকের উপরেই ‘শাহী পোষাক ও মাথার মুকুট’ পরিয়ে দিয়ে বললো ‘আসুন আমার সাথে।’ পুর্বের সেই খাস কামরায় চলে এলাম। তিনচারজন বসার উপযোগী একটা সোফায় মধ্যখানে আমাকে বসতে বললো। চা খাবো, না কফি খাবো জানতে চাইলো একজন। আমি বললাম- চায়ের দেশ সিলেটের সন্তান আমি। আধঘন্টার সুলতান হলেও আমার জন্য চা ই চাই।
অতি ব্যস্ততার সাথে দুইপাশে আগে থেকেই ফিট করে রাখা ক্যামেরা সচল হয়ে উঠলো। একজন আমার হাতে একটি শাহী ফরমান দিয়ে পড়তে বললো। পড়া তো নয়, পড়ার অভিনয়। মিনিট খানেকের মধ্যে এ ছবির পোজ দেয়া শেষ হলো । সাথে সাথে একজন নিয়ে এলো কারুকার্যময় খাপে রাখা তরবারি। এরপর এলো চা। দুধছাড়া আপেলের সুগন্ধযুক্ত চা। খুব বেশী না হলেও কিছুটা টেনশন তো ছিলোই। পান করতে লাগলাম সেই সুগন্ধী চা। ছবি উঠানো চলতেই থাকলো। চা শেষ হলে একজন নিয়ে এলো একটা তাসবীহ। একটি একটি করে তাসবীহ, তরবারি, চায়ের কাপ, শাহী ফরমান আমার হাতে দেয়, আর দেখিয়ে দেয় কিভাবে পোজ দিতে হবে । এরা যেভাবে দেখায়, আমি সেভাবেই পোজ দেবার চেষ্টা করি। ঠিকমতো পোজ না হলে আবার দেখিয়ে দেয় কিভাবে পোজটা দিতে হবে। আর আমি বার বার ঘড়িতে টাইম দেখতে থাকি। কতক্ষণে শেষ হবে আধঘন্টার সুলতানী ! আমাকে ঘিরে আটদশজন নারীপুরুষ… এ এক অসহ্য যন্ত্রণা ! শেষ পর্যন্ত শেষ হলো আধাঘন্টা । আমি যেন হাঁফছেড়ে বাঁচলাম ।
আমাকে পাশের কামরায় নিয়ে গেলো সুলতানি পোষাক ছাড়ার জন্য। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, ইবনে বতুতা (বন্ধুবর লেখক ইলিয়াস আলী) ঐ কামরার একপাশের একটি কাউন্টারে টাকাপয়সার লেনদেন করছেন। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকী হাসছেন। এতক্ষণে বিষয়টা আমার কাছে পরিষ্কার হলো। ‘আধঘন্টার সুলতান-টুলতান’ এসব কিছুইনা। সবই টাকার খেলা। আমার অজান্তে মিষ্টার ইবনে বতুতাই এ সব কিছুর আয়োজন করেছেন ! আমাকে ঘুনাক্ষরেও জানতে দেননি। শুধু আমিই নই, উপযুক্ত টাকা দিলে যে কেউই এ রকম সুলতানি পোষাক পরে ছবি উঠাতে পারে। বন্ধুকে শুধু বললাম: আমাকে নিয়ে এ ষড়যন্ত্রের মানে কী ? তিনি জবাব দিলেন: ষড়যন্ত্রের সবে তো শুরু । ষড়ঋতু মানে যদি ছয়টা ঋতু হয়, তবে ষড়যন্ত্রের ও ছয়টি পর্ব হতে বাধ্য। সবে তো একটি শেষ হলো। আরো পাঁচটি ‘যন্ত্র’ এখনও বাকী। এই বলতে বলতে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। শুরু হলো আমাদের তোপকাপি প্রাসাদ যাদুঘর ঘুরে দেখা ।
আর হ্যাঁ, আমাদেরকে সবগুলি ছবির একটি করে কপি সমেত একটি সিডি এবং একটি প্রিন্টেড ছবির কপি দেওয়া হলো। প্রচন্ড সাসপেন্স সহ ছবিগুলো মন্দ হয়নি। তুরষ্ক ভ্রমণের স্মৃতি হিসেবে ছবিগুলো সাক্ষী হয়ে রইবে অনাগত সময়ের জন্যে। প্রকাশ্যে একটু রাগ বা বিরক্তি দেখালেও মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম আমার সফর সঙ্গী দু’জন বন্ধুকে।
জয় হোক তুরষ্ক সুলতানের,
জয় হোক হারেম বালাদের,
জয় হোক বন্ধুত্বের।
▪️
তুরষ্ক সফরের বিস্তারিত রয়েছে, এখানে:

ইস্তান্বুল মহানগরী ও তুরষ্কে
কী দেখবেন:
https://www.facebook.com/100001595849162/posts/1905004376229405/?d=n

হাসনাত মুহ. আনোয়ার,

@ kakonfokir.com