প্রচ্ছদ

করোনা-উত্তর অর্থনীতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ

  |  ১৫:৪৩, আগস্ট ০৮, ২০২০
www.adarshabarta.com

Manual6 Ad Code

:: মোঃ নাসির ::

Manual6 Ad Code

করোনা নিয়ে আলোচনার শেষ হলো না। আর হবে বলেও মনে হচ্ছে না। যে সময় করোনা মোকাবিলার মোক্ষম হাতিয়ার ভ্যাকসিন মানুষের নাগালে একেবারে আসি আসি করছে, সে সময়ও বিশেষজ্ঞ অনেকের মুখে হতাশা ব্যক্ত হতে দেখা যায়-মানবসমাজকে করোনা সঙ্গী করেই চলতে হবে ভবিষ্যতেও?
করোনা নিয়ে কত রকমের যে কথা, তার শেষ নেই। প্রথমে ছিল কেবলই আতঙ্ক। মৃত্যু আতঙ্ক। আজ কতজন মারা গেলেন। কতজন আক্রান্ত হলেন। কোন দেশে বিশ্ব অতিমারি করোনার কী অবস্থা। শনাক্ত আর মৃত্যুহার। কী হবে মানুষের? মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎই-বা কী? চলমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থাকবে না বদলে যাবে; নতুন কোনো ব্যবস্থা পুরোনোর জায়গা নেবে? শিক্ষার ভবিষ্যৎ দাঁড়াবে কী? সব স্কুল-কলেজ বন্ধ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা খুলবে তো? আবার কি ছাত্রছাত্রীর কোলাহলে মুখর হয়ে উঠবে স্কুল প্রাঙ্গণ? মানুষের বোধ-বুদ্ধি-বিবেক কি করোনাভাইরাসে শেষ হয়ে যাবে?
নানা প্রশ্ন। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরেকটু ভিন্নরূপ। ঠিক পুরোনো প্রবাদ : ‘কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ’ এ রকম। করোনাভাইরাস কারো কারো জন্য দুর্নীতির মহোৎসব হয়ে এসেছে। খাটের নিচে ত্রাণের মাল। মাটির নিচে ত্রাণের চাল। কোনো পুকুরের তলদেশ যদি উষ্ণ হয়ে উঠত, দেখা যেত সব মাছ ভেসে উঠছে। মানুষ মাছ ধরার মহোৎসবে মেতে উঠত। করোনাকালেও তেমনি মানুষের দুর্ভোগ পুঁজি করে দুর্নীতির মহোৎসবে মেতেছে একশ্রেণির মানুষ। মানুষের জীবনকে জিম্মি করে এমন দুর্নীতি ইতিহাস আগে আর কখনো দেখেনি। একজন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেবল সোচ্চার। আর দেশটাজুড়েই উপরে বসা সুবিধাভোগী মানুষগুলো মনে হয় দুর্নীতির পক্ষে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। এই করোনাকালে মানুষ যখন জীবন নিয়ে দিশেহারা, একদল দুরাচারি তখন নাক-মুখ ডুবিয়ে দুর্নীতি করে চলেছে। তার জিরো টলারেন্সের আহ্বান দুর্বৃত্তরা কানেই তুলছে না। যেন ‘কারো ঘরে আগুন লাগে আর কেউ আলু পোড়া খায়’। ঝড়-বন্যায়, জলোচ্ছ্বাস-করোনায় মানুষের দুর্ভোগ যত বৃদ্ধি পায়, দুর্নীতিবাজদের যেন তত পোয়াবারো।
করোনাকালে সবকিছু নিয়েই দুর্নীতি দেখা যাচ্ছে, হাসপাতালে চিকিৎসা, সুরক্ষাসামগ্রী, ওষুধ, খাবার, করোনা মুক্তির সার্টিফিকেট, মানুষের জীবন এবং দেশের সুনাম-কোনোটাই দুর্নীতির বাইরে নেই। কোনো একজনের সদিচ্ছা বা অঙ্গীকার যে সব শুভ কাজ হওয়ার শর্ত নয়, বারবার সে কথাই প্রমাণিত হচ্ছে।
সে কথা যাক। আজকের এ সম্পাদকীয়ের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলা নয়। করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়েও নয়। চারদিকে এখন করোনা প্রতিষেধক ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের সাফল্যের খবর পাওয়া যাচ্ছে। আমরা জানি, বিপদ আসে আবার বিপদ চলেও যায়। আজকের মহামারি করোনাভাইরাসও একদিন চলে যাবে লাখ লাখ মানুষের জীবন নিয়ে। করোনাই মানবসভ্যতার শেষ কথা নয়। সকল যুগে, সকল কালে মানুষ সব দুর্যোগ-দুর্ভোগ মোকাবিলা করে অগ্রসর হয়েছে। সভ্যতার চাকা কখনো পেছনে যায়নি। তাহলে আর আজকের আলোকিত এই সময়ে পৌঁছাতে পারতাম না। করোনাকে সঙ্গী করে হোক কিংবা করোনাকে পরাভূত করে হোক, মানুষ এগিয়ে যাবেই।
মানুষের এই এগিয়ে চলার পেছনে নানা আবিষ্কার এবং সাফল্যের পাশাপাশি অর্থনীতিও সমভাবে ভূমিকা রেখেছে। শুধু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সুফল নিয়ে সভ্যতা এ পর্যায়ে আসতে পারত বলে মনে হয় না। এসবের পেছনে অতি সাধারণ মানুষ কায়িক শ্রম, বেঁচে থাকার লড়াই থেকে মাঠের কঠিন মাটি কর্ষণ করে ফসল ফলিয়েও অর্থনীতিকে পুষ্ট করেছে। বিজ্ঞানের বড় বড় আবিষ্কারের পাশাপাশি কৃষক-শ্রমিকের ঘামও কম বড় ভূমিকা রাখেনি। কমিউনিটি বা সম্প্রদায়ভিত্তিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসা বা বাণিজ্য প্রয়াসও তারই ফসল।
অলিগলির মুদির দোকান, হাট-বাজারের খোলা দোকান কিংবা আজকের বড় বড় শহরের ডেলি গ্রোসারি ছোটখাটো, কুটিরশিল্প ছোট-বড় অর্থনীতির সব দেশেই বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। এই সম্প্রদায় বা কমিউনিটি-ভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্যও একটি দেশের সার্বিক অর্থনীতির অবস্থার ইঙ্গিত দেয়। আজকের সময়ে মাইক্রো অর্থনীতি সার্বিক অর্থনীতির নিয়ামক শক্তিও। মূল অর্থনীতির মেরুদণ্ডও মনে করা হয়।
করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯-এর অভিঘাতে অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের জীবন নিয়েই করোনা শান্ত হচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিকেও যেন স্থবির করে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি সবকিছুকেই পঙ্গু করে দিয়েছে। এসব ক্ষতির মধ্যে অন্য ক্ষতি যত দ্রুত পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়, অর্থনীতির ক্ষেত্রে অত সহজে সম্ভব হয় না। সে কারণে বাংলাদেশ-আমেরিকাসহ বিশ্বের দেশে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করার তাগিদ লক্ষ করা যায় অনেকটা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও। এ কারণে রাষ্ট্র পরিচালকদের দেশের নাগরিক-বুদ্ধিজীবীদের কম সমালোচনা সইতে হচ্ছে না। জীবন আগে না জীবিকা আগে-প্রবলভাবে এ প্রশ্ন উঠছে। জীবন না থাকলে কোনো কিছুই আর জীবনের প্রয়োজনে লাগে না। কিন্তু জীবন থাকলে জীবিকা ছাড়া চলে না। জীবনের জন্যই মানুষের সকল কর্মযজ্ঞ। সে কারণে অর্থনীতিকে চাঙা করে তোলা জরুরি হয়ে পড়ে।
তবে করোনাভাইরাস ছোট ও মাঝারি ব্যবসার মাজা এমনভাবে ভেঙে দিয়েছে যে সেখান থেকে উত্তরণ ঘটানো এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত, বাঙালি মালিকানাধীন ছোট, মাঝারি ব্যবসা পরিস্থিতি খুবই শোচনীয়। এ নিয়ে ব্যবসায়ী মহল, কমিউনিটির নেতাদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ লক্ষ করা যায়। ছোট ছোট ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে সবাই চিন্তিত। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে কত সময় অপেক্ষা করতে হবে এবং তত দিনে সবাই অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবে কি না, তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই সংশয় রয়েছে।
এই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সমর্থন ও সহযোগিতা লাগবে। বাঙালিরা লড়াকু জাতি। তাদের প্রবাসজীবনে সাফল্যের পেছনেও রয়েছে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাস। তবে করোনাসৃষ্ট সংকট উত্তরণ কারো একার লড়াইয়ে সম্ভব হবে বলে অভিজ্ঞজনেরা মনে করতে পারছেন না। কোনো সরকারের সাপোর্টেও সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। সকল মহলের সম্মিলিত সহযোগিতা এবং সহমর্মিতা অতি জরুরি। শ্রমিক-মালিক, সংশ্লিষ্ট সকল মহল, সরকারি-বেসরকারি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সাহস ও সহযোগিতাও দরকার। সরকারকে সব ধরনের প্রণোদনা দিয়ে ছোট, ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, বর্তমান এই দুঃসময়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের হতাশা কাটিয়ে তাদের উঠে দাঁড়াতে সাহস জোগাতে হবে। তাদের স্বপ্ন জাগিয়ে তুলতে হবে। হতাশায় নিমজ্জিত মানুষের সামনে সম্ভাবনা তুলে ধরে তাদের উজ্জীবিত করে তুলতে হবে। জীবনের জয়গান গাইতে হবে : ‘মোরা ভয় করবো না ভয় করবো না/দুবেলা মরার আগে মরবো না ভাই মরবো না।’

লেখক: সাংবাদিক, নিউ জার্সি, আমেরিকা।

Manual4 Ad Code

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code