প্রচ্ছদ

শিক্ষানুরাগী মরহুম মাওলানা এ টি এম ওলিউর রহমান

  |  ০৮:১১, জুলাই ১২, ২০২০
www.adarshabarta.com

:: মিজানুর রহমান মিজান ::

এ জগতে একটি শিশু জন্ম লাভ করা মাত্রই ধরে নেওয়া যায় মৃত্যু তার চরম ও শেষ পরিণতি “ স্যার জেমস্ জীন’র উক্তির সহিত সঙ্গতি রেখে বলতে গেলে বলা যায় ”, “ জন্মিলে মরিতে হবে , অমর কে কোথা কবে” ? আবার ফ্রান্সিস বেকনের মতে “ জন্মের মতো মৃত্যু ও প্রাকৃতিক ”। এ অবিনশ্বর পৃথিবীর বুকে প্রাণী মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। জন্মের সাথে মৃত্যুর এক গভীর মিতালী বা বন্ধন বলা যায়। একের সাথে অপরের , গাছের সাথে লতার পিরিতিসম। জন্মিলে মৃত্যু অবধারিত। সুতরাং তা থেকে রেহাই প্রাপ্তির আশা করা অবান্তর। স্রষ্টার এ সৃষ্ট জগতে আঠার হাজার মাখলুকাতের মধ্যে স্রষ্টা মানুষকে শ্রেষ্টত্ব প্রদান করেছেন মানুষের জ্ঞান , বুদ্ধি , বিবেক , বিবেচনা , মেধা , প্রজ্ঞা ইত্যাদির সম্বন্বয় প্রদানের মাধ্যমে। মানুষের অমরত্ব লাভের সুযোগ নেই। কিন্তু মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত গুণাবলীর মধ্য দিয়ে তার কর্মকান্ডের মাধ্যমে দীর্ঘ দিন মানব মনে স্থান করে নেয়ার সক্ষমতায় অমর হয়ে থাকেন। বলছিলাম মাওলানা অলিউর রহমান’র কথা। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী। যার প্রমাণ আমরা পাই তিনির অক্লান্ত পরিশ্রম , মেধা ও তীক্ষ্ণ ধী শক্তির পরিচয় সমৃদ্ধ তেলিকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এলাহাবাদ আলিম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আজ এখান থেকে শিক্ষা অর্জন করে অনেকে হয়েছেন প্রতিষ্ঠিত সমাজে।

যাক আসছি মুল প্রসঙ্গে মাওলানা ওলিউর রহমান জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ১ জুলাই বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চী ইউনিয়নস্থ তেলিকোনা গ্রামে পিতা মরহুম মোশাররফ আলী ও মাতা মরহুমা তেরাবান বিবি দম্পতির ঔরসে। নিজ গৃহে পিতামাতার তত্ববাবধানে স্থানীয় মক্তবে কুরআন শিক্ষাসহ প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন কান্দিগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সে সময় বিশ্বনাথের আলেম শিরমণি মরহুম মাওলানা গোলাম হোসেন প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হন সৎপুর কামিল মাদ্রাসা। যে ক’জন ছাত্র নিয়ে সৎপুর মাদ্রাসার যাত্রারম্ভ হয় মরহুম মাওলানা ওলিউর রহমান তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন। অর্থ্যাৎ সৎপুর মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাকালীন ছাত্র হচেছন মাওলানা ওলিউর রহমান। আর এ মাদ্রাসা থেকেই ১৯৬৭ সালে মাওলানা ওলিউর রহমান কামেল পাশ করেন। তিনির ওস্তাদ মাওলানা গোলাম হোসেনের নির্দেশনায় বুরাইয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠালগ্নে এ মাদ্রাসার মুতামিম হিসেবে যোগ দেন। এক বৎসরের মাথায় ১৯৬৮ সালে বুরাইয়া মাদ্রাসাকে দাখিল পর্যন্ত উন্নীত করেন এবং ঐ বৎসরই যুগল জীবনে আবদ্ধ হন। অর্থ্যাৎ বিয়ে করেন সিলেটের একজন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ সৎপুরের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব মরহুম গোলাম হাফিজ এর প্রথমা কন্যা মোছাম্মৎ রাবেয়া আক্তারের সহিত পরিণয় সুত্রে হন আবদ্ধ । সাংসারিক জীবনে পা দিলে ও জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা মোটেই বাধাগ্রস্থ করতে পারেনি।তিনির আগ্রহ ও উৎসাহে অভিভুত হয়ে সিলেটের খ্যাতিমান মুফতি সামছুল হক ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হবার অনুপ্রেরণা যোগালে ওলিউর রহমান তা গ্রহণে হয়ে উঠেন অতি উৎসাহী। ওলিউর রহমান ভাবতেন “ শিক্ষাই হচেছ মানুষের শক্তি। ভাষার মাধ্যমেই সেই শিক্ষা সম্ভব হয় ” ড: মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ’র এ উক্তির পাশাপাশি প্রখ্যাত ব্যক্তি কুপারের “ জীবনের ব্যাপক সময় ধরে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। শিক্ষার শেষ নেই ” মন্তব্যকে অনুসরণ ও লালন করেই ভর্তি হন ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার ফিকাহ বিভাগে। ফিকাহ বিভাগে কামিল পরিক্ষায় ১৯৬৮-৬৯ তিনি তারঁ মেধা ও পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল অর্জনে সক্ষম হন। এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই মাওলানা ওলিউর রহমানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বনফুলের সে বিখ্যাত উক্তি অত্যন্ত ফলপ্রসু। বনফুলের সে উক্তিটি হচেছ “ সমাজের কল্যাণে মানুষ নামক ব্যক্তিটির ব্যক্তিত্ব যে উপায়ে সম্যকরুপে বিকশিত হয় তার নামই শিক্ষা।” বাক্যটি পুরোপুরি ওলিউর রহমানের জীবনে সফল বাস্তবায়নের পরিচয় আমরা পাই। এদিকে ১৯৬৯ সালে মাওলানা ওলিউর রহমানের অক্লান্ত পরিশ্রমে বুরাইয়া মাদ্রাসা দাখিল স্বীকৃতি লাভ করে এবং ১৯৭০ সালে আলিম ক্লাস খোলার ব্যবস্তা তিনি গ্রহণ করেন।

ছাত্র জীবনেই মাওলানা ওলিউর রহমানের মনে রেখাপাত করে পরোপকার , সমাজ হিতেশী কর্মকান্ড , মানুষকে শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তোলা। এ সকল কাজের পরিচয় আমরা বিভিন্ন সময় পেয়েছি তিনির জীবনালেখ্য পর্যালোচনায়। তিনির সংস্পর্শে যিনি গমণ করেছেন তাঁকে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন , অনুপ্রাণিত করেছেন পরামর্শ ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে। বুরাইয়া মাদ্রাসার সফলতা ও অগ্রযাত্রার পাশাপাশি তিনি নিজ এলাকা নিয়ে ও ভাবতেন আন্তরিক সুহৃদ্যতা নিয়ে। তার উজ্জল প্রমাণ তিনি পাখিচিরী নিবাসী মরহুম সাজিদুর রহমান ও নিজ গ্রামের অধিবাসী হাজী হুসিয়ার আলীর সার্বিক সহযোগিতা এবং এলাকাবাসীর উৎসাহে স্থানীয় গণ্যমান্য মুরবিবয়ানদের নিয়ে নিজ গ্রাম তেলিকোনায় , “ তেলিকোনা ফুরকানিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা ” প্রতিষ্ঠা করে তা বিভাগীয় মঞ্জুরী লাভ করান। ১৯৭০ সালে নিজ বাড়িতে তাঁর পিতা মরহুম মোশাররফ আলীর নামানুসারে “ মশরাফিয়া এইডেড বালিকা বিদ্যালয় ” স্থাপন করে শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা এলাকায় নারী শিক্ষার দ্বার উম্মোচন করেন। কিন্তু ১৯৭১ সালে শুরু হয় আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নিজ গ্রামের মরহুম তমিজ উল্লাহ্ সাহেব ভুমি দান করলে তিনি উক্ত ভুমিতে একটি অবৈতনিক প্রাইমারী স্কুল স্থাপন করেন , যা পরবর্তীতে তেলিকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রুপে স্থায়িত্ব পায়। এখানে একটি কথা উল্লেখ করতেই হয়। ১৯৭২ সালে শিক্ষা বিভাগের নির্দেশে মশরাফিয়া এইডেড বালিকা বিদ্যালয় ও তেলিকোনা অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় – এ দু’শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একীভুত হয়ে তেলিকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

ভালকি আলী নগরের আলহাজ আব্দুন নুর মাষ্টারের সুদৃঢ আন্তরিকতা , আর্থিক সহযোগিতা , দৌলতপুরের সুফী হাবিবুর রহমানের নির্দেশে ’৭৩ সালে “ তেলিকোনা ফুরকানিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসার ইবতেদায়ী শাখার কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে মাদ্রাসার নামে আংশিক পরিবর্তন এনে “ জামেয়া-এ-ইসলামিয়া তেলিকোনা মাদ্রাসা ” নামকরণ করে দাখিল পর্যন্ত উন্নীত করেন। ১৯৮১ সালে এ প্রতিষ্ঠানে এসে যোগদান করেন সিলেটের অন্যতম এক শিক্ষাবিদ মাওলানা কাজী শাহেদ আলী সুপার হিসেবে। এখানে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা না বললে মাওলানা ওলিউর রহমানের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় প্রস্ফুটিত হচেছ না এবং তা পাঠকদের অজানা , অজ্ঞাত থেকেই যাচেছ বিধায় আমি এক নগণ্য কিছু লিখতেই হয় অথবা সংযোজিত করা অত্যাবশ্যক।

আমাকে ১৯৮০ সালে মাওলানা এ টি এম ওলিউর রহমান সাহেব মাদ্রাসায় শিক্ষক রূপে নিয়োগ দিয়ে কৃতার্থ করেন এবং এ সময় তিনির সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল। তাহলে এবার এখানে সে ইতিহাসটুকু তুলে ধরা বাঞ্জনীয়। ১৯৭৯ সালে আমি এইচ এস সি পরীক্ষার্থী। মদন মোহন কলেজের নৈশ বিভাগের ছাত্র। লেখাপড়ার পাশাপাশি আমি সিলেট সাবরেজিষ্টারী অফিসে নকল নবীশ হিসেবে নিয়োজিত। সে সময় পঠিত উত্তর বিশ্বনাথ উচচ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা এডভোকেট ছাদ উদ্দিন খান আমাকে উত্তর বিশ্বনাথ উচচ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের জোর প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু আমি আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের পাশে চেয়ারে বসতে , শিক্ষক রুপে কাজ করতে মোটেই ইচছুক ছিলাম না বিধায় অত্যন্ত বিনয় ও দৃঢ়তার সহিত তা আমি প্রত্যাখান করি। কিন্তু উকিল সাহেব তা মানতে নারাজ। আমি তখন নিরুপায় হয়ে আশ্রয় নিলাম সুহৃদ দু’জনের। তাঁদেরকে বললাম আমার কোন বদনাম করে হলে ও আমাকে উকিল সাহেবের নিকট থেকে নিষ্কৃতি দানের পন্থা বের করতে। সুহৃদদ্বয় তিন দিন পর জানালেন অক্ষমতা। ইত্যবসরে উকিল সাহেব আমার তিনজন সহকর্মীকে ও জানালেন যে মিজান ঐ চাকুরী ছেড়ে শিক্ষকতায় চলে যাবে এক তারিখ থেকে তার বেতন ধরা থাকবে যদি ও আজ ১০ তারিখ এ মাসের চলছে। এ সকল কথাবার্তা শুনে আমি প্রস্তুতি নিতে লাগলাম চাকুরীতে ইস্তফা দিতে যেহেতু আমি নিশ্চিত , অভয় ও নিরাপত্তা প্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখছি। কারন তিনি বার বার তাগাদা দিচিছলেন ইস্তফা প্রদান করে যোগদান করার। তাই আমি সকল কাজকর্ম সমাপনান্তে চাকুরীতে ইস্তফা প্রদান করে যখন তিনির সম্মুখে হাজির হলাম , তখন তিনি আমাকে জানালেন আরো ছয় মাস পর যোগদান করতে। অস্ফুট স্বরে শুধু বলেছিলাম উকিল সাহেবকে, কি অপরাধে আমি গরিবের চাকুরী পরিত্যাগ করালেন। আমার উপায় কি , কেন আমাকে এত বড় শাস্তি। পাঠক লক্ষ্য করুন যেখানে অর্থনৈতিক দৈন্যতা আমাকে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাচেছ , লেখাপড়া বিঘ্নিত হচ্ছে।সেক্ষেত্রে আমার চাকুরী ইস্তফা দিয়ে কি নিদারুণ ও নি:সহ যাতনায় পিষ্ঠিত হচিছ তা এক মাত্র ললাট লিখক ভাগ্য নিয়ন্তাই জ্ঞাত। তিনির উত্তর শ্রবণে আমি কিংকর্তব্য বিমুঢ়। আমি জীবিত না মৃত তাই অনুধাবন করতে হিমশীম খাচিছলাম। সেদিন আমি শুধু ভাবতেই থাকি আমার কি অপরাধ , এ কেমন করে সম্ভব। বার বার আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকি এবং বিচার প্রার্থী হই, হে আল্লাহ জীবনের প্রারম্ভিক সময় এ কোন অদ্ভুত আচরণের মায়াজালে , পরিক্ষায় ফেললে তুমি। এদিন আমি কি কি করেছি পরবর্তী সময় তা বলে বুঝাতে পারব না। আমার এটুকু মাত্র স্মরণ আছে আমি কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে বেরিয়ে সুরমা মার্কেটের দিকে অগ্রসর হচিছলাম। রাস্তার মধ্যখানে নাকি আমি দাড়িয়ে পড়ি। চলন্ত গাড়ি আমাকে পিষ্ট করছে দেখে অজ্ঞাত একজন পথিক ধাক্কা দিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে নেন। তিনি ফুটপাতে নিয়ে আমাকে অনেক প্রশ্ন করেন। যেমন বাপু তোমার কি হয়েছে , তুমি যে এখন গাড়ির নিচে প্রান দিচিছলে ইত্যাদি। আমার মুখ থেকে কোন কথাই বের হচিছল না। শুধু ডাগর চোখে তিনির প্রতি তাকাচিছলাম। অনেকক্ষণ আমাকে অনেক মুল্যবান পরামর্শ দিয়ে চলে যান। আমি সিলেট শহর ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যায় কলেজের ক্লাসে যোগ দিয়ে বাড়ি অভিমুখে আসার লক্ষ্যে সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে আসি। ষ্টেশনে আগমণ করতেই আমার এলাকার পূর্ব পরিচিত কবির আহমদ কোববার আমাকে জানালেন মাওলানা ওলিউর রহমান আমাকে খুজছেন। মাওলানা ওলিউর রহমান আমার এলাকার অধিবাসী হলে ও তখন পর্যন্ত আমি তিনিকে চিনি না , সরাসরি আমাদের মধ্যে পরিচিতি বা আলাপ পরিচয় হয়নি। কিন্তু আমি তিনির নাম শুনেছি একজন বিশিষ্ট আলেম হিসেবে। কুববার ভাইয়ের কথা শুনে আমি আরো দ্বিধা ও সংশয়ে পড়ে গেলাম একজন বিশিষ্ট আলেম আমার মত একজন নগণ্য তরুণকে খোজ করার কারন কি থাকতে পারে। এমনিতেই ঐদিন আমি বিপর্যস্থ , বিধস্থ গভীর শংকায় শংকিত। হতাশার কালোমেঘ আমাকে ঘিরে ধরে অত্যন্ত আবেগ তাড়িতে। তাড়াতাড়ি একটি সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে নিলাম। যেহেতু সিগারেটের আসক্তি আমার বরাবরই। মিনিট সময়ের ব্যবধানে হঠাৎ কুববার ভাই বলে উঠলেন মিজান ঐতো মাওলানা ওলিউর রহমান আসছেন। হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি অত্যন্ত আকর্ষনীয় চেহারা সম্বলিত সাদা পাজামা পাঞ্জাবী , টুপি পরিহিত মাওলানা সাহেব এগিয়ে আসছেন অতি ধীর পদক্ষেপে। কাছে এসেই আমার হাত ধরলেন আদুরে প্রীত স্নেহাস্পদে বোধগম্য হল আমার । ভাবলাম তিনি আমাকে চিনেন। শুধালেন কুববার ভাইকে চল রেলওয়ে কেন্টিনে। আমি ভাবতে লাগলাম আমার জন্য কি পরিক্ষা অপেক্ষা করছে। তাছাড়া অদ্যকার ঘটনা আল্লাহ ছাড়া কোন মানবকে এ পর্যন্ত আমি বলিনি। ভীষণ চিন্তায় চিন্তিত হয়ে তিনির সাথে এগিয়ে চললাম কেন্টিন অভিমুখে।

চা পানের সাথে মাওলানা সাহেব শুধালেন , “মিজান আমি তোমার সব ঘটনা অবগত হয়ে সারাটি দিন অনুসন্ধান করছি তোমাকে। তুমি হতাশ হইও না। চল আমার সঙ্গে আমার মাদ্রাসায় শিক্ষক রুপে”। আমি শুনছিলাম তিনির কথা। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচিছল না। শুধু জপ করছিলাম আল্লাহর নাম। আল্লাহ তুমি এ কি পরিক্ষায় আমায় ফেললে , আমার অপরাধ কোথায় , কেন আমার এ অবস্থা? শেষ পর্যন্ত আমি তিনির কাছ থেকে এক সপ্তাহের সময় চেয়ে বিদায় নিয়ে আসতে চাইলে ও তিনি সময় প্রদানে ছিলেন নারাজ। কিন্তু আমাকে সিদ্ধান্তহীনতায় দারুণ ভুগাচিছল। এ সমস্ত ভাবনা ছাড়া ও ভাবছিলাম আমি কলেজ পড়ুয়া , মাদ্রাসার পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াব কি ভাবে ? যাক পরদিন আমি এ বিষয়ে চিন্তিত থাকায় বাড়ি থেকে বের হইনি। দুপুর বেলা মাওলানা সাহেব আমার বাড়ি গিয়ে হাজির। অনেকক্ষণ আমি অসম্মতি প্রকাশ করলে ও শেষ পর্যন্ত তিনির কাছে হার মানতে হয়। কারন এ চাকুরী তখন আমি গ্রহণ না করলে আমার লেখাপড়া এখানেই সমাপ্তি টানতে হত অর্থনৈতিক কারণে। যাক আমি সম্মতি প্রদান করলে তিনি অত্যন্ত খুশি মনে বেরিয়ে আসেন। তখন তিনির মাদ্রাসার নাম ছিল জামেয়া-এ-ইসলামিয়া তেলিকোনা মাদ্রাসা। আমি এখানে কর্মরত থাকাকালীন আবার আহবান আসে উত্তর বিশ্বনাথ হাই স্কুল থেকে যোগদানের নিমিত্তে। আমি বার বার অত্যন্ত দৃঢ়তার সহিত অসম্মতি প্রদান করি যেতে সেখানে। এক সময় আমাকে যখন তেলিকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক , খাজাঞ্চী গাঁও এর অধিবাসী নছির উদ্দিন খান সাহেব জোর করে ধরেন উত্তর বিশ্বনাথ যেতে। আমি তিনির পীড়াপীড়িতে যখন আর পেরে উঠছিলাম না। তখন তিনিকে জানিয়ে দেই আমার জীবন বিপন্নের সময় মাওলানা সাহেব আমাকে আশ্রয় দিয়ে কৃতজ্ঞতার নাগপাশে আবদ্ধ করে রেখেছেন। আমি অকৃতজ্ঞতার কাতারে নাম লিখাতে পারব না কোন মতেই। অত:পর মাওলানা সাহেব একদিন আমাকে শুধালেন মিজান আমি খুশি হয়ে তোমাকে উত্তর বিশ্বনাথ হাই স্কুলে শিক্ষকতায় দিতে সম্মত। আমি প্রত্যুত্তরে তিনিকে পূর্বের ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি দৃঢ়তার সহিত জানান আমি আছি তোমার সাথে ছায়ার মত। চিন্তা কর না। আমি তিনির কথায় উত্তর বিশ্বনাথে যোগ দিতে সম্মত হলে ও শর্ত ছিল , আপনি আমার সাথে গিয়ে যোগদান নিশ্চিত করতে হবে। কথামত তিনি আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে যোগদান প্রদান করেন একজন জুনিয়র শিক্ষক রুপে। অত:পর দীর্ঘ তিন মাস দিচিছ , দেব বলে সময়ক্ষেপন , অতিক্রান্তে তখনকার প্রধান শিক্ষক আমাকে নিয়োগ পত্র প্রদান করেন করণিক বনাম শিক্ষক রুপে। আমি যখন এর প্রতিবাদে মাঠে নামি কোমর বেঁধে তখন প্রধান শিক্ষক বাধ্য হন আমাকে জুনিয়র শিক্ষক রুপে নিয়োগ পত্র প্রদান করতে। তার প্রমান আমি রেখে দেই আমাকে নিয়োগকৃত উভয় পদে প্রদানের। অর্থ্যাৎ আমার সাথে এ বৈষম্যের , অবিচারের , নির্যাতনের। একই তারিখে , একই প্রতিষ্ঠানে , একই ব্যক্তিকে দুই পদে নিয়োগ প্রদানের।

যাক আমি মুল প্রসঙ্গ থেকে একটু দুরে হয়ত চলে যাচিছলাম। আবার ও ফিরে আসি মুল প্রসঙ্গে। ১৯৮৩ সালে জামেয়া-এ-ইসলামিয়া তেলিকোনা মাদ্রাসা দাখিলের অনুমতি লাভ করে এবং এমপিও ভুক্ত হয়। পহেলা জুলাই ১৯৯৮ সালে আলিম ক্লাস খোলার অনুমতি প্রাপ্ত হয়। ১৯৯৯ সালে জামেয়া-এ-ইসলামিয়া নাম পরিবর্তন করে “ এলাহাবাদ ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসা ” নামকরণের মাধ্যমে আলিম ক্লাসের কার্যক্রম শুরু হয়। পহেলা জুলাই ২০০২ সালে আলিম ক্লাসের স্বীকৃতি লাভ করে। ২০০৪ সালে এমপিও এর অন্তর্ভুক্তি লাভ করে। তবে এতসবের নেপথ্যে যিনি নিরলস সাহায্য , সহযোগিতা ও অক্লান্ত পরিশ্রম প্রদান করে তেলিকোনা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এলাহাবাদ আলিম মাদ্রাসার উন্নতি , অগ্রগতি ও সফল অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখে উত্তর বিশ্বনাথ বাসীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত মানুষ গঠনে সহায়ক ভুমিকা পালন করে গেছেন। তিনি আর কেউ নন , তিনি হচেছন মাওলানা ওলিউর রহমান। আমি মনে করি তিনি একজন সফল ও সার্থক মানুষ। এ দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যত দিন শিক্ষার আলো বিলিয়ে সুনাগরিক তৈরী করবে , দেশ ও জাতীকে অগ্রযাত্রার পথে এগিয়ে নেবে , ততদিন মাওলানা ওলিউর রহমানের কীর্তি গাঁথা স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে। তিনির স্বপ্ন সমাজ যেন আলোকময় প্রভায় উদ্ভাসিত হয় আগামীর অগ্রযাত্রায় আলোকিত মানুষ সৃষ্টির মাধ্যমে।

এখানেই কিন্তু মাওলানা সাহেবের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল না। অথবা থেমে থাকেননি। ২০০১ সালে মাওলানা ওলিউর রহমান তিনির প্রথম পুত্র তরুন আলেম মাওলানা নুরুর রহমানকে অনুপ্রাণিত করে গঠন করেন “ আর-রহমান এডুকেশন ট্রাষ্ট ”। এ ট্রাষ্টের মাধ্যমে বিভিন্ন সমাজ সেবামুলক কার্যক্রম পরিচালিত হচেছ। আমি এ ট্রাষ্টের দু’টি কার্যক্রমের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছি। মাওলানা ওলিউর রহমানের কথা বললেই তিনির জীবনী সমাপ্ত করা সম্ভব হচেছ না। তিনির সকল কাজকর্মে নেপথ্যে থেকে আরেকজন ইন্ধন যোগিয়েছেন , তাঁর কথা নিদেন পক্ষে স্মরণ রাখা আমাদের কর্তব্য। নতুবা কার্পণ্যতায় আমরা ভুগবো , তিনির সহযোগিতা , সাহচার্য পেয়ে মাওলানা এগিয়ে গেছেন সকল কর্মকান্ডে। এখানে জাতীয় কবির একটি আলোচিত কবিতার চরণ উদ্ধৃতি আমাকে পীড়া দিচেছ অবিরত। “ এ পৃথিবীতে যা কিছু ……অর্ধেক তার নর” বাক্যটির পূর্ণ প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই মাওলানা ওলিউর রহমানের জীবনে। তিনির সহধর্মীনী জনাবা রাবেয়া আকতারের কথা আমি বলতে চাচিছ। রাবেয়া আকতার একজন শিক্ষিত বিদুষী মহিলা। পর্দার আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়িয়েছেন মাওলানার প্রতিটি পদক্ষেপে সাহস ও শক্তির প্রেরণাদাত্রী রুপে। তাছাড়া উভয়েই প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক রুপে ১৯৭২ সালে নিয়োজিত থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁদের জীবনী পর্যালোচনা করলে সঙ্গত কারনেই দৃষ্ট হয় শিক্ষাদানে , শিক্ষার আলো বিতরণে যাপিত জীবন যাত্রা ব্যয়িত হয়েছে। একজন নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তি হিসেবে জীবন ব্যয়িত করে মাওলানা ওলিউর রহমান এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি স্রষ্টার আহবানে জমান ১২ই সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে নিজ বাড়িতে। আমি /আমরা তিনির রুহের মাগফেরাত কামনা করি মহান আল্লাহর দরবারে কায়মন বাক্যে। আল্লাহ তিনিকে জান্নাত বাসী করুন এ প্রার্থনা অবিরত। তিনির প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলি যুগ থেকে যুগান্তরের পথে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে সুনাগরিক তৈরীর মাধ্যমে এগিয়ে যাক নিরন্তর সফলতার সিড়ি বেয়ে এ প্রত্যাশা হৃদয়জ।

লেখক: মিজানুর রহমান মিজান
উপদেষ্টা সম্পাদক জেএনএনবিডি ডট কম, সাবেক সভাপতি বিশ্বনাথ প্রেসক্লাব,
সম্পাদক দীপ্তি।