প্রচ্ছদ

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

  |  ০৬:০৭, জুন ২৩, ২০২০
www.adarshabarta.com

Manual1 Ad Code

একজন অভিভাবক, একজন পিতা

:: মোঃ নাসির ::

বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে উঠা শতবর্ষী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জগন্নাথ। ব্রাহ্ম স্কুল থেকে ইন্টারমিডিয়েট, ডিগ্রী ও মাস্টার্স কলেজ থেকে আজ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর সরকারি এক ঘোষণার মধ্য দিয়ে অতীতের সকল ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় রুপে যাত্রা শুরু করে জগন্নাথ। সুদূর অতীত থেকেই আন্দোলন সংগ্রাম ও নানামুখী অস্থিরতার ভেতর দিয়ে কেটেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষনাও এমনই এক ছাত্র আন্দোলনেরই ফসল।

Manual3 Ad Code

অপরিকল্পিত ভাবে হঠাৎ একটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করায় ঝামেলা যেন বেড়ে যায় আরো কয়েকধাপ। কলেজের এত সীমিত সম্পদ নিয়ে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কোন ভাবেই চলতে পারে না। মাত্র সাড়ে সাত একর জায়গার ছোট্ট ক্যাম্পাসটিতে এতগুলো বিভাগ এবং এর শিক্ষক শিক্ষার্থী জায়গা দেওয়া, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়ে উঠে মূলত অসম্ভব ব্যাপার। ফলশ্রুতিতে আবার দেখা দেয় ছাত্র আন্দোলন। সবচেয়ে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় আবাসন সমস্যা। আবাসনের দাবীতে প্রতি বছর নতুন শিক্ষার্থী আসলেই সংঘটিত হতে থাকে ‘হল আন্দোলন’। এতে করে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে যাকে পড়তে হয় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।

২০০৬ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত চার মেয়াদে এখানে দায়িত্ব পালন করেন তিনজন উপাচার্য। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব একটা এটে উঠতে পারেননি তাঁদের কেউই। ফলে প্রথম সাত বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বলতে একটি বহুতল ভবনের সাত তলার পর্যন্ত নির্মান!

তৎকালীন কলেজের শিক্ষক ও কিছু পরিমাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মধ্যকার তিক্ত রসায়নের উভমুখী বিক্রিয়ায় সব কিছুই স্থবির হয়ে থাকে।

এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম তম এবং চতুর্থ ব্যক্তি হিসেবে উপাচার্য হয়ে আসেন অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন শেষে দায়িত্ব নেন বাংলাদেশের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিশ্ববিদ্যালয়ের কাণ্ডারি হিসেবে। ২০১৩ সালের ২০ মার্চ উথালপাতাল ঢেউয়ের তোড়ে তোলপাড় হওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল ধরেন এক সুদক্ষ নাবিক, তিনি অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান।

তাঁর নেতৃত্বে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা করে সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যা বুঝায় সেই দিকে। প্রথমেই তিনি হাত দেন সাংস্কৃতিক আবহের উন্নয়নে। ধীরে ধীরে কলেজ সংস্কৃতি থেকে বের করে আনতে থাকেন জগন্নাথকে। অবাক করা বিষয়, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে সাত বছরে এখানে সাংস্কৃতিক চর্চার পরিবেশ তৈরি হয়নি। তিনিই প্রথম ২০১৩ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলা বর্ষবরণ’, ‘বসন্ত বরণ’, ‘শরৎ উৎসব’ সহ বাঙালিয়ানার ধারক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উদযাপন করা শুরু করেন, যা আজ অবধি চলমান।

শুরু হয় আন্তঃবিভাগ ও আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও বিভিন্ন শিক্ষা সহায়ক কার্যক্রম।

২৮ টি বিভাগ থেকে বাড়িয়ে করেন ৩৮ টি বিভাগ। সংগীত, চারুকলা ও নাট্যকলা বিভাগের সূচনায় সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পায় এক নতুন মাত্রা। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একমাত্র এখানেই খোলা হয় ভূমি আইন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের স্নাতক কোর্স। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ৩৩.৯৭ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে তিনি নিয়ে আসেন ১০৪.৫৬ কোটি টাকায়। ২৯২ জন শিক্ষকের সংখ্যা বাড়িয়ে প্রায় সাতশোতে পরিণত করে ছাত্র ও শিক্ষকের অনুপাত ৬৪:১ থেকে কমিয়ে ৩৭:১ এ নিয়ে আসেন তিনি।

তাঁর সুদক্ষ তত্ত্বাবধানে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন করা হয়। নিজস্ব পদ্ধতিতে অনলাইন ভিত্তিক রেজাল্ট সিস্টেম, সার্বক্ষণিক মনিটরিং ক্যামেরা স্থাপন ও ভারচুয়াল ক্লাস পদ্ধতির সূচনা করা হয়।

বিভিন্ন বিভাগ ও অনুষদ ভিত্তিক জার্নাল প্রকাশ, বিভিন্ন বিভাগে সান্ধ্যকালীন কোর্স খোলা সহ এমফিল, পিএইচডি ও বিদেশী শিক্ষার্থী ভর্তি করে বৃদ্ধি করা হয়েছে শিক্ষার কলেবর।

গ্রন্থাগারে বই বৃদ্ধি, ই বুকস (২৪০০০ কপি ই বই সমৃদ্ধ) ও ই জার্নাল সম্বলিত ই লাইব্রেরি তৈরী, লাইব্রেরির দ্বিতীয় শিফট চালু সহ লাইব্রেরি সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করেছেন করা হয়েছে ছাত্র ও শিক্ষকদের জন্য।

মেধাবী কিন্তু অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি চালু করেছেন বৃত্তির ব্যবস্থা।

Manual7 Ad Code

পরিবহন খাতে যুক্ত করেন নতুন ১৫ টি বড় বাস এবং বিআরটিসি থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য ভাড়া নেওয়া হয় আরো ১৫ টি বাস। এতে পরিবহন সংকট অনেকাশে কমে আসে। আরো বেশ কিছু ছোট ও বড় বাস পরিবহণ বহরে সংযুক্তির অপেক্ষায় আছে।

Manual5 Ad Code

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা আবাসন সমস্যা। প্রতিবছর একাধিকার হলের দাবীতে বন্ধ হয়ে যেত বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে কয়েকমাসে সেশন জটে পড়ত প্রতিটি বিভাগ। হলের দাবীতে আন্দোলন করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের পুরনো এই রেওয়াজ চিরতরে বন্ধ করতে সক্ষম হন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জমিতে ছাত্রীদের জন্য ১৬ তলা বিশিষ্ট হলের কাজ শুরু করেন, ইতোমধ্যে যার ১০ তলার কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে।

Manual6 Ad Code

তাঁর জোড় প্রচেষ্টায় কেরানীগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস ও আবাসনের জন্য সরকারি ২০০ একর জমি বরাদ্দের প্রক্রিয়া চলছে। সাত তলাতে থেমে যাওয়া একাডেমিক ভবনের নির্মানকাজ পুনরায় শুরু হয়ে ইতোমধ্যে ১২ তলা পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ইউটিলিটি ভবন ২ তলা থেকে ৬ তলা পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে। শিক্ষকদের জন্য তৈরী করা হয়েছে ৫তলা বিশিষ্ট ডরমেটরি ভবন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য নিজস্ব একটি পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ হবে খুব শীঘ্রই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান এডমিনিস্ট্রেটরের বাইরেও তাঁর একটি অন্যতম দিক রয়েছে তা হচ্ছে তাঁর অভিভাবকত্ব। তিনি শুধু প্রশাসনিক ভাবেই এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নন, তিনি একজন অভিভাবক। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ হাজার শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আস্থার জায়গা তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন শিক্ষার্থীর জন্য তাঁর দোয়ার খোলা থাকে সবসময়। যেকোন সমস্যা নিয়ে যেকোন শিক্ষার্থী বিনা বাধায় তাঁর কাছে যেতে পারে, নিজের অসুবিধার কথা বলতে পারে। বাংলাদেশের অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দ্বার শিক্ষার্থীর জন্য এতটা উন্মুক্ত বলে আমার জানা নেই। তিনি একজন অভিভাবক, একজন প্রশাসক, একজন মমতাময় পিতা।

দেড়শো বছরের ভাঙ্গাগড়ার মধ্য দিয়ে পথ চলা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ে যিনি পরিণত করেছেন এবং দিনরাত একে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে পরিণত করতে যিনি নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান।

লেখক: সাংবাদিক, গবেষক; নিউ জার্সি, আমেরিকা প্রবাসী।

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code