প্রচ্ছদ

রেনেসাঁ সাহিত্য মজলিস কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন ও ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষা আলোচনা

  |  ১৩:৪৭, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৩
www.adarshabarta.com

Manual8 Ad Code

২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ইংরেজি তারিখে পুর্বলন্ডনস্থ ভ্যালেন্স রোডের উডেনহাম সেন্টারে “রেনেসাঁ সাহিত্য মজলিস, ইউ কে”  কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন ও ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষা দিবস পালন করা  হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন রেনেসাঁ সাহিত্য মজলিসের সভাপতি বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সাংবাদিক  ও কমিউনিটি ব্যাক্তিত্ব কেএম আবু তাহের চৌধুরী, অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন জেনারেল সেক্রেটারি কবি সুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক  শিহাবুজ্জামান কামাল, কোরআন তেলাওয়াত করেন বিশিষ্ট আলেমে হযরত মাওলানা নুরুল হক, অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন – কবি- সাহিত্যিক মাওলানা রফিক আহমেদ রফিক, সাংগঠনিক ও মানবাধিকার কর্মী বদরুজ্জামান বাবুল, লেখক- এডভোকেট মোহাম্মদ  ইয়াওর উদ্দিন, বিশিষ্ট ইমাম মাওলানা আব্দুল মালিক, প্রবাসী অধিকার পরিষদের সভাপতি  জামাল সিদ্দিকী, খান জামাল নুরুল ইসলাম, লেখক – সাংবাদিক সাদেকুল আমিন, সমাজসেবী  ফারুক মিয়া, আব্দুল আউয়াল, মোহাম্মদ করিম, সালমা হক, নাজমুল হক, কবি শাহ এনায়েত, গোলাম কাদের চৌধুরী নাজমুল হোসেন, কমিউনিটি এক্টিভিস্ট নুর বক্স প্রমুখ।

বক্তারা বলেন আমরা বাংলা ভাষার অধিকার অর্জন করেছি কিন্তু ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে পারিনি। ভাষার কারণে এত প্রাণের বিসর্জনের পরেও মাতৃভাষা বাংলা নিজ দেশে যেন অনেকটা উপেক্ষিত! টাওয়ার হ্যামলেটে বাংলা স্কুল আবার চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বর মাস থেকে বাংলা স্কুল চালু করা হবে আশ্বাস প্রদান করা হয়। বাসায় আমাদের বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে হবে, তাদেরকে বাংলা শিক্ষা দিতে হবে।  তাই আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে বাংলা স্কুলে পাঠাতে হবে, তাদেরকে বাংলা শিখাতে হবে।  সুতরাং মাতৃভাষা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।

এছাড়া বক্তারা আরও বলেন, ভাষা আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল এই “রেনেসাঁ” র মতো সংগঠন “তমুদ্দুন মজলিস” এর দ্বারা যার নেতৃত্বে ছিলেন মরহুম প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের মতো ইসলাম্প্রীয় ব্যাক্তিরা, রাজনীতিকরা নয়, আর প্রগতিশীল নামধারীরা ছিলেন পেছনে। অবশ্য বাকীরাও পরবর্তীতে শরিক হয়েছিলেন সবার স্বার্থে,দশ এবং দেশের স্বার্থে।

ইসলামের দৃষ্টিতে  মাতৃভাষার গুরুত্ব তাৎপর্য্য:

ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করতে শেখায়। কারণ সব ভাষাই আল্লাহর দান ও তার কুদরতের নিদর্শন। পবিত্র কোরআনুল কারিমে বর্ণিত হয়েছে, ‘আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য।’ (সুরা রুম, আয়াত : ২২, পারা ২১)।

মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি- এ তিনটি শব্দ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে পরম আবেগের। মাতৃভাষা মানে মায়ের ভাষা। ইসলামে মাতৃভাষার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মানুষের প্রতি আল্লাহতায়ালার নিয়ামত ও দানের কথা চিরস্মরণীয়, ভাষা তার অন্যতম। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তিনি তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।’ (সুরা আর রহমান, আয়াত : ০৩-০৪, পারা : ২৭)।

মানুষের মুক্তির পয়গাম নিয়ে পরিপূর্ণ জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে সব ধরনের সমস্যার কঠিন ও নির্ভুল সমাধানের নিমিত্তে যুগে যুগে মহান আল্লাহতায়ালা যত নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন, সবাইকে স্বজাতীয় ভাষায় পাণ্ডিত্য দান করে প্রেরণ করেছেন এবং সব আসমানি কিতাবকে তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় অবতীর্ণ করেছেন। যেমন : মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত : ৪, পারা : ১৪)।

পক্ষান্তরে যদি পবিত্র কোরআনুল কারিম মাতৃভাষায় অবতীর্ণ না করতেন তাহলে আরবের মূর্খ পণ্ডিতরা কী করত এ প্রসঙ্গে মহান প্রভু বলেন, ‘আমি যদি আজমি ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ করতাম, তবে তারা অবশ্যই বলত এর আয়াতগুলো বিশদভাবে বিবৃত হয়নি কেন? কী আশ্চর্য যে, কোরআন আজমি অথচ রাসুল আরবি।’ (সুরা হা-মিম সেজদা, আয়াত : ৪৪, পারা : ২৪)।

এ ছাড়া সুন্দর ও বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলা উন্নত ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। ধর্ম প্রচারে শুদ্ধ ভাষা ও সুন্দর বর্ণনার প্রভাব অতুলনীয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আনা আফসাহুল আরব, অর্থাৎ- আমি আরবের শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধভাষী।’ (মিশকাত শরিফ)।

তাই বিশুদ্ধভাবে মাতৃভাষায় কথা বলা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত। মাতৃভাষাপ্রীতি সঞ্চারিত হয় ইসলামে মাতৃভাষার ওপর অত্যধিক গুরুত্বারোপের কারণে। সুতরাং নিজ মাতৃভাষা বাংলা ভাষার স্বকীয়তা রক্ষা করা আমাদের ওপর অপরিহার্য। নবী (সা:)-এর কাজের দায়িত্ব যেহেতু আমাদের ওপর অর্পিত হয়েছে, তাই নিজ মাতৃভাষায় অভিজ্ঞতা অর্জন করে মানুষের সামনে ইসলামের সঠিক মর্মবাণী বিশুদ্ধভাবে সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করা আমাদের ওপর অবশ্যই কর্তব্য। আমরা যদি আমাদের দায়িত্বে অবহেলা করি, তাহলে দেশবাসীর প্রতি অবিচার করা হবে এবং মহান প্রভুর কাছে পরকালে পাকড়াও হতে হবে।

Manual6 Ad Code

মহান সাহিত্যিক সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ:) বাংলাদেশ সফরে এসে বলেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে নিতে হবে এবং অপশক্তির হাত থেকে নেতৃত্ব ছিনিয়ে আনতে হবে। তিনি আরো বলেন, দীর্ঘ জীবনের লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন কিংবা বিমাতাসুলভ আচরণ এ দেশের আলেম সমাজের জন্য জাতি হত্যারই নামান্তর। তিনি আরো বলেন, প্রতিটি মাদ্রাসায় বাধ্যতামূলক সাহিত্য-সাংবাদিকতার ওপর পাঠদান এখন সময়ের দাবি।

Manual3 Ad Code

অনেকের প্রশ্ন, আমাদের এই মাতৃভাষা তো আমাদের মুসলমানদের ভাষা নয়। এজন্যই অনেকে বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে গুরুত্ব দেয় না। অথচ বাস্তব বিষয়টি অনেকেরই অজানা। কোনো কোনো ভাই মনে করেন, এই ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করলে মানুষ নাস্তিক হয়। এই ভাষায় কোনো নুর নেই। উত্তরে বলতে হয়, আরবি ভাষা তো ছিল আবু জাহেল, উতবা ও শায়বাদের। ফারসি ভাষা ছিল অগ্নিপূজকদের। তাই বলে কি সে দেশের মুসলমানরা তাদের মাতৃভাষা আরবি-ফারসি বর্জন করেছেন? না, করেননি। বরং তারা ইসলামি জ্ঞান দ্বারা সে ভাষার সাহিত্য আরো সমৃদ্ধ করেছেন। ফলে সে ভাষায় নুর এসেছে এবং পরিণত ভাষায় পরিণত হয়েছে। এদিকেই তাগিদ দিয়েছেন বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)। তা ছাড়া বাংলা ভাষা কোনো একক ধর্মীয় গোষ্ঠীর পৈত্রিক সম্পত্তি! এটা প্রচলিত ভুল। পাশাপাশি এটাও সত্য, বাংলা ভাষা মুসলিম শাসকদের দ্বারাই সমৃদ্ধ লাভ করেছে। বিশেষ করে সুলতান ইলিয়াস শাহর শাসনকালে। এজন্য তাকে বঙ্গীয় উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল।

বাংলা সনের জন্ম হয় সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে। হিজরি সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৎকালীন মহাপণ্ডিত ‘আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজী’ বাংলা সনের উদ্বোধন করেন। পক্ষান্তরে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল একটি পক্ষ। যারা বাংলা ভাষায় কথা বলত তাদের শাস্তি দেওয়া হতো। জনগণকে ভীতি প্রদর্শন করত যে, ‘ভাষাং মানবঃ স্রোতা বৌরবং নরকং ব্রজ্রে’ অর্থাৎ- সংস্কৃতি ভাষা ছাড়া যারা অন্য ভাষা তথা বাংলা ভাষায় কথা বলবে তাদের বৌরব নামক নরকে নিক্ষেপ করা হবে।

ড. দীনেশ্চন্দ্র সেন লিখেছেন, ইতরের ভাষা বলে বাংলা ভাষাকে পণ্ডিতরা দূরদূর করে তাড়িয়ে দিতেন। প্রকৃত অর্থে এই জনপদে বসবাসরত প্রত্যেক মানব সন্তানই এর উত্তরাধিকারী। বাংলা ভাষা এই পাললিক ভূমির আপমর জনতার ভাষা। আমাদের মাতৃভাষা।

Manual8 Ad Code

এই মাতৃভাষাকে ইসলামের নুর দ্বারা নুরান্বিত করে আরো সমৃদ্ধ করতে হবে। বর্তমানে নবীন ইসলামি লেখক বেড়েছে। অধিকাংশ পত্রিকায় স্থান পেয়েছে ‘ইসলামি পাতা’। সেখানে প্রতিদিন নবীনদের লেখা দেখা যায়। প্রবীণ লেখকরা তাদের প্রশংসা করেন। এতে নবীনদের আগ্রহ-উদ্দীপনা আরো বৃদ্ধি হতে থাকে। এটাই সময়ের দাবি।

মাতৃভাষায় লেখালেখি হচ্ছে সাহিত্য নিয়ে চর্চা হচ্ছে। আশা করা যায় এভাবে চলতে থাকলে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রতি সবার আবেগ ও ভালোবাসা আরো কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে। এই সবকিছু মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্ব থাকার পরই হতে পারে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, এই ভাষায় লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চার ধারা অব্যাহত থাকুক- এটাই প্রত্যাশা।

Manual6 Ad Code

প্রেস বিজ্ঞপ্তি 

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code