প্রচ্ছদ

ব্যবস্থাপক যাহা করেন তাহাই ব্যবস্থাপনা-৪

  |  ০৮:৪০, এপ্রিল ০১, ২০২২
www.adarshabarta.com

Manual1 Ad Code

ভিশন-মিশন বিভ্রাট

:: অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান ::

Manual7 Ad Code

ভিশন এবং মিশনের কেতাবি সংজ্ঞাগুলোতে যা লেখা আছে এর সারমর্ম হচ্ছে ভিশন হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের “ভবিষ্যৎ”, মিশন হচ্ছে “বর্তমান”‌ । ভিশন হচ্ছে কেন এই প্রতিষ্ঠান, ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানটি কোথায় যেতে চায়? মিশন হচ্ছে- প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে বা এখন যা করছে। ভিশন হচ্ছে Why? আর মিশন হচ্ছে What , Who, এবং How?। ভিশন হচ্ছে ফল(effect) , আর মিশন হচ্ছে কারণ(cause)। ( যারা বই বা ডিকশনারি পড়ে এই শব্দগুলোর ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন তাঁদের জন্য এ লেখা লিখছি না। এই শব্দগুলোর ব্যবহার নিয়ে যারা আমার মত কিছুটা হলেও কনফিউজড তাঁদের জন্য এই লেখা) ।

এক ডাকসাইটে প্রধান নির্বাহী সুযোগ পেলেই কোম্পানির কর্মকর্তাদের সবসময় কোম্পানির ভিশন-মিশনকে পাথেয় করে কাজ করতে পরামর্শ দেন। সেই কর্মকর্তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের সাবেক ছাত্র বৈকালিক এমবিএ ক্লাসে আমাকে এই শব্দ যুগলের পার্থক্য জিজ্ঞেস করে এবং তাঁদের প্রধান নির্বাহীর প্রতিদিনের নসিয়তের কথা বলে। আমি বললাম আপনি কি কখনো ওই নির্বাহীকে জিজ্ঞেস করেছেন, ” স্যার, এই শব্দ দুইটার মধ্যে পার্থক্য কি?” আমি আপনার এই প্রশ্নের জবাব নেক্সট ক্লাসে দিব। এর আগে আপনি আপনার স্যারকে এই দুই শব্দের পার্থক্য জিজ্ঞেস করে আসবেন। পরবর্তী ক্লাসে আমি ওই ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলাম, ভিশন মিশনের পার্থক্যের ব্যাপারে আপনার স্যার কি বলেছে? ছাত্রটি বলল কিছুই বলেননি। আমাকে অনেকক্ষণ বকাবকি করেছেন। বলেছেন, “এই দুইটার মধ্যে পার্থক্য জানো না? তোমাদের লেখাপড়া বলতে কিছু নেই। ইংরেজিতো দেখছি কিছুই শিখোনি । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শুধু পলিটিক্স, পড়ালেখা ওখানে কিছুই হয়না না । আমাদের সময় এটা ছিল প্রাচ্যের অক্সফোর্ড, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রায় পাঁচ মিনিট আমার অজ্ঞতা নিয়ে বক্তৃতা দিলেন। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না।”

Manual7 Ad Code

আমি নিশ্চিত ওই নির্বাহী নিজেও কনফিউজড ছিলেন দুই শব্দের পার্থক্যের ব্যাপারে। পাঠকদের অনুরোধ করবো, ডিকশনারিতে “ভিশন- মিশন- লক্ষ্য-উদ্দেশ্য -টার্গেট” এই পাঁচটি শব্দের অর্থ দেখতে। সবকটি শব্দের আক্ষরিক অর্থ লিখলে আপনিও কনফিউজড হবেন। একটার সাথে অন্যটার পার্থক্য নির্ণয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে যাবেন।

আশির দশকের শুরুতে আইবিএ-তে ড.আলিমুল্লাহ মিয়ান এর “সেন্টার ফর পপুলেশন ম্যানেজমেন্ট এন্ড রিসার্চ” এ তিন সপ্তাহের একটা প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমি তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদে যোগ দিয়েছে। প্রশিক্ষক ছিলেন ফিলিপাইনের ম্যানিলায় অবস্থিত ‘এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট’ এর অধ্যাপক অ্যানথিনিও লোপেজ, যিনি ছিলেন হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের গ্রাজুয়েট। তিন সপ্তাহ প্রশিক্ষণ চলাকালে তাঁর সাথে ভালো রকমের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। প্রোগ্রামের বাইরেও তাঁর থেকে অনেক কিছু শিখেছি। সে আমাকে বলেছিল ছাত্ররা যদি
‘ভিশন-মিশন-লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-টার্গেট’ এর পার্থক্য বুঝতে না পারে, তাহলে পাঁচটি শব্দ খাতায় লিখে দিবে, তাহলে সহজেই বুঝে যাবে। এই বলে সে আমার খাতার পাতায় পাঁচটি শব্দ লিখে দিল। প্রথম শব্দটির কোন অক্ষর চেনা যাচ্ছিল না এবং কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না , একেবারেই অস্পষ্ট। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি লিখলে ? সে বলল, “এটা হচ্ছে vision ” , তারপরের শব্দটির প্রথম অক্ষরটি ‘m’ এর মত, আর বাকি কিছুই বুঝা যাচ্ছিল না‌। তবুও শব্দের আদ্যাক্ষর ‘m’ দেখেই বুঝে নিয়েছিলাম এটা মিশন(mission) হতে পরে। ছোট হাতের অক্ষরে পেঁচিয়ে goal শব্দটি লিখলেন, সবগুলো অক্ষর ফুটবলের মত গোলাকৃতির হলেও একটু কষ্ট হলেও পড়া গেল। তার পরে লিখলেন স্পষ্টকরে O b j e c t i v e, এবং সর্বশেষ সবকটি অক্ষর ক্যাপিটাল লেটার ব্যবহার করে লিখলেন ‘TARGET’ । প্রত্যেকটা শব্দের চেয়ে এর পরবর্তী শব্দটি সুস্পষ্টভাবে আমার খাতায় প্রতিভাত হচ্ছিল। তখন তিনি আমাকে বললেন, “এই হচ্ছে শব্দ পাঁচটির মধ্যে পার্থক্য । একটা থেকে পরেরটা স্পষ্টতর। প্রথমটা একেবারেই কাব্যিক এবং রোমান্টিক, আর সর্বশেষটা একেবারে সুনির্দিষ্ট গাণিতিক বাস্তবতা।”

পুরনো ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডের পশু হাসপাতালের অনতিদূরে এক ইঁদুর মারার কল তৈরীর কারখানার মালিক, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, বঙ্গবন্ধুর ভীষণ ভক্ত, তাঁর সাইনবোর্ডে কারখানার নাম ‘মেসার্স মাউস ট্রেপ লি:’ এর নিচেই লিখলেন, ” জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা আমাদের ভিশন”‌ । অনেকেই তাঁর লেখা নিয়ে তিরস্কার করতে লাগলো । কেউ কেউ বলল, রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য সে এমনটি লিখেছে, ভবিষ্যতে সে ওয়ার্ড কমিশনারের নমিনেশন চাইবে। কেউ বলল চাঁদাবাজির হাত থেকে বাঁচার জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি অ্যানথিনিও লোপেজের ব্যাখ্যা ধরে বিশ্লেষণ করে দেখলাম সে তো ঠিকই লিখেছে। জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা একটি বহুমাত্রিক বিমূর্ত ধারণা (ভিশন)। স্বপ্নের সোনার বাংলায় হয়তো অনেক কিছুই থাকবে, আবার থাকবেও না। কিন্তু ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থাকবে না, এটা নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন । তাহলে একটু স্পষ্ট করে বললে দাঁড়ায় “ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ” (মিশন)।
ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ করতে হলে খাদ্যের পর্যাপ্ততা বাড়াতে হবে (লক্ষ্য )। খাদ্যের পর্যাপ্ততা বাড়ানো যেতে পারে খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে অথবা খাদ্যের অপচয় কমিয়ে। খাদ্যের অপচয় কমিয়ে খাদ্যের পর্যাপ্ততা বাড়ানো সম্ভব (উদ্দেশ্য)। প্রতিবছর আমাদের দেশে প্রচুর খাদ্য অপচয় হয়। আমাদের দানাদার শস্যের ৭% ইঁদুরে খেয়ে ফেলে। আমাদের বর্তমানে দানাদার খাদ্য উৎপাদন ৪ কোটি মেট্রিক টন। এর অর্থ হচ্ছে প্রতিবছর ইঁদুরে খায় ২৮ লক্ষ মেট্রিক টন। প্রকৃতপক্ষে মাঝেমধ্যে আমাদের যে খাদ্য ঘাটতি হয় সেটা ২৮ লক্ষ টনের বেশি না। এর অর্থ হচ্ছে খাদ্য উৎপাদন না বাড়ানো গেলেও কেবল ইঁদুর মারলেই আমাদের খাদ্য ঘাটতি থাকবে না । ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে ৭,৭৫,২৫,২১০টি ইঁদুর মারতে পারলে (টার্গেট) আমাদের খাদ্য ঘাটতি থাকবে না। দিন, তারিখ, সংখ্যা নির্দিষ্ট করে যখন কিছু বলা হয় সেটাই টার্গেট।

Manual7 Ad Code

ইঁদুর মারতে পারলে খাদ্যের অপচয় রোধ হবে, খাদ্যের পর্যাপ্ততা বাড়বে, পর্যাপ্ততা বাড়লে সবাই খাদ্য পাবে, এবং ক্ষুধা মুক্ত হবে বাংলাদেশ। আর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা(ভিশন) প্রতিষ্ঠায় এক ধাপ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে ইঁদুর মারার কলের কারখানার সাইনবোর্ডে লেখা ভিশনটি যথার্থই বলতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Manual5 Ad Code

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code