প্রচ্ছদ

আমার ছোটবেলার কিছু স্মৃতি

  |  ১৪:৫২, মে ৩১, ২০২০
www.adarshabarta.com

:: রাজলক্ষ্মী মৌসুমী ::

কাল চলে গেলো ষষ্ঠী পূজো।
আমার বর প্রতি বছরই দুঃখ করে বলেন, জামাই ষষ্ঠী পেলোনা। শ্বাশুড়ি মাতা থাকলে তো তিনি জামাই ষষ্ঠী নিতে পারতেন। ওঁর কথা শুনে মনটা আরো খারাপ হয়ে যায়। আমার মা বেঁচে থাকলে তো সত্যি ওঁর আশাটা পূর্ণ হতো।
কাল রাতে আমি একদম ঘুমাইনি। কত ঘটনা, কত স্মৃতি, মনে হচ্ছিল।
আমরা বড় হয়েছি আনন্দের মাঝে। বাড়ীতে আমাদের অনেক লোক জন ছিলো জ্যাঠতুতো বোন ছিল চার জন, ভাই ছিলো দুই জন।আমরা দুই বোন, এক ভাই ছিলাম। বাড়ীর সবার ছোট ছিলাম আমি। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ছিলো আমার জীবন।আমাদের গ্রামের বাড়ী ছিলো রায়পুর। বাড়ীতে দূর্গা পূজো হতো। এ যে কী আনন্দ, বলে বুঝাতে পারবো না। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব খারাপ ছিলো। নৌকা করে যেতে হতো। এখন তো কত ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা। এটা অবশ্য আমার স্বামীর অবদান আছে। তিনি রায়পুর স্কুলে যাবার রাস্তা তারপর ঠাকুরকোণা থেকে রায়পুর যাবার রাস্তাটাও উনি সরকারের অনুমতি নিয়ে করে দিয়েছেন। আগে সারাদিন লাগতো বাড়ীতে পৌঁছুতে।। তখন আমার মা সুস্থ ছিলেন। জ্যাঠামশাই মামণি মানে আমার জ্যাঠিমা, আমার বাবা, মা সব ভাই বোন মিলে দূর্গা পূজোয় বাড়ীতে যেতাম। কী শান্তি , কী অনাবিল আনন্দ ছিলো তখন। এমন সুখস্মৃতি কী ভোলা যায়? পূজোর পর আবার নৌকা করে সবাই মিলে শহরের বাড়ীতে চলে আসতাম।

আজ খুব মনে পরছে ষষ্ঠী পূজোর কথা। অনেক বড় করে আমাদের বাড়ীতে নিয়ম করে ষষ্ঠী পূজো করতো। মামণি আর মা মিলে এই পূজোর আয়োজন করতেন। মনে পরে ঝাপসা স্মৃতিতে বটগাছ, আর কাঁঠাল গাছের ডাল ভেঙ্গে আনতো কার্তিকদা। পূজোর যত কিছু প্রয়োজন সব যোগাড় করতো কার্তিকদা। সে আমাদের গরু রাখতো।খুব ভালো ছিল।ওর চেহারাটা এখনও আমার মনে আছে। তার হাতে টাকা থাকলেই আমাকে এটা ওটা কিনে দিতো।

মনে পরে হাওয়াই মিঠাই খেলে বাবা, মা বকতেন। উনারা পছন্দ করতেন না। আর ঐদিকে কার্তিকদার হাতে পয়সা থাকলেই আমার জন্য চুপি চুপি নিয়ে আসতো। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে খেতাম।কিন্তু লুকিয়ে খেলে কী হবে? আমার ঠোঁটে, মুখে আঠা থাকতো তারপর আবার টকটকে গোলাপী হয়ে যেতো সারা মুখ। লুকানোর কোন পথই ছিলো না। বুঝতেই তো পারছো বন্ধুরা বকা কাকে বলে? আমার থেকে কার্তিকদা বকা খেতো বেশী। আর আমি তো তেল, সাবান কত কিছু দিয়ে হাওয়াই মিঠাইয়ের রং উঠানোর চেষ্টা কোরতাম কিন্তু উঠতো না।আসলে এই রংয়ের জন্যই খেতে বারণ করতন বাবা, মা। আরেকটা মজার ব্যাপার হলো কার্তিকদার বাবাই বিক্রি করতো এই হাওয়াই মিঠাই। ওর বাবার একটা পা ছিলো ছোট ।বাক্সটা কাঁধে নিয়ে বলতো একটা কিনলে একআনা,দুইটা কিনলে দুইআনা,তিনটা কিনলে আড়াই আনা।ওর বলার স্টাইল দেখেই পলকের মধ্যে বিক্রি হয়ে যেতো সব হাওয়াই মিঠাই।
ওমা! আমিতো পূজোর কথা বলতেই ভুলে গেছি। বন্ধুরা শোন, এই ষষ্ঠী পূজোয় বাড়ীতে যত লোক ছিলো সবার নামে নামে একেক জনের ষাটটি করে দূর্বার ভিতরে আরো কতকিছু দিয়ে আশীর্বাদ বনাতেন মা আর জ্যাঠিমা। মেয়েরা বাবার মাথায়, মায়েরা ছেলে,মেয়েদের মাথায় আশীর্বাদ ছোঁয়াবে।আবার আরো কাজ ছিলো সবার নামে যে দূর্বাগুলি বাঁধানো ছিলো। সেটা স্নান করে একটা পাত্রে জল নিয়ে সবার নামে নাভিতে দূর্বা দিয়ে ছোয়ায়ে মুখে ষাট ষাট বলতে হতো। একাজটা মেয়েরা মায়েরা করতো। ছেলেদের কোন কাজ নেই। জলের মধ্যে চন্দন দেয়া থাকতো।একবার জলে দূর্বাগুলি চুবিয়ে আবার নাভিতে।বলতে হতো বাবা ষাট, মা ষাট,জ্যাঠু ষাট মামণি ষাট। এরকম সবাই করতো।এই পাত্রে নানা ধরনের ফল থাকতো। তারপর তো ঠাকুর মশাই পূজো করতেন। সারাদিন আনন্দ আর আনন্দ। একজনের ফল আরেক জন খেতে পারতো না। এই পূজোটা হলো সন্তানদের আয়ুবৃদ্ধির জন্য। এর জন্য জামাই ষষ্ঠীতে জামাইকে নিমন্ত্রণ করতে হয়। জামাইএর যেনো শতায়ু হয়। শ্বাশুড়ি মা জামাইকে নতুন জামাকাপড় দিতেন আর আশীর্বাদ করতেন আর হাতে সবাইকে আশীর্বাদের সূতো বেঁধে দিতেন।বাড়ীর সবাই নতুন জামা কাপড় পরতাম আমরা।
কোথায় গেলো সেইদিন গুলো?
কিন্তু দুঃখের কথা যখন সবকিছু বুঝেছি তখন আর এই আনন্দ গুলি পাইনি। মা স্ট্রোক করে শয্যাগত হয়ে গেলেন। মামণি চলে গেলেন ভারতে, সব কিছু শেষ।
কত মুখ দেখি প্রতিদিন তোমায় কত খুঁজি মা গো তোমার মতো পাইনি তো কোথাও?
কত দেশ বিদেশে ঘুরি তোমাকে পাইনা।
তোমার গায়ের মিষ্টি গন্ধ আজো বহন করে চলেছি।
আজীবন আমার বুকের ভেতর থাকবে আমার সোনা মা।
যা কখনও ভুলতে পারবোনা।
ক্ষণে ক্ষণে ছবির মতো চোখের কোণে আসো।
আমি জানি মা তুমি আকাশের শ্রেষ্ঠ তাঁরাটিই হবে। তাইতো সেই তাঁরাটি এতো উজ্জ্বল বেশী।
এখনও না জেনে না বুঝে কত অন্যায় করি,ছেলেবেলার মতো শাসন পেতে সাধ জাগে।
আসল নকল ভালোবাসা কী জানিনা মা। তোমাদের মতো বাবা, মায়ের আশীর্বাদ আমার জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে।
হয়তো চলে যাবে বলেই অগ্রিম আাদর স্নেহ দিয়ে গেছো।
বাবা তুমি যে চেয়ারটিতে বসতে স্মৃতির চোখে ধরে রেখেছি থাকবে আজীবন।
পরজন্ম বলতে যদি কিছু থাকে তাহলে তোমাদের মতো বাবা, মা যেন আবার ফিরে পাই। আবার তোমরা ষষ্ঠী পূজোয় আমাদেরকে আশীর্বাদ করবে এই আশা নিয়েই আছি আমরা ভাই বোন।
আমাদের পরিবারের প্রায় সবাই স্বর্গবাসী হয়েছেন। আমার জন্য যত স্নেহ, আদর, ভালোবাসা, আশীর্বাদ সব আমার দাদার কাছে। আমার দাদা বৌদি ছাড়া আমার পরিবারের কেউ নেউ।
এই হলো আমার সুখ / দুঃখের স্মৃতিচারণ।