প্রচ্ছদ

টুকরো-টাকরা ভাবনা যত (১৯)

  |  ২০:৪৪, মে ১৭, ২০২০
www.adarshabarta.com

জীবন ও মৃত্যু বিষয়ক

মুহম্মদ আজিজুল হক

ফরমালিনের ভয়াবহ অভিশাপ থেকে নিজেকে আড়াল করার একটি প্রয়াস হিসেবে একটু বেশি খরচ হলেও ডালার ওপর শুইয়ে রাখা মরা মাছের বদলে আমি মাছ বিক্রেতাদের নিকট হতে সন্তরণরত তাজা মাছ কিনে থাকি। আজকাল কোনো কোনো মাছ-বাজারে টিনের তৈ্রী চৌবাচ্চায় রেখে তাজা মাছ বিক্রি করে কিছু কিছু মৎসবিক্রেতা। আবার কোনো কোনো বাজার নাকি ফরমালিনমুক্ত। ঢাকা সেনানিবাসের ক্রোড়ে অবস্থিত কচুখেত কাঁচা বাজার ফরমালিন থেকে অধিকতর নিরাপদ বোলে অনেকের বিশ্বাস। এক বন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলাম, কেন? সে বলেছিল যে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এখনো আমাদের বাঙ্গলি জনগোষ্ঠীর একটি সুবিশাল অংশের নিকট সুশীল ভাষা অপেক্ষা ডান্ডার ভাষা বেশি বোধগম্য। ট্রাফিক পুলিশের সম্মুখে অনেকেই ট্রাফিক রুলের তোয়াক্কা না করে গাড়ি চালান। ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে রাস্তায় আর্মি নামাও দেখবে কী শৃঙ্খ্লার সাথে সেই রুল ভঙ্গকারীরাই গাড়ি চালাচ্ছেন। অবশ্য, সুখের বিষয় এই যে, শিক্ষার দ্রুত প্রসারের ফলে প্রকৃ্ত শিক্ষিতের সংখ্যা ধীরে ধীরে হলেও বাড়ছে। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে কোলকাতা থেকে রেঙ্গুনগামী জাহাজে ইংরেজ সেকেন্ড অফিসারের লাথি খেয়েও বাঙ্গলি খালাসীদের হেসে লুটোপুটি খাওয়ার পর্যায় থেকে কিছুটা হলেও আত্মসম্মানবোধের দিকে অগ্রগতি হয়েছে বোলে আমি বিশ্বাস করি। আত্মস্মমানবোধসম্পন্ন লোকের সংখ্যা ধীরে ধীরে হলেও বৃ্দ্ধি পাচ্ছে। তাঁরা সুশীল ভাষা ব্যবহার করেন এবং অন্যের নিকট হতে তাই-ই প্রত্যাশা করেন। কচুখেত বাজারে ফর্মালিন-নিষিক্ত কোনো জিনিস বিক্রয়ে প্যাঁদানি খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই সেখানে কোনো বিক্রেতা ফর্মালিনযুক্ত কোনো দ্রব্য বিক্রয় করতে সাহস পান না। কচুখেত বাজার সম্পর্কে বন্ধুর এমন অভিমতের কারণে আমি কষ্টসাধ্য হলেও আমার বাসা থেকে বেশ দূরে অবস্থিত ঐ বাজারেই অধিকাংশ সময় কিচেন শপিং করতে যাই।
সেদিন তিন কেজি সোয়া তিন কেজি ওজনের একটি রুই মাছ দেখিয়ে বিক্রেতাকে মাছটি তুলতে বললাম। বিক্রেতা চৌবাচ্চা থেকে মাছটি তুলে কোমর সমান উঁচু একটি পাকা প্লাটফর্মের ওপর পাতা একটি অত্যন্ত ধারালো বড় বটিতে সেটি কাটতে বসলেন। মাছটি বেশ শক্তি নিয়ে ছটফট করায় আঁশ ফেলানোর পূর্বেই বিক্রেতা পিচ্ছিল মাছটির জোর কমানোর জন্য ওটির ঘাড় বরাবর বটি চালিয়ে অকস্মাৎ ওটির দেহ থেকে মস্তকটি বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। বটির পাশেই কর্তিত ঘাড়ের ওপর মস্তকটি খাড়া কোরে রাখা হোল। মাছের মুখটি তখন আকাশের দিকে। অমন কোরে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পরেও মাছটি বারংবার ওর মুখটি খুলছে আর বন্ধ করছে। জলে সন্তরণশীল মাছটিকে তুলে এনে হঠাৎ এমনিভাবে কেটে ফেলা হয়েছে যে মাছটির প্রাণ তা যেন তৎক্ষণাৎ বুঝে উঠতে পারে নি। তাই দ্বিখন্ডিত হবার পরেও মাছটির বিচ্ছিন্ন মস্তকে এবং মস্তকবিহীন শরীরে ছিল প্রাণের প্রবল স্পন্দন। ঝড়ের গতিতে একরাশ বেদনা কোথা থেকে ছুটে এল আমার হৃদয়ে। অনুভব করলাম কী সীমাহীন বেদনায় মাছটি বারবার হাঁ কোরে ব্যথা থেকে মুক্তি পাবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে; শরীর থেকে ব্যথা বের কোরে দেবার সে কী আপ্রাণ প্রচেষ্টা।
সৃষ্টিকর্তা এ সকল প্রাণীকে চীৎকার কোরবার কোনো শক্তি দেন নি। তাই দুর্বিষহ ব্যথা ও মৃত্যুযন্ত্রনা এরা নীরবে সহ্য করে; যেন তেমন কিছু হয় নি। বেদনায় চীৎকার করে কাঁদতে পারলে এদের আর্তচীৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠতো। মৃত্যযন্ত্রনাহত মাছটির উদ্দেশ্যে মনে মনে বললাম, হে মাছ, তোমাতে আমাতে কোনো ফারাক নেই। আমেরিকান ঔপন্যাসিক Ernest Hemingway কথিত ‘biological trap’ বা ‘জীবনের ফাঁদে’ পতিত আমরা সকলেই। জন্ম নিয়ে যে ভয়ানক পাপ করেছিলে মৃত্যুযন্ত্রনায় তারই প্রায়শ্চিত্ত করছো তুমি। “কুল্লু নাফসিন জাইকাতুল মাউত”, প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। কাজেই, আমরা কেউই এর ব্যতিক্রম নই। জন্মই আমাদের আজন্ম পাপ। জন্ম নিয়ে যে পাপ করেছি তার জন্য আমাকেও একদিন মৃত্যুর মাধ্যমে এমন প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। অথচ, আমরা কেউই এই জীবনের ফাঁদে স্বেচ্ছায় এবং সচেতনভাবে পা দিই নি; এবং ঠিক কখন, কোন্ মুহূর্তে, কিভাবে এই ফাঁদে ধরা পড়েছি তাও জানি না। ইংরেজ কবি Alfred Tennyson বলেছিলেন, “Nature, red in tooth and claw”, প্রকৃ্তির দন্ত ও নখর রক্তে রঞ্জিত। প্রকৃ্তিতে, ক্ষুদ্র চেলাজাতীয় মাছগুলিকে খায় ষোল-টাকিরা; আবার ঐ ষোল-টাকিদের খায় তাদের থেকে বড় বোয়াল ও অন্যান্য মাছেরা। নিরীহ হরিণকে বধ কোরে হিংস্র বাঘে খাচ্ছে। (আর আমরা মানুষেরা তো আরো বড় বাঘ।) প্রকৃ্তিতে একটি আরেকটিকে মেরে খেয়ে বাঁচছে –আর রক্তের ধারা অঝোরে ঝরছে।
আমি নাস্তিক নই; বরং আমি ভীষণভাবে আস্তিক। নাস্তিকদের অনেক বুদ্ধি। আঁতেল হবার পূর্বশর্ত নাস্তিকতা বোলে নাস্তিক আঁতেলগণ বিশ্বাস করেন। আমার অত বুদ্ধি নেই। আমার সরল ও সাধারণ বুদ্ধিতে আমি বিশ্বাস করি আসমান-জমিনে যা কিছু আছে তা এক ব্যাপক ও মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন। আর তার আড়ালে আছেন একজন অতিশয় সুদক্ষ মহাপরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারী। তাঁর মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি সবকিছু বাস্তবায়ন করেছেন। সেই পরিকল্পনা মানুষের বোধগম্যতার বাইরে। মানুষ “আশরাফুল মাকলুকাত” বা সৃষ্টির সেরা হলেও তাঁর বুদ্ধি, মেধা, প্রতিভা, প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও সৃজনশীলতা অসীম নয়, বরং অকল্পনীয়ভাবে সসীম। তবু মনের জলাভূমির তলা থেকে গ্যাসের বুদবুদের মতো মনে জাগে একটি দুঃসাহসিক প্রশ্নঃ এই পৃথিবীর প্রকৃ্তিকে, এর সকল প্রাণীর জীবন ও জীবিকার ধরণ, তাগিদ ও রীতিনীতিকে কেন একটু ভিন্নভাবে সাজালেন না অনন্ত ক্ষমতার অধিকারী ও অসীম বিশ্বের স্রষ্টা? তাহলে হয়তো জন্মকে আর আজন্ম পাপ বো্লে মনে হতো না। তাহলে হয়তো প্রকৃ্তির দন্ত ও নখরকে রক্তাক্ত দেখতে হতো না।

লেখক : কবি, সাবেক রাষ্ট্রদূত চীন