প্রচ্ছদ

আইসোলেশন, আইসোলেশন এবং আইসোলেশন

  |  ০৬:৫৮, মে ১৪, ২০২০
www.adarshabarta.com

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান

ফিফা’র ক্রমবিন্যাসে বাংলাদেশের অবস্থান ২০৮তম, আইসিসি’র ক্রমবিন্যাসে বাংলাদেশ নবম। করোনা শনাক্তকরণ টেস্টিং এ আমাদের অবস্থানও প্রায় একই পর্যায়ে। অনেক ম্যাচ খেলে আমাদের অবস্থান উন্নত করতে হবে। করোনাতেও অনেক টেস্ট করে আমাদের অবস্থান উন্নত করতে হবে। অতএব COVID-19 টেস্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছে, WHO বলেছ, সাথে সাথে টকশো’র বুদ্ধিজীবীরাও বলছে। যদিও নোয়াম চমোস্কি বলেছেন করোনার স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলা বিশেষজ্ঞদের কাজ, বুদ্ধিজীবীদের নয়। শুরুতে আমাদের IEDCR-এর একটি মাত্র কেন্দ্রে করোনা টেস্ট হত দিনে ১০০-২০০টি, যা ছিল একেবারেই অপ্রতুল। সবাই বললো টেস্ট বাড়াতে। বাড়ছেও ক্রমাগত। আজ পর্যন্ত ৪১টি কেন্দ্রে টেস্ট শুরু হয়েছে। এ সংখ্যা শীঘ্রই পঞ্চাশটি হয়ে যাবে। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে দৈনিক দশ হাজার বা তারও বেশি টেস্ট করা যাবে। গতকাল দেখলাম একজন বুদ্ধিজীবী বলেছেন দৈনিক এক/দুই লক্ষ টেস্ট করা দরকার। তাও হয়ত করবো, গুণীজনের পরামর্শ বলে মানতেই হবে।
আমি আগেও লিখেছিলাম টেস্টে শনাক্তকৃত রোগী এবং বিগত চৌদ্দ দিনে সে যাদের সংস্পর্শে এসেছিল তাদের শনাক্ত করে সমাজের বা পরিবারের অন্যান্যদের থেকে আলাদা না করা গেলে এই টেস্টের কোন তাৎপর্য নেই। কেবলমাত্র বিশ্ব টেস্ট র‌্যাংকিং এ এগিয়ে যাওয়া ছাড়া। এখন পর্যন্ত করোনার কোন স্বীকৃত ঔষধ নেই। উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা চলছে। যেমন নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা গেলে নিউমোনিয়ার চিকিৎসা, কিডনি সমস্যা হলে ডায়ালাইসিস, ডাইবেটিস মাত্রা ছাড়ালে ইনসুলিন প্রয়োগ। এই চিকিৎসা উপসর্গ দেখেই দেয়া যায়, প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ডায়গনস্টিক টেস্ট করা যেতে পারে। COVID টেস্ট লাগবে কেন? শুনেছি অন্যান্য কস্ট (Cost) বাদ দিয়ে কেবল মাত্র আর্থিক কস্টই (Price) নাকি তিন হাজার টাকা, এটা কেবলমাত্র কিটের দাম, যা এখন পর্যন্ত সরকারই বহন করছে। ল্যাব সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খরচ বাদই দিলাম। কিট উৎপাদনকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের মোড়লদের দিয়ে এ ব্যবসাটি চালাচ্ছে নাতো?

বিশেষজ্ঞ না হয়েও একথা বলার জন্য অনেকে বিরক্ত হবেন বা সমালোচনা করবেন জেনেও ঝুঁকি নিয়েই বলছি, শনাক্তকৃত রোগী ও তাঁর সংস্পর্শে আসা লোকদের জরুরি ভিত্তিতে সংঘনিরোধ না করা গেলে বন্ধ করা হোক এই টেস্ট ম্যাচ। উপসর্গ দেখে চিকিৎসা করুন। কিছুদিন আগেও অতিমাত্রায় টেস্ট দেয়ার জন্য আমরা চিকিৎসকদের কমিশন বাণিজ্য হয় বলে সমালোচনা করতাম। আগে চিকিৎসকরা এত টেস্ট দিত না। মেধাবী চিকিৎসকরা উপসর্গ দেখে চিকিৎসা করত। এখনো COVID টেস্ট না করা থাকলে উপসর্গ দেখে বা সহজে করা যায় এমন অন্যান্য কিছু টেস্ট করে চিকিৎসা দিন। সুস্থ হলে প্রয়োজনে এন্টিবডি টেস্ট করে HERD ইমিয়োনিটির দেয়াল তৈরির কাজে লাগান।

আর একটা কথা টকশো’র বুদ্ধিজীবীরা বলে বাংলাদেশ অনেক সময় পেয়েও প্রস্তুতি নেয়নি। সময়মত প্রস্তুতি নিলে আমরা বেঁচে যেতাম। আমাদের সরকারী কর্মকর্তা ও নেতারা প্রস্তুতি সম্পর্কে আগাম কিছু অতিকথন করে সবাইকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং টকশো’র বিষয়বস্তুর জোগান দিয়েছেন মাত্র। ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের উহানে প্রথম করোনা সনাক্ত হয়। জানুয়ারিতে বিশ্বকে সতর্ক করে WHO। জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমরা প্রস্তুতির সময় পেয়েছিলাম। এর পুরোটাই যদি আমরা সকল শক্তি সামর্থ্য ও মেধা দিয়ে প্রস্তুতি নিতাম তা হলে কী করতে পারতাম আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দ্বিগুণ, তিনগুণ বা তারও বেশি উন্নতি করতে? প্রস্তত হয়ে কি আমরা চীনের বা ইতালির স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমকক্ষ বা কাছাকাছি অবস্থানে যেতে পারতাম। চীনের মাথাপিছু স্বাস্থ্য খাত ব্যয় বাংলাদেশের দশগুণ, ইতালির ব্যয় চীনের সাতগুণ। ইতালিতে প্রতি এক হাজার জনের জন্য ডাক্তার ৪.১ জন; বাংলাদেশে ০.৫ জন। বাংলাদেশে প্রতি দশ হাজারের জন্য হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ৮টি, আমেরিকায় ২৯টি, আর চায়নায় ৪২টি। বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে ICU বেডের সংখ্যা ৪৩২টি (যার মধ্যে ১১০টি ঢাকায়), বেসরকারি হাসপাতালে ICU বেড আছে ৭৩৭টি। জরুরি পরিস্থিতিতে আরো শখানেক ICU বেড বর্তমানে যুক্ত হয়েছে।

সমগ্র জাতীর একমাত্র পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল (Full Market Coverage) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিমাসে ৫০০ রোগির ICU সেবার প্রয়োজন দেখা দেয়, সর্বোচ্চ ১০০ জনকে এ সেবা দেয়া যায়। স্বাভাবিক সময়েও একটি ICU-বেড পেতে পুরো ঢাকা শহর ঘুরতে হয়। পাঁচ থেকে দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ভেন্টিলেটরসহ ICU-বেড রাতারাতি বাড়ানো যায় না। পঞ্চাশ বছরে কেন বাড়েনি সেটা ভিন্ন আলোচনা। একাজের জন্য জনবল একেবারে নেই বললেই চলে। একই কথা, PCR মেশিন টাকা দিয়ে কেনা গেলেও টেকনিশয়ান নেই, গত ৮ বছরে কোন হেলথ টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেয়া হয়নি।

অতএব COVID টেস্ট চলছে লক্ষহীন ও মানহীনভাবে।এর সংখ্যা বাড়িয়েই সমস্যার সমাধান হবে না। সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে কিট বিক্রেতারা। যেমনটি পরীক্ষায় কার্যকারিতা নিশ্চিত হোয়ার আগেই Remdesivir তৈরি করে কয়েকটি ঔষধ কোম্পানি দাম হাঁকছে প্রতি ডোজ ৬,০০০ টাকা, একজনের পূর্ণাঙ্গ ডোজের জন্য খরচ হবে ৬০,০০০ টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রতি ডোজের দাম সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকা হওয়া উচিত, এ আর এক ‘বালিশ কাণ্ড’।

হাসপাতালে এবং টেস্টিং সেন্টারের দীর্ঘ লাইন কমানোর জন্য দুই-তিন জন ডাক্তারের সমন্বয়ে এক একটি স্কোয়ার্ড গঠন করে সার্বক্ষণিক গাড়ির সুবিধা দিয়ে করোনা উপসর্গ নিয়ে কোন রোগী ফোন করলে ঐ রোগীর বাড়িতে চলে যাবে। রোগীর বাড়ীতে গিয়ে তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের আইসোলেশনের বিষয়টি বুঝিয়ে দিবে এবং উপসর্গ অনুযায়ী কিছু ঔষধ দিয়ে আসবে। বাড়ীতে আইসোলেশনের সুযোগ না থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনের ব্যবস্থা করবে। আগে কখনো শ্বাসকষ্ট ছিল না কিন্তু নতুনভাবে সর্দি-শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাকে অক্সিজেন সুবিধা সম্বলিত হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অক্সিজেন সুবিধা নিশ্চিত করা গেলেই বেঁচে যাবে প্রাণ। ভেন্টিলেটর সাবার লাগবেও না। আর লাগলেও সকলের কাপালে তা জুটবে না।

এই নিয়ে হৈ চৈ করেও কোন লাভ নেই। আমাদের দেশে করোনা আক্রান্তদের শতকরা ১/২ ভাগের ভেন্টিলেটর লাগে। রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে এক শতাংশেরও ভেন্টিলেটর দেয়া সম্ভব হবে না। আমেরিকাতেও ভেন্টিলেটর থেকে ফিরে আসে প্রতি দশ জনে একজন।

অতএব টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট নয়। নিজেকে এবং অপরকে করোনাক্রান্ত ভেবে আইসোলেশন, আইসোলেশন এবং আইসোলেশন। সবকিছু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ বা ইউরোপ আমেরিকার মত করতে হবে কেন? মনে রাখতে হবে আমাদের কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কার নেটওয়ার্কটি বিশ্বের সেরা। ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যন্ত বিস্তৃত, যা পৃথিবীতে কোথাও নেই।

তাছাড়া দুর্যোগ মোকাবেলায় আমরা বিশ্বে অনুকরণীয়। গুড় আর লবণের মিশালে সররত বানিয়ে আমরা ডায়রিয়া মোকাবেলায় বিশ্বের রোল মডেল। করোনা বৈশ্বিক সমস্যা হলেও আমাদের সমস্যাটা আমাদের আর্থ-সামাজিক ও নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সংগতি রেখেই মোকাবেলা করতে হবে।বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন গতকাল বলেছেন, করোনার টিকা আবিষ্কারের কোন সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না। HIV ভাইরাসের ক্ষেত্রে যেমনটি হয়েছে। পৃথিবীতে মাত্র ২৫টি রোগের টিকা ব্যবহৃত হয়। বাকী রোগগুলো নিয়েই মানুষ টিকে আছে। আমাদেরও আমাদের মত করে টিকে থাকতে হবে।

লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়