প্রচ্ছদ

১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ

  |  ১৪:৫২, জানুয়ারি ১০, ২০২১
www.adarshabarta.com

:: অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান ::

প্রজাতন্ত্রের দৃঢ় ভিত্তি-১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টেলিভিশনে প্রচারিত ‘ডেভিড ফ্রস্ট প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যথার্থ নেতৃত্ব আসে সংগ্রাম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কেউ আকস্মিকভাবে একদিনে নেতা হতে পারে না। তাকে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। তাকে মানুষের মঙ্গলের জন্য নিজকে উৎসর্গ করতে হয়। নেতার আদর্শ থাকতে হয়। এসব গুণ যার থাকে, সেই নেতা হতে পারে। আমি আব্রাহাম লিংকনকে স্মরণ করি। স্মরণ করি মাও সে-তুং, লেলিন, চার্চিলকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট জন. এফ. কেনেডিকেও আমি শ্রদ্ধা করি। … মহাত্মা গান্ধী, প-িত জহরলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, কামাল আতাতুর্ক এঁদের জন্য আমার মনে গভীর শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। আমি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামী নেতা ড. সুকর্ণকে বিশেষ শ্রদ্ধা করি। এরা সকলেই তো সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নেতা হয়েছিলেন।’ ইংরেজ কবি ও প্রাবন্ধিক টি. এস. এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫) বলেছেন- ‘প্রত্যেক জাতিকে মুক্তির দীর্ঘ প্রহর গুণতে হয়, একটি জাতির শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা পুরানো প্রথা ভেঙে অবিস্মরণীয় দীপ্ত বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বেরিয়ে আসে এবং সে নেতৃত্ব একটা জাতিকে শৃঙ্খলমুক্ত করে।’ রুশ দার্শনিক প্লেখানভ (১৮৫৬-১৯১৮) মনে করেন, ‘ইতিহাসের বিষয়বস্তু সাধারণ মানুষ হলেও ইতিহাসের নিয়ন্ত্রক ও ¯্রষ্টা একক কোনো নেতা’।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের সেই মহান নেতা। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা বা স্বাধীনতার চেতনা বলতে যা বুঝায় তার কোনকিছুই ছিল না। বাঙালি জাতিসত্তা কখনো স্পষ্ট রূপ নেয়নি। একমাত্র ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এই জনপদে ও বাঙালির ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ রাষ্ট্রের স্থপতি। জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ হেগেলের (১৭৭০-১৮৩১) ভাষায়- ‘মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।’ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিল ইতিহাসের অনিবার্য উপাদান। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে বন্দি থাকলেও তাঁর নামেই ন’মাস মুক্তিযুদ্ধ চলে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকারও বঙ্গবন্ধুকে প্রধান করেই গঠন (১৭ এপ্রিল, ১৯৭১) করা হয়েছিল। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরও বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকার মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সে শঙ্কা দূরীভূত হয়। বিখ্যাত ব্রিটিশ পত্রিকা ঞযব এঁধৎফরধহ-এ ১০ জানুয়ারি জবপড়মহরুব ইধহমষধফবংয ঘড়ি শীর্ষক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়- ‘ঙহপব ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ ংঃবঢ়ং ড়ঁঃ ড়ভ উধপপধ অরৎঢ়ড়ৎঃ, ঃযব হবি ৎবঢ়ঁনষরপ নবপড়সবং ধ ংড়ষরফ ভধপঃ’। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি ঘবংিবিবশ ম্যাগাজিনের ভাষায় ‘চড়বঃ ড়ভ চড়ষরঃরপং’ মুজিবের অমর কাব্য। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বঙ্গবন্ধুর জীবনীকার ওবায়েদ-উল হকের (১৯১১-২০০৭) ভাষায়- ‘যদি বাংলাদেশ একটি মানুষের দৈহিক আকৃতি পায়, তা হবে দেখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মত।’ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়েছে, কিন্তু তা ছিল অসম্পূর্ণ। ৮ জানুয়ারি খবর এলো বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে খুব ভোরে লন্ডন পৌঁছেছেন। বিশেষ উড়োজাহাজটি হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ না করা পর্যন্ত ঢাকা অথবা নয়াদিল্লির কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর গন্তব্য সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। কারণ, বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিশেষ বিমানটি রাওয়ালপি-ি ত্যাগ করার কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত এর গন্তব্যের কোনো খবর ছিল না। রেডিও পাকিস্তানের খবরে বলা হয়েছিল যে, পাকিস্তান সরকারের চার্টার্ড করা বিশেষ বিমানে শেখ মুজিব পাকিস্তান সময় ভোর তিনটায় রাওয়ালপি-ি ত্যাগ করেছেন। রেডিওর ঘোষণায় আরও বলা হয়, শেখ মুজিবের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর গন্তব্য গোপন রাখা হচ্ছে। রেডিও পাকিস্তানের অতিরিক্ত তথ্য ছিল যে নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপি-ি বিমানবন্দরে শেখ মুজিবকে বিদায় সংবর্ধনা জানিয়েছেন। পরবর্তীতে স্যার ডেভিড ফ্রস্টকে (১৯৩৯-২০১৩) দেয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু ভয়াবহ তথ্য প্রকাশ করেন যা ভুট্টো নিজে তাঁকে জানিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর নিকট আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা না করে সবচেয়ে বড় ভুল করেছি।’ ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে আরও জানান, ইয়াহিয়া তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে ব্যাকডেটে একটি আদেশ দেখিয়ে মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি দেয়ার অনুমতি দেয়া হোক।’ ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ভুট্টো তার জবাবে কি বলেছিল, সে কথা কি আপনি জানেন? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন- ভুট্টো বলেছিল, ‘আমি এটা করতে দিতে পারি না। কেননা তখন এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হবে … তাহলে আর কোনোদিন বেঙ্গল থেকে একজনও পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে আসতে পারবে না।’ উল্লেখ্য, এ সময় এক লাখ কুড়ি হাজার সামরিক বাহিনীর সদস্য ও বেসামরিক ব্যক্তি বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর হাতে আটক ছিল। তাছাড়া কয়েক লক্ষ অবাঙালি বাংলাদেশে বসবাস করত। ৮ জানুয়ারি রাতে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ-এর সঙ্গে এক ঘণ্টাকাল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাজ্য কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিষয়টি উত্থাপন করেন। পাকিস্তানে বন্দি অবস্থায় তাঁর জীবন রক্ষার প্রচেষ্টার জন্য বঙ্গবন্ধু এডওয়ার্ড হিথকে ধন্যবাদ জানান।

৯ জানুয়ারি টেলিফোনে ইন্দিরা গান্ধী-বঙ্গবন্ধুর মধ্যে আধাঘণ্টা আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানালেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং অনুরোধ করলেন, ঢাকার পথে যেন তিনি দিল্লিতে যাত্রা বিরতি করেন। বঙ্গবন্ধু আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। ইন্দিরা গান্ধী প্রথমে ভারতীয় ভিআইপি বিমানের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু হিথের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে তিনি জানালেন হিথ ব্রিটিশ এয়ার ফোর্সের জেটে করে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা পৌঁছে দেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। তাই ভারতীয় বিমান প্রেরণের পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে। ব্রিটেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলেও তাদের বিমানযোগে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা পাঠানোর বন্দোবস্ত করলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। এটাই ছিল এক ধরনের স্বীকৃতি। ইন্দিরা-হিথ আলোচনা করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আসলে তাঁরা উভয়েই চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সুস্থ শরীরে বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি গড়ে তুলুক। সাইপ্রাস-ওমান হয়ে দিল্লিতে বিমান অবতরণ করে। ১১ জানুয়ারি প্রকাশিত দিল্লির ঊীঢ়ৎবংং পত্রিকার বিবরণ অনুযায়ী ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ বিমানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন এবং সেখানে কয়েক মিনিট অবস্থান করেন। এবার এলো সেই কাক্সিক্ষত মুহূর্ত। প্রায় কালো ধূসর ওভারকোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু বিমানের সিঁড়ি বেয়ে নামলেন। …প্রেসিডেন্ট শ্রী ভরাহগিরি ভেঙ্কট গিরি যখন বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যখন তাঁকে স্বাগত জানাচ্ছিলেন তখন ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানানো হচ্ছিল। শুভেচ্ছা বিনিময় পর্ব শেষ হলে বঙ্গবন্ধু তিন বাহিনীর ১৫০ সদস্যের গার্ড অব অনার পরিদর্শন করেন এবং পরে ভিআইপি প্যান্ডেলে যান যেখানে তাঁর উপর গাঁদাফুলের পাপড়ি বর্ষণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু অভিবাদন মঞ্চে অবস্থান গ্রহণের সাথে সাথেই একটি গুর্খা বাদক দল বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত “আমার সোনার বাংলা……” বাজাতে শুরু করে। নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে প্রদত্ত ভাষণে প্রেসিডেন্ট ভি.ভি. গিরি বলেন, ‘মহোদয়, এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দেশের প্রধান হিসেবে আপনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এই অঞ্চলে স্থায়ী ও অটুট শান্তি প্রতিষ্ঠার, প্রত্যাশা ও সম্ভাবনা জোরদার এবং সুনিশ্চিত করবে।’ প্রেসিডেন্ট গিরির স্বাগত ভাষণের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমার জন্য এই ক্ষণ অত্যন্ত আনন্দের। বাংলাদেশে ফেরার পথে আমি আপনাদের মহান দেশের এই ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাত্রাবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ, আপনাদের মহিমান্বিত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন এই সরকার ও ভারতের জনগণ যাঁরা আমার জনগণের উত্তম বন্ধু তাঁদের প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এটি হলো আমার ন্যূনতম করণীয়। …নয় মাস পরে আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় আমি অবশেষে ফিরে যাচ্ছি। এই নয় মাসে আমার জনগণ বহু শতাব্দী অতিক্রম করেছে।” নয়াদিল্লির জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জনগণের নিকট স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং তিনি তা তাঁদের এনে দিয়েছেন। ভারত অঙ্গীকার করেছিল বাংলাদেশকে মুক্ত করবে, মুজিবকে মুক্ত করবে, এবং সবশেষে শরণার্থীদের তাদের ভিটেমাটিতে পাঠিয়ে দেবে। তিনি বলেন, “আমাদের প্রতিশ্রুতি আমরা পালন করেছি।” নয়াদিল্লির বিশাল জনসভায় জনতার উদ্দেশে আবেগজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, “বাংলাদেশ ও তার জনগণ আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, সরকার, সশস্ত্রবাহিনীর বীর সদস্যবৃন্দ এবং আপনাদের সাধারণ মানুষকে কোন দিনই ভুলতে পারবে না, যাঁরা তাদের দুঃখ-দুর্দশায় এবং সংগ্রামে সর্বাত্মক সহানুভূতি প্রদর্শন ও সমর্থন দান করেছেন। ২০টিরও অধিক দেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধিবৃন্দ যাঁদের অধিকাংশই রাষ্ট্রদূত, বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। সবচেয়ে বেশি প্রতিনিধি ছিলেন সোভিয়েত ব্লকের। ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইতালি, পশ্চিম জার্মানি, নরওয়ে এবং ডেনমার্কের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। বিমানবন্দরের অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও আরবদের কোন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। নয়াদিল্লির জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ ইংরেজিতে শুরু করেছিলেন। শুরুতে জনতার মধ্য থেকে চিৎকার ভেসে আসে বাংলায় বলার জন্য। হাসি দিয়ে সম্মতি প্রকাশ করে তিনি তাঁর মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দিতে শুরু করেন। আর জনতা মহোৎসাহে তাদের সমর্থন জানায়। আনুষ্ঠানিকতার পর ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে যান বঙ্গবন্ধু। দিল্লি অবতরণের পূর্বেই বিমানে থাকা অবস্থায় তাঁর সফরসঙ্গী ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা শশাঙ্ক এস. ব্যানার্জির মাধ্যমে ভারতকে জানিয়ে দিয়েছিলেন ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা বঙ্গবন্ধুর কাছে সবচেয়ে জরুরি। পরামর্শকদের সাথে আলোচনার শুরুতেই ইন্দিরা গান্ধী জানালেন মুজিবের প্রস্তাবে তিনি রাজি। যথাসময়ে ইন্দিরা-মুজিব বৈঠক শুরু হল। ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি ইন্দিরা-মুজিব যৌথ ইশতেহারে স্থান পেল। প্রথমে কথা ছিল ভারতের সৈন্য প্রত্যাহারের তারিখ হবে জুন, ১৯৭২। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় তা হল মার্চ, ১৯৭২।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বিকালে বঙ্গবন্ধু লন্ডন দিল্লি হয়ে প্রাণের শহর ঢাকা ফিরে আসেন বেলা ১টা ৪১ মিনিটে। ঢাকায় অবতরণের পূর্বে কমেট বিমানটি বঙ্গবন্ধুর অভিলাষের প্রতি শ্রদ্ধাবশত প্রায় ৪৫ মিনিট বিমানবন্দরের উপর চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। ওপর থেকে তাঁর “সোনার বাংলা”কে অবলোকন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। অভ্যর্থনায় অনেক কূটনীতিক আসলেও চীন ও ইরানের কনসাল জেনারেলদ্বয় অনুপস্থিত ছিলেন, তবে যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হার্বার্ট ডি. স্পিভাক এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে করমর্দন করার সময় সৌজন্য প্রকাশের জন্য সামান্য অবনত হন এবং বলেন “ঢাকায় স্বাগতম”। বঙ্গবন্ধু হেসে উত্তর দেন, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ”। বিমানবন্দর থেকে লাখো জনতার ভিড় ঠেলে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসতে। সেদিন রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন, তাঁর দুই চোখ গড়িয়ে অশ্রু পড়ছিল বারবার। তিনি কান্নারত কণ্ঠে বলেন, “বিশ্বকবি তুমি বলেছিলে সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি, বিশ্বকবি তোমার সেই আক্ষেপ মিথ্যা প্রমাণিত করে সাত কোটি বাঙালি যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে।” আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার মত করে নির্মিত ১০০ ফুট দীর্ঘ মঞ্চ থেকে ৩৫ মিনিটের ভাষণে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম, তোমরা আমাকে মারতে চাও মেরে ফেলো। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালিদের কাছে ফিরিয়ে দিও…। আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল, জীবন দেবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম। বলেছিলাম আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, মানুষ একবারই মরে… মরার আগে বলে যাব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, জয় বাংলা…।’ বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, গত ৭ মার্চ আমি এই রেসকোর্সে বলেছিলাম ‘দুর্গ গড়ে তোলো’। আজ আবার বলছি আপনারা একতা বজায় রাখুন। আমি বলেছিলাম, ‘বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো “ইনশাল্লাহ”। বাংলাদেশ আজ মুক্ত স্বাধীন। …আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয় নেতা হিসেবে নয় আপনাদের ভাই হিসেবে বলছি …যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায় তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে- পূর্ণ হবে না। …বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মীয় ভিত্তি হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।

জনসভা শেষে তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে পৌঁছালে এক আবেগঘন পুনর্মিলনের দৃশ্য লক্ষ করা গেল। ১১ জানুয়ারি, ১৯৭২ দৈনিক আজাদে প্রকাশিত শওকত আনোয়ারের বর্ণনা মতে, ‘সকাল থেকেই ভিন্ন মেজাজে ছিল ঐ বাড়ীর সবাই। বাড়ীর সব ছোটমণিদের হাতে ছিল লাল ফুল। আর রাসেলই (১৯৬৪-১৯৭৫) ছিল এই ফুলকলিদের মেলার মধ্যমণি। ‘আব্বু আসবে’ তাই রাসেলের আনন্দ ধরে না। বেতার ধারা বিবরণীতে বিমানের নিরাপদ অবতরণের খবর প্রকাশের পর বেগম মুজিব একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। …বেতার ধারা বিবরণীর প্রতিটি শব্দ যেন তাঁরা হৃদয় দিয়ে শুনেছেন। ….বাসায় টেলিভিশন ছিলো না। তাই বেতার ধারা বিবরণীই ছিলো তাঁর মুহূর্তগুলো ধরে রাখার একমাত্র অবলম্বন। …সন্ধ্যে পৌনে ছ’টায় স্বাধীন বাংলার পতাকাবাহী একটি সাদা ক্যাডিলাক গাড়ি প্রবেশ করল এই বাড়ীর প্রবেশ দ্বারে গাড়ির দ্বার খুলে গেল। নেমে এলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব…। বন্ধু-বান্ধবরা যখন তাঁর ওপর ফুলের পাপড়ি বর্ষণে ব্যস্ত তখন তিনি তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরেন। এরপর তিনি তাঁর ৯০ বছর বয়স্ক পিতার সামনে হাঁটু গেড়ে বসেন এবং তাঁকে কদমবুচি করেন। আর ৮০ বছর বয়স্কা মা এসে ঘরে ঢুকলে তিনি তাঁকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দুইমাসের মধ্যেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী মিত্রবাহিনীর সদস্যরা ভারতে ফিরে যায়। ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ ঢাকা স্টেডিয়ামে ভারতীয় বাহিনীর আনুষ্ঠানিক বিদায়ী কুচকাওয়াজ হয়। এই কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর শেষ দলটির বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। এখন চলছে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে মুক্তির সংগ্রামের কথা বলেছিলেন তা ছিল মূলত অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। যে সংগ্রামে বর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। ২০৪১ সালে আমরা ধনী ও সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হবো এ লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে বর্তমান সরকার। এর মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ হবে; সাফল্য আসবে আমাদের মুক্তির সংগ্রামের। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ ১০ জানুয়ারি বক্তৃতার শেষের দিকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায় তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম তাঁর প্রাণ দেবে। … একজন বাঙালিরও প্রাণ থাকতে স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না।’ ১৯৭১-এ পরাজিত দেশি-বিদেশী শক্তি এখনও আমাদের মহান স্বাধীনতা নিয়ে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করছে। এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই আমাদের মুক্তির সংগ্রাম নিরন্তন চালিয়ে যেতে হবে।

লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।