প্রচ্ছদ

করোনাভাইরাস: কবে আসবে ভ্যাকসিন, বিশ্বের কোন দেশের প্রস্তুতি কেমন?

  |  ০১:১৪, এপ্রিল ২৫, ২০২০
www.adarshabarta.com

আদর্শ বার্তা ডেস্ক :

করোনাভাইরাস যতো বেশি এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে ছড়াচ্ছে, ততোই দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে সে তার জিনের গঠন বদলে চলেছে। এমন ভাইরাসকে আটকাতে গেলে তার প্রতিরোধী ভ্যাকসিন বা ড্রাগ দরকার। মারণ ভাইরাসকে মানুষের শরীর থেকে পুরোপুরি নির্মূল করতে হলে দরকার শক্তিশালী ভ্যাকসিন বা অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ। এমনটাই বলছেন বিজ্ঞানীরা।

ভ্যাকসিন বা টিকা মানুষের শরীরে সংক্রামক জীবাণুর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। তার জন্য হয় আস্ত ভাইরাস (নিষ্ক্রিয়) বা তার কোনো অংশকে ল্যাবরেটরিতে বিশেষ উপায় পরিশুদ্ধ করে মানুষের শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কাজ হয় অনেকটা বিষে বিষে বিষক্ষয়ের মতো।

ভাইরাল প্রোটিন শরীরে ঢুকলেই, শরীর তার প্রতিরোধের জন্য ‘মেমরি বি সেল’ তৈরি করে। এই মেমরি বি সেল দেহকোষকে অ্যান্টিবডি তৈরিতে উদ্দীপিত করে। আরও একটা কাজ হয় এই মেমরি বি সেলের। সেটা হল শরীরকে সংক্রামক ভাইরাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে রাখা। ভবিষ্যতে এই জাতীয় ভাইরাস শরীরে হানা দিলে যাতে তার উপযোগী অ্যান্টিবডি শরীর নিজেই তৈরি করতে পারে। এটা হল ভ্যাকসিনের কাজ। এমন ভ্যাকসিন বানাতেই মাথা ঘামাচ্ছে গোটা বিশ্ব।

এই ভাইরাসের প্রতিষেধক বের করতে হলে তার চরিত্র আগে বুঝে নিতে হবে। আরএনএ ভাইরাস বিটা-করোনার ভাইরাল স্ট্রেন সার্স-কভ-২ এর মানুষের শরীরে ঢোকার মূল অস্ত্র হল তাদের ওই কাঁটার মতো স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন। এর সাহায্যে মানুষের দেহকোষের প্রোটিন এসিই-২ (অ্যাঞ্জিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২)-এর সঙ্গে জোট বেঁধে শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে এরা। এখন ভ্যাকসিনের কাজ হবে দুটো—এক, এই জোট বাঁধার প্রক্রিয়াকে ভেঙে দেওয়া। দুই, অ্যান্ডিবডি তৈরি করে ভাইরাল প্রোটিনগুলোকে নিষ্ক্রিয় করা ও শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো।

বিশ্বের কোন কোন দেশ বানাচ্ছে করোনার ভ্যাকসিন এবং কিভাবে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের তত্ত্বাবধানে ম্যাসাচুসেটসের বায়োটেকনোলজি সংস্থা মোডার্না বানাচ্ছে এমআরএনএ-১২৭৩ ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিনের প্রথম ট্রায়াল হয়েছে মানুষের শরীরে। মেসেঞ্জার আরএনএ বা এমআরএনএ সিকুয়েন্সকে কাজে লাগিয়েই এই ভ্যাকসিন বানানো হয়েছে। এমআরএনএ হল শরীরের বার্তাবাহক। কোন কোষে প্রোটিন তৈরি হচ্ছে, কোথায় কী রাসায়নিক বদল হচ্ছে সবকিছুর জিনগত তথ্য বা ‘জেনেটিক কোড’ জোগাড় করে সেটা শরীরের প্রয়োজনীয় জায়গায় পৌঁছে দেওয়া।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন বার্তাবাহক এমআরআনএ-কেই ভ্যাকসিন তৈরির ভিত হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এই ভ্যাকসিনের কাজ হবে শরীরের কোষগুলোকে অ্যান্টি-ভাইরাল প্রোটিন তৈরি করতে উত্‍সাহ দেওয়া। ব্রিটেন জেন্নার ইনস্টিউট ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির যৌথ উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছে কভিড-১৯ প্রতিরোধী ভ্যাকসিন ChAdOx1 nCoV-19। ইংল্যান্ডের থেমস ভ্যালিতে এই ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হবে ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী ৫০০ জনের ওপরে।

এই গবেষণার নেতৃত্বে রয়েছেন অধ্যাপক-বিজ্ঞানী সারা গিলবার্ট, অধ্যাপক অ্যান্ড্রু পোলার্ড, টেরেসা লাম্বে, ডক্টর স্যান্ডি ডগলাস ও অধ্যাপক অ্যাড্রিয়ান হিল। অ্যাডেনোভাইরাল ভ্যাকসিন ভেক্টর ও সার্স-কভ-২ ভাইরাল স্ট্রেনের স্পাইক প্রোটিনকে কাজে লাগিয়ে এই ভ্যাকসিন ChAdOx1 nCoV-19 তৈরি করা হয়েছে। দেহকোষের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে এই ভ্যাকসিন।

অস্ট্রেলিয়া দেশটির তিন বিজ্ঞানী কেইথ চ্যাপেল, পল ইয়ং এবং ট্রেন্ট মুনরোর উদ্যোগে ইউনিভার্সিটি অব কুইনসল্যান্ডের এবং ন্যানোটেকনোলজি ল্যাবে তৈরি হচ্ছে ‘এস স্পাইক’ ভ্যাকসিন। ২৫০ ফর্মুলার ট্রায়াল করে এই ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা যা অ্যামাইনো অ্যাসিডের সিকুয়েন্স যা ভইরাল প্রোটিনকে নিষ্ক্রিয় করে দেবে।

নভেল করোনাভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরি করে ভ্যাকসিন বানাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ার রয়্যাল মেলবোর্ন হাসপাতালের ডাক্তার, পিটার ডোহার্টি ইনস্টিটিউটের ভাইরাস আইডেন্টিফিকেশন ল্যাবোরেটরির প্রধান ড. জুলিয়ান ড্রুস এবং ডোহার্টি ইনস্টিটিউটের ডেপুটি ডিরেক্টর ড. মাইক ক্যাটন। ডাক্তার মাইক ক্যাটন বলেছেন, রয়্যাল মেলবোর্ন হাসপাতালে ভাইরাস আক্রান্ত এক রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে সেখান থেকেই করোনাভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্স করা হয়।

হংকং হংকং ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের বানানো টিকা ইনফ্লুয়েঞ্জা ও করোনাভাইরাসের প্রভাব নির্মূল করবে বলেই দাবি করা হচ্ছে। হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্সের ডেটা সায়েন্টিস্ট ম্যাথেউ ম্যাককে এবং আহমেদ আবদুল কাদির বলেছেন, সার্স ভাইরাসের বি ও টি সেল এপিটোপ বার করা হয়েছে, এমন প্রোটিন ফ্র্যাগমেন্ট বার করা হয়েছে যা সার্স-সিওভি-র সংক্রমণ রুখতে পারে। শরীরের প্রতিরোধ শক্তিও বাড়ায়।

চীন দাবি করেছে তাদের দু’রকম ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হবে মানুষের শরীরে। একটি ভ্যাকসিন বানানো হয়েছে বেইজিংয়ে সিনোভ্যাক বায়োটেকে। এই ভ্যাকসিন তৈরির কাজে সাহায্য করেছে চীনের ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রুপের অধীনস্থ উহান ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্ট। বিজ্ঞানীদের দাবি, এই ভ্যাকসিনের দেহকোষে এমন শক্তিশালী অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে যা ভাইরাল প্রোটিনগুলোকে দেহকোষের বাহক প্রোটিনের সঙ্গে জোট বাঁধতে দেয় না। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়। জার্মানি ফার্মাসিউটিক্যাল কম্পানি ফাইজারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চলছে দেশের অন্যতম বড় বায়োটেকনোলজি ফার্ম বায়োএনটেকে। এই গবেষণার নেতৃত্বে রয়েছেন অধ্যাপক উগার সাহিন। তিনি বলেছেন, বিএনটি১৬২ আসলে ভ্যাকসিন ক্যানডিডেট। ল্যাবরেটরিতে এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সফল। তাই হিউম্যান ট্রায়াল শুরু করা হবে খুব তাড়াতাড়ি।

কভিড ভ্যাকসিন বানাচ্ছে জনসন অ্যান্ড জনসন। বায়োমেডিক্যাল অ্যাডভান্সড রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটির যৌথ উদ্যোগে এই ভ্যাকসিন তৈরি করছে জনসন অ্যান্ড জনসনের রিসার্চ উইং জ্যানসেন ফার্মাসিউটিক্যাল কম্পানি। জানুয়ারি থেকেই ভ্যাকসিন বানানোর কাজ শুরু করেছে জনসন অ্যান্ড জনসন। এই কাজে তাদের সহায়তা করেছে হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ভাইরাল প্রোটিনকে শনাক্ত করে ভ্যাকসিন ক্যানডিডেটের ডিজাইন বানানো হয়। এই ভ্যাকসিন দেহকোষের প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে তুলবে বলেই দাবি। সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মানুষের ওপর এই ভ্যাকসিনের ট্রায়াল শুরু হতে পারে সেপ্টেম্বরেই।

ডিএনএ ভ্যাকসিন কভিড-১৯ সংক্রমণ রুখতে নতুন ধরনের ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে পেনসালিভানিয়ার বায়োটেক ফার্ম ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যালস। সংস্থার পক্ষে এরই মধ্যে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়েছে, তাদের গবেষণাকে অনুমোদন করেছে মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। ইনোভিও বায়োফার্মের ভ্যাকসিন গবেষণায় র্থিক অনুদান দিয়েছে বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এবং কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস। আরএনএ ভাইরাস বিটা-করোনার সংক্রামক ভাইরাল স্ট্রেন সার্স-কভ-২ এর ভাইরাল প্রোটিনকে নিষ্ক্রিয় করতে পারবে এই ডিএনএ ভ্যাকসিন, এমনটাই দাবি ইনোভিও বায়োফার্মের গবেষকদের।

ভ্যাকসিন বানাচ্ছে ইউনির্ভাসিটি অব পিটসবার্গ স্কুল অব মেডিসিন। ভ্যাকসিন ক্যানডিডেটের ক্লিনিকাল ট্রায়াল ইঁদুরের ওপর সফল বলেই দাবি করেছেন ইউনির্ভাসিটি অব পিটসবার্গ স্কুল অব মেডিসিনের গবেষকরা। এই ভ্যাকসিন ইঁদুরের শরীরে সার্স-কভ-২ প্রতিরোধী শক্তিশালী অ্যান্টিবডি তৈরি করেছে। এই ভ্যাকসিনের নাম পিটসবার্গ করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন । ভাইরোলজিস্ট লুইস ফালো বলেছেন, সার্স-কভ-২ ভাইরাল প্রোটিনগুলোকে শনাক্ত করে ল্যাবেই এমন ভাইরাল প্রোটিন বানানো হয়েছে যা দেহকোষে শক্তিশালী অ্যান্টিবডি তৈরি করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে।

করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে জোরদার গবেষণা চলছে ভারতেও। কভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চলছে দেশটির দুই বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কম্পানি ক্যাডিলা হেলথকেয়ার ও ভারত বায়োটেকে। ক্যাডিলাতে দু’রকম ভ্যাকসিন ক্যানডিডেট নিয়ে কাজ হচ্ছে। রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ টেকনোলজিতে ভ্যাকসিন ক্যানডিডেট বানানো হচ্ছে এবং রিভার্স জেনেটিক টেকনোলজিতে সার্স-কভ-২ এর মতোই (তবে কম ক্ষমতার) ভাইরাল স্ট্রেন তৈরি করে তার উপযোগী অ্যান্টিবডি বানানোর প্রক্রিয়া চলছে।

ভেক্টর ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চলছে ভারত বায়োটেকে। নিষ্ক্রিয় রেবিস ভাইরাসকে ভেক্টর বানানো হয়েছে। যার মাধ্যমে সার্স-কভ-২ ভাইরাল স্ট্রেনের জেনেটিক সিকুয়েন্স পাঠিয়ে তার উপযোগী অ্যান্ডিবডি তৈরির চেষ্টা চলছে এই সংস্থায়।

গবেষকরা বলছেন ভ্যাকসিন তৈরি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। প্রথমে ভাইরাল প্রোটিন শনাক্ত করা, তারপর তাকে পিউরিফাই করাটাই দীর্ঘ সময়ের কাজ। এরপরে ল্যাবে কৃত্রিম দেহকোষ বানিয়ে অথবা পশুদের ওপরে ট্রায়াল করা হয় এই ভ্যাকসিন ক্যানডিডেট। ট্রায়ালেরও অনেকগুলো পর্যায়ে আছে। বারে বারে নিশ্চিত হওয়ার পরেই মানুষের ওপরে পরীক্ষা করে দেখা হয়। ভ্যাকসিনের সুরক্ষারও দিকটাও জরুরি বিষয়। ল্যাবে ইঁদুর বা ওই জাতীয় প্রাণীর শরীরে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল সফল হলেও দেখা যায় মানুষের শরীরে তার প্রভাব কার্যকরি নয়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয়ও রয়েছে। আর এই ভাইরাস যেহেতু জিনের গঠন অনেকবার বদলে ফেলেছে, তাই ভ্যাকসিনের প্রতিরোধী উপায়ও ভাইরাস বার করে ফেলেছে কিনা সেটাও দেখার বিষয়।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই বছরের শেষের দিকে মানুষের ওপর ট্রায়াল করে ফেলা সম্ভব হবে। বাণিজ্যিকভাবে ভ্যাকসিন বাজারে আসতে সময় লাগবে আরও এক বছর। তবে কোনো কোনো সংস্থা দাবি করেছে, ২০২১ সালের শুরুতেই তারা ভ্যাকসিন পৌঁছে দিতে পারবে দেশের নানা প্রান্তে।

গবেষকরা বলছেন, প্রাথমিক পর্যায়ে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনের জন্য বেছে নেওয়া হতে পারে। এই ভাইরাসের প্রকৃতি বুঝে বয়স্ক, ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মী যাদের প্রাণের ঝুঁকি বেশি, সঙ্কটাপন্ন রোগী ও শিশুদের প্রথম ভ্যাকসিন দেওয়া হতে পারে। এক শ্রেণির লোকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়লে ভাইরাস আর নতুন শরীর চট করে খুঁজে পাবে না। একটা পর্যায়ের পরে তার সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতা কমবে। ধীরে ধীরে ভাইরাল স্ট্রেনগুলোও নিষ্ক্রিয় হতে শুরু করবে।

সূত্র: দ্য ওয়াল।