প্রচ্ছদ

আবারও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি

  |  ০১:২৬, জানুয়ারি ১৪, ২০২৩
www.adarshabarta.com

আদর্শবার্তা ডেস্ক :

গণশুনানির ৪ দিন পর অনেকটা তাড়াহুড়া করে নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় দেশের মানুষের জীবনযাপনের খরচ আরও বাড়লো। এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রধান পণ্যগুলোর দাম আগে থেকেই বাড়তি। চালের দাম বেড়েছে কয়েক দফা। বেড়েছে জ্বালানি তেল, চিনি, ভোজ্য তেল ও ডালের দাম। সব মিলিয়ে দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী। খাদ্যবহিভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতিও বেড়ে চলছে। কষ্টে আছে সাধারণ মানুষ। শুক্রবার ওবায়দুল কাদেরও স্বীকার করেছেন মানুষ কষ্টে আছে। সার্বিকভাবে মধ্যম ও নিম্নআয়ের মানুষ যখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখনই বিদ্যুতের দাম বাড়ালো সরকার।

বিদ্যুতের এই মূল্যবৃদ্ধি সীমিত আয় ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সবার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নির্বাহী আদেশে তড়িঘড়ি করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘটনা দেশে নজিরবিহীন। এতে করে সীমিত আয় ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক অনটন আরও বাড়বে। এ ছাড়া এর আগে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু জনগণ গ্যাস পাচ্ছে না। বিদ্যুতের দাম বাড়ালেও নিরবচ্ছিন্ন সেবা পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই।

বিদ্যুতের দাম বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ইতিমধ্যে পোশাকশিল্প খাত ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। দেশের শীর্ষ পণ্য রপ্তানির পোশাকশিল্প যেকোনো সময়ের চেয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। শঙ্কা প্রকাশ করেছে ঢাকা চেম্বার। শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ না দিয়ে দাম বাড়ানো যৌক্তিক নয়। জ্বালানি ও ডলার সংকটে শিল্প উৎপাদনে ধস নেমেছে। এরমধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। এই ভার বহনের সক্ষমতা শিল্পের নেই।

এর আগে বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির মধ্যে গত বছরের ৫ই আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়। এর আগে ৫ই জুন গ্যাসের দাম ২২ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়। ফলে দ্রব্যমূল্য, পরিবহন ভাড়াসহ সবকিছুর দাম হু-হু করে বাড়ে। বর্তমানে অনেক নিত্যপণ্যের দাম দ্বিগুণ-তিনগুণ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত বছর জানুয়ারিতে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.০৫ শতাংশ। চলতি বছর এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৭১ শতাংশে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সরকারের ভর্তুকি সংক্রান্ত চাপ কমবে। তবে কৃষি এবং শিল্পের বাড়তি ব্যয় ভোক্তার কাঁধের উপর পড়বে। মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভোক্তার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলের পাশাপাশি তার দৈনন্দিন খরচ বেড়ে যাবে। বাজারে পণ্যের দাম আরও বাড়বে। যেমন কৃষিকাজে সেচের ব্যয় বাড়বে। কৃষিপণ্যের দাম বাড়বে। এরসঙ্গে দোকানের বিদ্যুৎ ব্যয় বাড়বে। কারখানায় উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। সরকার মূলত আইএমএফের চাপে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে।

এদিকে সার ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে এমনিতেই চতুর্মুখী চাপে দেশের কৃষি, পোল্ট্রি ও ডেইরি খাত। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে আমদানিনির্ভর সব উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি। এবার মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে বিদ্যুতের দাম। এতে কৃষি উদ্যোক্তা ও চাষিরা পড়বেন বিপদে। বাড়বে উৎপাদন ব্যয়। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির চাপ সামলাতে কৃষকরা সেচের ব্যবহার কমিয়ে দেবে। এতে শস্য উৎপাদনও কমে যাবে বলে মনে করেন গবেষকরা।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি ও বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, যখন রপ্তানি টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ তখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে কারখানাগুলোতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। এতে নিম্নআয়ের মানুষ আরও ভোগান্তিতে পড়বে। বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসানও একই মন্তব্য করেছেন। বলেন, যখন বিশ্বব্যাপী মন্দার উদ্বেগ বাড়ছে, তখন বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে কারখানার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে।

বেসরকারি চাকরিজীবী শওকত আলী বলেন, জনজীবনে নতুন আঘাত আসবে-এগুলো গা সওয়া হয়ে গেছে। এমন কোনো খাত কি বাকি আছে, যার দাম বাড়েনি। জ্বালানি তেলের দাম গত বছর আগস্টে রেকর্ড হারে বাড়ানোর পর যানবাহনের ভাড়া বেড়েছে। এদিকে বাজারে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপক চড়া। এরই মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় মানুষের ব্যয় বাড়িয়ে দিলো সরকার।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, বর্তমানে নানা কারণে শিল্পকারখানার উৎপাদন খরচ বাড়ছে। তাছাড়া আগেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। সেই বিবেচনায় আমরা সরকারের কাছে বিদ্যুতের দাম না বাড়াতে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়ালো। দেশে বাসাবাড়ি থেকে শিল্পকারখানা-সব জায়গাতেই কমবেশি বিদ্যুতের ব্যবহার হয়। ফলে সব খাতে এ মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়বে।
বাজার পরিস্থিতি: সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পর দেশের বাজারে আবারো বেড়েছে ডিমের দাম। অন্যদিকে আদা ও রসুনের দামও বেড়েছে। আবার চালের দামেও তেমন স্বস্তি নেই। চিনির দামেও স্বস্তি নেই।
খুচরা বাজারে প্রতি ডজন ফার্মের ডিম ১৩০ টাকা দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে। ডিম বিক্রেতারা বলেন, পাইকারি বাজারে ডিম নেই। সে কারণে এখন প্রতি ডজনে ১৫ টাকা বাড়তি বিক্রি করতে হচ্ছে। গত সপ্তাহেও ডিমের দাম ১১৫-১২০ টাকা ডজন ছিল। তবে কিছু এলাকার বাজারে ১২৫ টাকায়ও প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে আদা-রসুনের দাম। বাজারে প্রতি কেজি আদা বিক্রি হচ্ছে ১৫০-২০০ টাকায়। যা ১২০-১৪০ টাকার মধ্যে ছিল। এ ছাড়া ৮০-১০০ টাকার মধ্যে থাকা রসুনের দাম এখন ১২০-১৫০ টাকা দরে উঠেছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যে সপ্তাহের ব্যবধানে রসুনের দাম ২০ শতাংশ এবং আদার দাম ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
অন্যদিকে বাজারে চিনির কেজি ১১৫-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও সরকার নির্ধারিত দাম সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা। যা দুই মাস আগে নির্ধারণ করা হলেও এতদিন সে দামে চিনি পাওয়া যায়নি। বাজারে মোটা, মাঝারি ও সরু মসুর ডাল কেজি ১০০-১৪০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৯০ টাকা।

দুই সপ্তাহ আগে চালের দাম কিছুটা কমতির দিকে ছিল। তবে সেটা স্বস্তি দেয়ার মতো না। কয়েক মাসের ব্যবধান হিসেব করলে চালের দাম এখনো অনেক চড়া। বাজারে গুটি স্বর্ণা জাতের চালের কেজি ৪৮-৫২ টাকা। পায়জাম ও বিআর-২৮ জাতের মাঝারি আকারের চালের কেজি কেনা যাবে ৫৮-৬০ টাকা দরে। তবে চিকন বা মিনিকেট চালের দাম কমেনি। এ মানের চাল এখনো ৭২-৭৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে এখন ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৫০-১৫৫ টাকায় কেনা যাচ্ছে। তবে প্রতি কেজি ৭০০ টাকায় অপরিবর্তিত রয়েছে গরুর মাংসের দাম। এদিকে কেজিতে ১০-৩০ টাকা বেড়েছে পাঙাশ, তেলাপিয়া ও রুই মাছের দাম। তেলাপিয়া ও পাঙাশের কেজি ১৮০-২০০ টাকা নিচে মিলছে না। রুই মাছের দাম মানভেদে ২৫০-৪০০ টাকা কেজি।

এদিকে ঘন কুয়াশার কারণে সবজি পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। এতে ঢাকার বাজারে শীতের সবজি আসছে কম। ভরা মৌসুমেও গত দু-তিন দিনের ব্যবধানে কেজিতে সবজির দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। বাজারে প্রতি কেজি বেগুন ৬০-৮০ টাকা, শিম ও টমেটো ৫০-৬০ টাকা, করলা ১০০-১২০ টাকা, গাজর ও শসা ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঝিঙে, ধুন্দল ও চিচিঙ্গার কেজিপ্রতি দাম রাখা হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা। গত সপ্তাহেও এসব সবজির কেজি ৫০-৬০ টাকার মধ্যে ছিল।

সুত্র: মানবজমিন।